ফরিদ সুমন: –
পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া কোন যুদ্ধ হয় না, সেটা মহা কাব্যের গিলগামিস, স্পার্টা বা কুরুক্ষেত্র থেকে হাল আমলের রাশিয়া-ইউক্রেন বা হামাস ইসরায়েলের যুদ্ধই হোক।
যুদ্ধ মানেইতো এক পক্ষ হত্যা করবে আর এক পক্ষ সেই হত্যার শিকার হবে। এক পক্ষের রক্তের উপর দাড়িয়ে আর এক পক্ষ ফল ভোগ করবে! তবে রক্ত কিন্তু এক পক্ষের যায় না বিজয়ী পক্ষের রক্তও সেখানে মিশে থাকে। এক দল মানুষ স্বপ্ন দেখে যুদ্ধে গিয়ে রক্তের সমুদ্রে ডুবে যায় আর এক দল মানুষ স্বপ্ন দেখিয়ে সে সমুদ্রে প্রাপ্তির ভেলা ভাসায়।
এখানে প্রশ্ন হলো রাশিয়া যুদ্ধে গিয়েছে নাকি তাকে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে! যদি গিয়ে থাকে তবে কেন গেলো? আর যদি পাঠানো হয় তবে প্রশ্ন হলো কে পাঠালো, কেন পাঠালো? দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধ প্রশান্ত মহা-সাগরের পাড়ে সমাহিত করে আটলান্টিকের জলে শুদ্ধ হলো ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। সেই শুদ্ধ জল থেকেই আবার যুদ্ধ কেন জেগে উঠলো! কে জাগালো!
বিশ্বযুদ্ধের পরে জন্ম নিলো জাতিসংঘ, তার উপর দায়িত্ব দেয়া হলো আর যেন যুদ্ধ না হয় তা দেখার। কিন্তু কি হলো, সেই সংঘের বড় দেশগুলোই বার বার যুদ্ধে জড়াচ্ছে।
২য় বিশ্বযুদ্ধে দ্বিখন্ডীত হওয়া জার্মানীর পশ্চিম জার্মানি এবং ততকালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সংঘটিত চুক্তিকে বর্ধিত করে যুক্তরাষ্ট্র জন্ম দিলো “নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন” (ন্যাটো)। এখন ৩১ সদস্যের ন্যাটোতে সংযুক্ত জার্মানি নেত্রীস্থানীয় সদস্য। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নও নাই, তবে ন্যাটোর এখন আবার অপেক্ষাকৃত দূর্বল রাশিয়ার ত্বকের উপরে গিয়ে আস্থানা গাড়তে হবে কেন! আঘাত করতে গেলে প্রতিক্রিয়াতো হবেই।
সেই প্রতিক্রিয় রাশিয়া আক্রমন করলো ন্যাটোর অপেক্ষায় থাকা তার সাবেক অঙ্গ-রাজ্যে। আগেই তার ক্রিমিয়া নিয়ে গিয়েছে। কথায় আছে আহত বাঘকে আর আঘাত করতে যেও না, পরিনতি খারাপ হবে। যে আগেই ক্ষতিগ্রস্থ তাকে আর ক্ষতির দিকে নিও না সে কিন্তু মরন কামড় দিবে, রাশিয়া এখন মরন কামড় দিয়েছে।
আমাদের বুঝতে হবে পুতিন কেজিবির এজেন্ট ছিলেন, ঝানু গুপ্তচর পুতিন রাজনীতিটা ভালোভাবেই শিখে ক্ষমতা হস্তগত করেছেন। আর জেলেনস্কি! একজন পিছনের সারির কৌতুক অভিনেতা গনতন্ত্রের ত্রুটিপূর্ণ পথে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছে, না জানে রাজনীতি না বোঝে নেত্রীত্ব, এমন মানুষ একটা দেশ চালাবে কি ভাবে? ফলাফল যা হবার তাই হলো, একটা জাতী ধ্বংসের শেষ সীমায় চলে গেল আর একটা উন্নত দেশ ১বছরের মধ্যে ভিক্ষুক হয়ে গেল!
রাশিয়া থেকে হুমকি আসার পরেই ইউক্রেনের উচিত ছিলো জেলেনস্কিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া, তা না করে সেই অযোগ্য এক বিনোদন কর্মীর হাতে যুদ্ধের নেত্রীত্ব ছেড়ে দিলো। এটা ইউক্রেনের ইতিহাসের সব থেকে বড় ভুল।
এই যুদ্ধে আক্রনকারী যেমন রাশিয়া আবার নমনীয় পক্ষও রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু করলেও পুতিন বহুবার আলোচনার আহবান জানিয়েছেন কিন্তু বিনোদন-বয় জেলেনস্কি ও তার দাতারা সেটাকে পুতিনের দুর্বলতা হিসাবে দেখেছে, কিন্তু আমার মনে হয় সেটা ছিলো তার মহানুভবতা ও দূরদর্শী চিন্তা। ন্যাটোর পুতিনের আহবানে সাড়া দেয়া উচিত ছিলো, তারা সে প্রস্থাব মেনে নিলে ইউক্রেন বেচেঁ যেত পৃথিবীও বিরাপদ হতো।
ন্যাটোর অর্থে, ন্যাটোর অস্ত্রে ইউক্রেন যুদ্ধ করছে! কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেত ইউক্রেনকেই থাকতে হচ্ছে, তারাই নিহত হচ্ছে, ঘর তারাই হারাচ্ছে। ন্যাটো দূরে বসে হায় ইউক্রেন, হায় ইউক্রেন করছে। আর যুদ্ধের বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে অনুন্নত দেশগুলো খাদ্যের অভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কোন দেশের জন্যই সুফল আনবে না। পৃথিবীতে আবার অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সবার গোলাবারুদের পরিমানতো বাড়বেই সাথে কেউ এই সুযোগে পরমানু অস্ত্রের মালিক হয়ে যেতে পারে।
তবে কি ৩য় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন! আমার মনে হয় ন্যাটো দৈত্যটাকে ভেঙ্গে দিলে সেই হুমকিটা আর থাকবে না। কারন আধুনিক চীন কখনো কোন দেশ আক্রমন করেনি, ইউক্রেনের আগে রাশিয়াও কাউকে আক্রমন করেনি। কিন্তু ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমন করেছে, আফগানিস্তান, লিবিয়া ধ্বংস করেছে, মিশর, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, ইয়েমেনকে যুদ্ধের মধ্যে নিয়ে গিয়েছে। আফ্রিকা এক রকম ধ্বংস করেছে, এখন চীন-রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারলে আবার পৃথিবীটাকে উপনিবেশ বানাতে পারে। কিন্তু সেটা কতটা বাস্তবসম্মত চিন্তা, ন্যাটো জোটতো সব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে সেখানে রাশিয়-চীনকে টারগেট করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?
ইউক্রেন যুদ্ধ ঝিমিয়ে পরেছে, দাতাদের অনুদানে আগের গতি নাই, ইউক্রেনের এখনো যেটুকু আছে তাদের উচিত সে টুকু নিয়েই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাওয়া না হয় ক্ষতির পরিমান বাড়তেই থাকবে। আমার মনে হয় রাশিয়া এখনও যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, ইউক্রেনের উচিত ন্যাটোর দিকে তাকিয়ে না থেকে রাশিয়ার সাথে একটা মিটমাট করে নেয়া।
এশিয়া, আফ্রিকা চীন-রাশিয়ার নেত্রীত্বে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। আফ্রিকা থেকে গনতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে, সেনা নিয়ন্ত্রন বাড়ছে, তাদের জনগনও গ্রহন করতে শুরু করেছে। রাজনীতি আর সেখানে উন্নয়ন দিতে পারছে না, নিরাপত্তা নাই, স্বচ্ছতা নাই, তারা উপনিবেসের মত ব্যবহৃত হচ্ছে। সেনাবাহিনী গুলো অসন্তুষ্ট, জনগন ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে। মিত্রদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, জাতীসংঘ নিয়োজিতো শান্তি রক্ষি-বাহিনীকে তাদের দেশ থেকে বের করে দিচ্ছে। জনসাধারণ রাজনীতিকদের প্রতি সামান্য পরিমানও সহানুভূতি প্রদর্শন করছে না। সারা পৃথিবীর এতো উন্নত জীবনযাত্রা দেখে তাদের সম্পদ থাকতেও তারা কেন কষ্টের জীবন ভোগ করবে!
পশ্চিমারা তাদের লুট করেছে, স্বপ্ন নষ্ট করেছে, তাদের উপর স্বার্থবাদী শাসন চাপিয়ে দিয়েছে। মানবাধীকার উপেক্ষা করেছে, তাদের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু উন্নত দেশকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ধ্বংস করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় চীন-রাশিয়া তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে আর তারাও তা গ্রহন করছে। তাই তারা এখন পশ্চিমা কাঠামোর গনতন্ত্রকে বিদায় জানাচ্ছে, তাদের নেতারা এখন জাতীসংঘে দাড়িয়ে ঘোষণা করছে পশ্চিমা ধাঁচের গনতন্ত্র আফ্রিকায় চলবে না, এই পদ্ধতি আফ্রিকায় সমস্যার সমাধান দিবে না।
আফ্রিকায় দরকার তাদের ধাঁচের পদ্ধতি, আর সেটাই তাদের সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তাই তাদের সমাস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের হাতেই থাকা উচিত। কোন জাতীকে জোর করে ও চাপ দিয়ে পালটাতে চাইলে ফল ভালো হয় না, এর সাম্প্রতিক প্রমান ইউক্রেন ও গাজা।
ন্যাটোকে রাশিয়ার দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমা জেদ অনিবার্য করেছে ইউক্রেন হামলা আর ইজরায়েলের ক্রমবর্ধমান বসতি সমস্যা পশ্চিম তীর ও গাজাকে ক্ষুদ্ধ করেছে, আর তার পরিনতি এখন আমরা ভোগ করচ্ছি।
মধ্যপ্রাচ্যের এই যুদ্ধ ছড়িয়ে গেলে এক মহা বিপর্যয় নেমে আসবে সারা পৃথিবীতে, এর ধারাবাহিকতায় যদি ২১ ও ৪৫ এর মতো সব পক্ষ জড়িয়ে যায় (!) তবেতো আর একটা মহা বিপর্যয় দেখবে ৬টা মহাদেশ।
যখন পরমাণু অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা চলছিলো তখনই সেটা যে ধ্বংস-যজ্ঞ চালিয়েছে তাতেই একটা দেশ ধ্বংসের প্রান্তে চলে গিয়েছিলো আর এখন তো পৃথিবীতে প্রায় ১৫০০০ পরমাণু অস্ত্র, এর যদি ১%ও বাতাসে প্রয়োগ করা হয় তবে কি বাকিগুলো অক্ষত থাকবে? আর যদি না থাকে তবে কি নরক খুজতে অন্য কোথাও যেতে হবে! এমন হলেতো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলই হুমকির মুখে পরবে।
এখন রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া উচিত, ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমাদের মাতা-মাতি বন্ধ করলেই এটা সম্ভব। এদিকে ইসরায়েলের ক্ষুধা কমানো দরকার, প্রতিবেশীকে অশান্ত করে কখনো শান্তিতে থাকা যায় না, রাজনীতিকরা এতো কিছু বোঝে এটা বোঝে না!
ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর জন্য চীনকে সম্মানের সাথে অনুরোধ করা উচিত কারন একমাত্র চীনই পারে এ যুদ্ধ থামাতে। আগুনে বাতাস দিলে আগুন কমে না বাড়ে, আগুন থামাতে হলে জল দেয়া দরকার। হুমিকি-ধামকি দিয়ে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে থামানো যাবে না তা প্রমানিত। একমাত্র ভালো ব্যাবহারই পারে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার পথ দেখাতে। বাইডেন-সুনাক এটা শিখতে পারলেই ইউক্রেনের শান্তি ফিরবে। সেই শান্তিটাই আমরা অন্বেষণ করছি। যুদ্ধটা থামা দরকার।