নানামুখী দ্বিধা-সংশয় নিয়েই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পথে হাটছে বর্তমান সংসদের সাংবিধানিক প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার প্রশ্নে দলে মতভিন্নতা কিংবা বহুমত থাকলেও নানা সমীকরণে ও কারণে দলটি এদিক-ওদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে এখন নির্বাচনমুখী। ভেতরে-ভেতরে কিছু ঘটনাপ্রবাহে দুইদিন আগে থেকে এতদিনের অবস্থান থেকে নড়ে দলটি এখন নির্বাচনমুখী। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য বলছে, তারপরেও দেশের ভেতরের-বাইরের পরিস্থিতি বুঝে প্রকাশ্যে সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করবে জাপা। ভিন্ন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে, পরিস্থিতির আলোকে জাপাও নতুনভাবে চিন্তা করবে।
এদিকে, আজ বুধবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে গতকাল মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। রাত ৮টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা তিনি বঙ্গভবনে ছিলেন। বৈঠক শেষে জিএম কাদের বলেন, ‘এটা একেবারেই সৌজন্য সাক্ষাত্। উনি কয়েকদিন আগে আমাকে কল করেছিলেন, বলেছিলেন- ফ্রি থাকলে একদিন চা খেতে আসেন। আজকেও (গতকাল) কল করেছেন। এই কারণেই আসলে যাওয়া। সতিই চা খেয়েছি, কুশল বিনিময় করেছি, এই তো, আর তেমন কিছু না।’ জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার আগে থেকেই জানাশুনা ছিল। এরশাদ সাহেবের বাসায়ও উনি কয়েকবার এসেছিলেন, তখনও আমার সঙ্গে দেখা-কথা হয়েছিল। এরপরও কয়েকবার বিভিন্ন স্থানে দেখা হয়েছে। উনি (রাষ্ট্রপতি) আমাকে বললেন- আপনি তো খুব ভালো-ভালো কথা বলেন, খুব মার্জিতভাবে বলেন, আপনার কথাবার্তা আমার খুব পছন্দ।’ নির্বাচন ও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে জিএম কাদের বলেন, ‘টুকটাক, তেমন কিছু না। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি তো এসবের পার্টও নন।’
জিএম কাদের বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি আমাকেও কল করেছিলেন কয়েকদিন আগে। বলেছেন- সময় থাকলে একদিন চা খেতে আসেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার জানাশুনা অনেক আগে থেকেই।’
এদিকে, রাতে বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে গতকাল রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত জাপার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বক্তব্য রেখেছেন জিএম কাদের। সভায় দলটির বেশিরভাগ নেতাই নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। জবাবে জাপা চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘নির্বাচনে গেলে স্যাংশন আসারও সম্ভাবনা রয়েছে।’ দলীয় নেতাদের কাছে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় যদি আমরা নির্বাচনে যাই, আর যদি পরবর্তীতে সরকার সমস্যায় পড়ে তাহলে কী হবে? নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আপনারা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। নানা বিষয় আমাকে ভেবে দেখতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি এসেছে আমাদের কাছে। এই চিঠির গুরুত্ব অনেক। এটা যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল চিঠি। তারা সংলাপ চাচ্ছেন। আমরাও সংলাপের কথা বলে আসছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আর কোনো দলের মুখাপেক্ষী থাকতে চাই না। আমরা এখন দলগতভাবে অনেক শক্তিশালী।’
জানা গেছে, গত ৪ নভেম্বর জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর গুলশানের বাসায় বৈঠক করেছেন দলটির সিনিয়র- কো-চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যানরা। বৈঠকে নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকের বিষয়ে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘বৈঠকে একটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত হয়েছি যে- যদি শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বাচনে যাই, সেক্ষেত্রে জিএম কাদেরের একক নেতৃত্বেই সবকিছু হতে হবে। যদি রওশন এরশাদকে নিয়ে পৃথক গ্রুপিংয়ের চেষ্টা করা হয়, তাহলে আমরা ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’
জাপা নির্বাচমুখী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় দলটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, বিএনপি নির্বাচনে আসুক আর না আসুক, গত তিনটি নির্বাচনের মতো এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন-সমঝোতার ভিত্তিতে জাপার নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা চলছে। এসব কথাবার্তায় ঘুরেফিরে আসন সংখ্যার বিষয়টিই সামনে আসছে। এবিষয়েও অনানুষ্ঠানিক কথা হচ্ছে, ২৫, ৩০, ৩৫, ৩৬, ৩৭- এরকম নানা সংখ্যা নিয়েও আলোচনা চলছে। এই নেতারা জানান, যদি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন হয় তাহলে তাতে অংশগ্রহণ না করার যৌক্তিক বিকল্প জাপার কাছে এখন পর্যন্ত নেই। এছাড়া নির্বাচনে না গিয়ে দলের ভেতরের-বাইরের পরিস্থিতি হজম করার মতো সাংগঠনিক শক্তির প্রশ্নটিও রয়েছে। যার কারণে, বাস্তবতা বিবেচনায় জাপা নির্বাচনমুখী হওয়া ছাড়া আপাতত বিকল্প দেখছে না। তারপরেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জাপা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।