পুতিনের স্বাস্থ্য খুবই ভালো আছে : সিআইএর প্রধান
ইউরোপের উদ্বেগ কমিয়ে রাশিয়ার গ্যাসপ্রবাহ পুনরায় চালু
রাশিয়া-ইরান জোট ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বেগে ফেলেছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুধবার ঘোষণা করেছে যে, তারা ইউক্রেনে আরো চারটি উন্নত মাল্টিপল-রকেট লঞ্চার যান পাঠাবে। এর আগে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ হুঁশিয়ার করেছেন, ইউক্রেনের হাতে পশ্চিমা দূরপাল্লার অস্ত্র আসার পর সেদেশে রাশিয়ার ভৌগলিক লক্ষ্য শুধু ডনবাস দখলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না।
মার্কিন এ দূরপাল্লার রকেট লঞ্চারগুলি নির্ভুল-নির্দেশিত লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। এটি বিমান হামলার থেকে ফেলা বিধ্বংসী বোমার মতোই বিশাল এলাকায় জুড়ে ক্ষতিসাধন করতে পারে। এটি নতুন দীর্ঘ-পাল্লার অস্ত্রের একটি অংশ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহিরাগত ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করছে। এগুলো রাশিয়ার সামরিক শক্তির মোকাবিলায় ওয়াশিংটনের সংকল্প প্রমাণ করে। কিন্তু সম্প্রতি যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার অবিচলিত অবস্থান এবং ক্রমবর্ধমান লাভের বিপরীতে পশ্চিমা মিত্ররা অস্ত্রের জন্য ইউক্রেনের আপাতদৃষ্টিতে অতৃপ্ত ক্ষুধা বজায় রাখার জন্য সংগ্রাম করছে। পাশাপাশি ইউক্রেনীয় এবং আমেরিকান কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্ত্র দেয়া নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বুধবার পেন্টাগনে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে, প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড জে অস্টিন বলেন, আরও চারটি উন্নত মাল্টিপল রকেট লঞ্চার দেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ ইউক্রেন এ জাতীয় মোট ১৬টি অস্ত্র পেল।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একজন উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক জুন মাসে বলেছিলেন যে, রাশিয়া যে শক্তিগুলো মাঠে নামাতে পারে তার সাথে আরও ভালভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিদ্বতা করার জন্য ইউক্রেনের ৩০০টি মাল্টিপল-লঞ্চ রকেট সিস্টেম এবং ৫০০টি ট্যাঙ্কের প্রয়োজন। এটি ইউক্রেনকে যে প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ গ্যাসের দাম এবং জাতীয় বলিদানের জন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে আমেরিকান সংকল্প কতদিন স্থায়ী হবে সেই প্রশ্নটিও অস্ত্র স্থানান্তর নিয়ে উদ্ভ‚ত। বাইডেন প্রশাসনও অস্ত্র সরবরাহ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল যা রাশিয়ার ভুখন্ডের পৌঁছাতে পারে এবং সম্ভাব্যভাবে একটি বিস্তৃত যুদ্ধকে স্পর্শ করতে পারে।
রাশিয়ান বাহিনীর লাগাম টেনে ধরার জন্য কী প্রয়োজন তা নিয়ে পশ্চিমে বিতর্ক চলতে থাকায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ভি ল্যাভরভ বুধবার বলেছেন যে ইউক্রেনে রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্খা এখন দেশটির পূর্বাঞ্চলের বাইরে প্রসারিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টিভি রাশিয়ান টেলিভিশনের (আরটি) সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ল্যাভরভ বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো দূরপাল্লার রকেট ও কামান সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়ার রাশিয়া তাদের ‹বিশেষ সামরিক অভিযানের› ভৌগলিক লক্ষ্য এরই মধ্যে পূর্বের ডনবাস ছাড়িয়ে দক্ষিণের খেরসন এবং জাপোরোৎজিয়া অঞ্চলে প্রসারিত করেছে। অর্থাৎ, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকারান্তরে হুমকি দেন পূর্বের ডনবাসের বাইরেও আরো এলাকা দখলের লক্ষ্য নিচ্ছে রাশিয়া। তিনি যুক্তি দেন, ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা থেকে পশ্চিমা এসব দূরপাল্লার অস্ত্র যাতে রাশিয়ার ভূন্ডের হুমকি তৈরি না করতে পারে সেজন্যই এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
পুতিনের স্বাস্থ্য খুবই ভালো আছে : রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়েছে এমন কোন গোয়েন্দা তথ্য নেই – বলছেন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর পরিচালক। বেশ কিছুকাল ধরে সংবাদমাধ্যমে জল্পনা চলছে যে পুতিন সম্ভবতঃ ক্যান্সারের মত কোন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন – কিন্তু এসব খবর কখনোই নিশ্চিত করা যায়নি। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেন, এরকম কিছু বলার মতো কোন প্রমাণ নেই। তিনি ঠাট্টা করে বলেন, পুতিনকে দেখে মনে হয় তার স্বাস্থ্য ‘খুব বেশি রকমের ভালো।’ এ বছরই পুতিনের বয়স ৭০ পুরো হতে যাচ্ছে। তার ভগ্নস্বাস্থ্যের খবর আবারো উড়িয়ে দিয়ে ক্রেমলিন বলেছে, এসব রিপোর্ট ‘ভুয়া ছাড়া কিছুই নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে এ্যাসপেন নিরাপত্তা ফোরামে বার্নস বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক গুজব রয়েছে – তবে আমরা যতটুকু বলতে পারি তাতে মনে হয় তার স্বাস্থ্য খুব বেশি রকমের ভালো।’ ক্রেমলিনও এসংক্রান্ত গুজব উড়িয়ে দিয়েছে। পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গতকাল রিপোর্টারদের বলেন, ‘সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেনীয়, আমেরিকান ও ব্রিটিশ কিছু তথাকথিত তথ্য বিশেষজ্ঞ প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ কিছু গুজব ছড়িয়েছে। কিন্তু এগুলো ভুয়া খবর ছাড়া আর কিছুই নয়।’
সিআইএর পরিচালক বার্নস একসময় মস্কোতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি বলেন, তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রুশ নেতাকে দেখে আসছেন। তিনি বলেন, ‘পুতিন নিয়ন্ত্রণ, ভীতি প্রদর্শন এবং সমুচিত প্রত্যুত্তর দেয়ায় বিশ্বাসী’ এবং গত এক দশকে তার মধ্যে এ প্রবণতাগুলো আরো জোরালো হয়েছে, তার উপদেষ্টাদের চক্রটি আরো ছোট হয়ে এসেছে। বার্নস বলেন, ‘পুতিন স্থির নিশ্চিত যে রাশিয়ার নেতা হিসেবে তার লক্ষ্য হচ্ছে দেশটিকে একটি বৃহৎ শক্তিধর দেশ হিসেবে পুনপ্রতিষ্ঠিত করা। তিনি বিশ্বাস করেন যে এটা করতে হলে রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে একটি প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে হবে এবং ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ না করে তিনি এটা করতে পারবেন না।’
রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযানের পরিকল্পনা করছে এমন গোয়েন্দা তথ্য পাবার পর গত বছর নভেম্বরে বার্নস মস্কো সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে যাবার সময় তিনি যতটা দুশ্চিন্তায় ছিলেন, ফেরার সময় তিনি ‘তার চেয়েও বেশি উদ্বেগ নিয়ে’ ফিরেছিলেন – বলেন বার্নস। তিনি বলেন, কিছু ‘গুরুতর ভুল অনুমান এবং ইউক্রেনের ব্যাপারে কিছু প্রকৃত বিভ্রমের ওপর ভিত্তি কর’ রুশ প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল।
ইউরোপের উদ্বেগ কমিয়ে রাশিয়ার গ্যাস প্রবাহ পুনরায় চালু : গতকাল প্রথম দিকে গ্যাস একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস প্রবাহিত হতে শুরু করে যা সাধারণত জার্মানির চাহিদার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি এবং সেইসাথে তার বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় অংশীদারকে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করে। পাইপলাইন, নর্ড স্ট্রিম ১, তার নির্ধারিত বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১১ জুলাই থেকে অফলাইন ছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে মস্কো এবং ইউরোপের মধ্যে উত্তেজনার মধ্যে, মহাদেশের অনেকেই আশঙ্কা করেছিল যে, রাশিয়া পরে গ্যাস প্রবাহ আবার শুরু করবে না।
নর্ড স্ট্রিম এজি, যে কোম্পানিটি পাইপলাইন পরিচালনা করে, তার একজন মুখপাত্র বলেছেন যে, বৃহস্পতিবার ভোরে গ্যাস প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এনার্জি জায়ান্ট গ্যাজপ্রম পাইপলাইনের মাধ্যমে বুক করা ৩০ শতাংশ ক্ষমতায় পৌঁছাতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে। এ ঘটনা হল রাশিয়ান শক্তির উপর জার্মানি এবং ইউরোপের বেশিরভাগ নির্ভরতার আরেকটি অনুস্মারক, এমন একটি সম্পর্ক যা কর্মকর্তাদের তাড়িত করে যারা বলে যে, মস্কো সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করার জন্য তার তেল এবং গ্যাস ব্যবহার করছে।
রাশিয়া এর আগে প্রযুক্তিগত সমস্যাকে দায়ী করে জুনে পাইপের মাধ্যমে আসা গ্যাসের পরিমাণ ৬০ শতাংশ কমিয়েছিল। তারপর পুতিন দাবি করেছিলেন যে এটির একটি গ্যাস টারবাইন দরকার যা মেরামতের জন্য কানাডায় পাঠানো হয়েছিল। তবে ইউরোপের নেতারা আরও ঘৃণ্য উদ্দেশ্য সন্দেহ করছেন এবং আরও কাটছাঁটের আশঙ্কা করছেন। আরও ব্যাঘাত ইউরোপের ক্রমবর্ধমান জ¦ালানি খরচকে তীব্র করবে এবং মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। ইইউ সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে: ইউরোপীয় কমিশন সরকারগুলির জন্য গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমানোর জন্য একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে। সামনে কঠিন শীত অপেক্ষা করায় বিষয়টি আরও কঠিন হবে।
রাশিয়া-ইরান জোট ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বেগে ফেলেছে : পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে রাশিয়ার সাথে পরোক্ষ আলোচনার মধ্যে ইরানের বিষয়ে নমনীয় হয়েছে মার্কিন প্রশাসন। এ সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং তার তুর্কি সমপক্ষ রজব তাইয়্যেপ এরদোগানের তেহরান সফরের পর, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইরানকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অপসারণ বা ‘রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল’ হওয়ার মধ্যে একটি পছন্দ করার আহবান জানিয়েছে।
নেজাভিসিমায়া গাজেতার মতে, পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যম তেহরানে ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনকে এই অঞ্চলে বাইডেনের সাম্প্রতিক সফরের বিরোধী হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছিল, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম। ইরানের কট্টর রক্ষণশীল সংবাদপত্র, কায়হান বলেছে যে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ‘আবার এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক‚টনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।’ এবং আরেকটি অতি রক্ষণশীল সংবাদপত্র গর্ব করে যে ‘পুতিন এবং এরদোগানের সফর একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার সূচনা করবে’ এবং ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ডলারের বিরুদ্ধে একটি জোট প্রতিষ্ঠার’ প্রেরণা দেবে।
সামরিক বিশেষজ্ঞ ইউরি লিয়ামিন নেজাভিসিমায়া গেজেটাকে বলেছেন, ‘ইরানের অর্থনীতির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অধীনে রয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও কিছুটা প্রসারিত করতে পারে তবে চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হবে না, যেহেতু ইরানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি দেশটির অর্থনীতিকে পশ্চিমা আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ‘ বাইডেন প্রশাসনও বিশ্বাস করে না যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আরও চাপ দেয়া সহজ, যেহেতু কয়েক মাস ধরে আলোচনা স্থগিত রয়েছে, লামিন উপসংহারে পৌঁছেছেন।
রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে ক্রমাগত শক্তির সম্পর্ক পশ্চিমাদের জন্য মাথাব্যথা হয়ে উঠতে পারে। দুই দেশের সম্মিলিত নিয়ন্ত্রণে থাকবে বৈশ্বিক গ্যাস রিজার্ভের ৪০ শতাংশ এবং তেলের ১৫ শতাংশ। উভয় দেশই ইইউ এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে রয়েছে, তাই তাদের জোট বিধিনিষেধের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ক্লায়েন্টদের কাছে তাদের সংস্থান বিক্রি করার পদক্ষেপগুলিকে অগ্রাধিকার দেবে। এছাড়াও, রাশিয়া এবং ইরান একে অপরকে নিষেধাজ্ঞা প্রশমনেও অনেক সাহায্য করতে পারে, রসিয়েস্কায়া গেজেটা লিখেছে। সূত্র : তাস, বিবিসি নিউজ, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ইকোনমিস্ট।