বিশ্বকাপের ফাইনালে ১ লাখ ৩০ হাজার ভারতীয় দর্শকদের নীরব করে ষষ্ঠ বারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে অজিরা। ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স বলেছিলেন, ‘আমরা ফাইনালে স্টেডিয়ামে ভারতীয় হাজার সমর্থককে চুপ করিয়ে দিব।’ তিনি তার দেওয়া কথা রেখেছেন।
সমর্থকদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন আসরে প্রথম বারের মতো ভারতকে হারের স্বাদ দিয়ে। বিশ্বকাপের শুরু থেকে রোহিত শর্মার নেতৃত্বে দুর্দান্ত খেলতে থাকে স্বাগতিকরা। ফাইনাল বাদে প্রথম পর্ব এবং সেমিফাইনাল মিলিয়ে মোট ১০টি ম্যাচ খেলে টিম ইন্ডিয়া। সেসব ম্যাচে জয় নিয়ে অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে ভারত। তবে ঘরের মাটিতে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে ২০০৩ সালের কথা মনে করিয়ে দিল অস্ট্রেলিয়া।
ভারতকে ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ ফাইনালে হারানোর পর অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ক্রিকেটার নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানান। নিচে কয়েক জন ক্রিকেটারের কথা তুলে ধরা হলো।
জশ হ্যাজেলউড
‘আমি মনে করি এটি ২০১৫ বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও বড়। কারণ ২০১৫ বিশ্বকাপ আমরা আমাদের ঘরের মাটিতে আমাদের সমর্থকদের সামনে জিতেছি। তবে এখানে বিশ্বকাপ জেতা বেশ কঠিন ছিল। কারণ গত কয়েক মাসে আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্য দিয়ে গিয়েছি—এখানে আসা এবং ভারতের মতো বিশেষ দলের বিপক্ষে এই কন্ডিশনে খেলা খুব একটা সহজ নয়।
আবার, এমন একটি দিনে জিততে পারাটাও বিস্ময়কর। এত বিশাল সমর্থন; ভারতীয় ভক্তরা কারো থেকে পিছিয়ে নেই। তবে আমি মনে করি প্রথম দুটি ম্যাচ (ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে) সম্ভবত প্রতিযোগিতার সেরা দুটি দলের বিপক্ষে ছিল, আর সেখানে আমরা হেরেছিলাম। কিন্তু পরে টুর্নামেন্টের বাকি অংশ টুকু আমাদের দুর্দান্ত কাটিয়েছি। আর পুরোটা সময় আমরা কেবল জয়ের দৌড়ে ছিলাম। আমি মনে করি, আজ রাতে আমাদের নিখুঁত খেলা ছিল। যা আমরা সবাই মিলে খেলেছি।
মারনাস লাবুসানে
‘আজকে আমরা যা অর্জন করেছি তা অবিশ্বাস্য। এটা আমার সর্বকালের সেরা অর্জন। ভারত পুরো টুর্নামেন্টেই বেশ ভালো ক্রিকেট খেলেছে। তারা টুর্নামেন্টের সেরা দল। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা জানতাম আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেটটা খেললে আমরা ভারতকে হারাতে পারব। তাই এই ম্যাচে আমরা আমাদের সেরাটা খেলার চেষ্টা করেছি। আমাদের বোলাররা দুর্দান্ত করেছিল এবং তারপর ট্রাভিস (হেড) একটি দারুণ ইনিংস প্রদর্শন করেছিল। যা এই ম্যাচে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এর অংশ হতে পেরে দারুণ লাগছে।
আমি জানি আপনারা জানেন আমি একজন বিশ্বাসী মানুষ এবং আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি। যেভাবে সবকিছু ঘটেছে তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। এটা আশ্চর্যজনক। আমি কথা বলার জন্য শব্দ হারিয়ে ফেলেছি শব্দের জন্য হারিয়ে গেছি। আমি যতবার ভেবেছিলাম আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে- এমনকি গত রাত ১০টা ১০ মিনিট পর্যন্ত দলের নাম ঘোষণা করা হয়নি। কোচরা মাঠে গিয়েছিল- শিশির হতে পারে, আমি বাইরে থাকতে পারি। আমার সঙ্গে থাকার জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এই অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মতো আমার কাছে কোনো শব্দ নেই। কয়েক মাস আগে আমি ওয়ানডে দলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ছিলাম না। এরপর টানা ১৯টি ম্যাচ খেলা সত্যিই একটি অলৌকিক ঘটনা। আমি জানি না কীভাবে এই সব হয়েছে। তবে এর জন্য আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই।’
ট্র্যাভিস হেড
‘ইনজুরির সময় আমি বাড়িতে ছিলাম। সোফায় বসে থাকতাম। চোট না সারলে বিশ্বকাপ নাও খেলতে পারতাম। তবে আমি খুব ভাগ্যবান যে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে এবং আমি এখানে ফিরে আসতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, আমি শুরুতে কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। তবে ব্যতিক্রম ছিল মার্নাস। সে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। আর তাতেই ধীরে ধীরে আমি চাপ কাটিতে উঠতে পেরেছি। তবে তার সঙ্গে আমার চতুর্থ উইকেটে ১৯২ রানের জুটি বেশ আশ্চর্যজনক ছিল। মিচেল মার্শ যখন আউট হয়ে ফিরে যায় তখন আমরা হয়তো পারব না। তবে এটা জানতাম ধীরে ধীরে উইকেট শক্ত হতে থাকবে। সে জন্যই আমরা ম্যাচের শুরুতে টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যা কাজে লেগেছে।’
‘সম্ভবত রোহিত শর্মা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষ। যার এমন ক্যাচ আমি ধরেছি। তবে আমি এই ম্যাচে ১০০ করার কথা কল্পনাও করিনি। আমার কাছে মনে হয় রোহিত শর্মা ক্যাচটা ম্যাচে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তবে এমন চাপের মধ্যে শিরোপা জেতা বেশ চমত্কার বিষয়।’
মিচেল স্টার্ক
‘সে (কামিন্স) অসাধারণ ছিল। আমি মনে করি সে পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলেছে। তার সিদ্ধান্ত নেওয়া, তার নেতৃত্ব, মাঝে মধ্যে তাকে বল নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় যখন যখন দলের দরকার হয় তাকে। সে আমাদের জন্য অসাধারণ ছিল এবং এই গোটা বিশ্বকাপে দারুণ সময় কাটিয়েছে। প্যাট কামিন্স সেই সমস্ত কোচিং স্টাফ, খেলোয়াড়দের মধ্যে এটি একটি অবিশ্বাস্য শিরোপা জয় ছিল। আমি মনে করি না যে আপনি আমাদের কেউ আমাদের এই বিশ্বকাপ যাত্রার থেকে চমকপ্রদক একটি স্ক্রিপ্ট লিখতে পারবেন। ভারতে বিশ্বকাপ জেতা-এটি একটি চমত্কার, এ যাত্রায় আট সপ্তাহ ছিল, কিছুটা কঠিন। এটি দারুণ সফল এবং দারুণ উপভোগ্য ছিল।’
স্টিভেন স্মিথ
‘এটা অবিশ্বাস্য, আজ এখানকার পরিবেশ অসাধারণ ছিল। এটি কেবল একটি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল। ডেভি শুধু বলেছেন, আমাদের বোলাররা সত্যিই দুর্দান্ত করেছে, আজ সন্ধ্যায় ফিল্ডিং দুর্দান্ত ছিল। ট্র্যাভিস হেড, তিনি যে পারফরম্যান্সটি দেখিয়েছে তা অবিশ্বাস্য ছিল। আমরা যখন ৬০ রানে ৩ উইকেট নিয়েছিলাম তখনো (৩ উইকেটে ৪৭ রান) খেলাটা চালিয়ে যান তিনি, নিজের মতো করে খেলতে থাকেন। আমি বলব মার্নাসও সহায়ক চরিত্রে অন্য প্রান্তে একটি অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছে। এটি একটি দুর্দান্ত জুটি ছিল এবং হ্যাঁ, আরেকটি (বিশ্বকাপ শিরোপা)’
‘(বিশ্বকাপ) আমাদের জন্য শুরুটা ভালো ছিল না। হ্যাঁ, আমাদের বিশ্বাস ছিল যে আমরা ভালো দল, আমাদের দুর্দান্ত স্টাফ রয়েছে এবং আমাদের বিশ্বাস ছিল যে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব এবং সৌভাগ্যবশত, আমরা এটি করতে সক্ষম হয়েছি। শেষ অবধি শীর্ষ চারে উঠতে সক্ষম হয়েছি। অস্ট্রেলিয়া সাধারণত সেই মুহূর্তগুলোতে (ফাইনাল) বেশ ভালো খেলে এবং হ্যাঁ, আজ আরেকটি ফাইনাল জেতার আরেকটি স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এটি আমাদের জন্য বেশ বড় বছর ছিল, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ এবং তার পরে এটি জিতেছি।’
ডেভিড ওয়ার্নার
‘আমাদের বোলাররা অসাধারণ ছিল, গত কয়েক ম্যাচ থেকেই অসাধারণ বোলিং করে আসছে, আর সেই সঙ্গে আমাদের ফিল্ডিং তো দারুণ ছিল। আজ আমাদের টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়াতেই আমরা সফলতা পেয়েছি। ফাইনালে তাদের (ভারতকে) ২৪০ রানে আউট করা একেবারেই ব্যতিক্রমী ছিল। ভারতকে এতো কম রানে আটকে ফেলায় ব্যাটারদের জন্য কাজটি সহজ হয়েছে। তবে ব্যাট করতে নামার আগে ডেসিংরুমে সবাই কিছুটা নার্ভাস ছিল। তবে হেড ও মার্নাসের এমন অবিশ্বাস্য ইনিংসের পর সবাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইনজুরিতে পড়া হেডির অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন, ফিরে এসে তার প্রথম খেলায় সেঞ্চুরি এবং আজ রাতে এখানে ভিড়ে ভরা দর্শকদের সামনে সেঞ্চুরি করেছে। তিনি একেবারে অসাধারণ ছিলেন।’
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
‘সব কিছুই অবিশ্বাস্য লাগছে। আমার মনে হয় আমরা সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যখন শিরোপা জয়ের জন্য আর মাত্র ২০ রান প্রয়োজন ছিল। আমি ভেবেছিলাম ২০১৫ সালের এবারও আমি ব্যাট করতে নামার আগেই ম্যাচ শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হেডি আউট হয়ে গেল। কিন্তু মার্নাসের সঙ্গে মাঠে নামতে পারাটা দারুণ ছিল এবং রান নিয়ে জয়ের পর ছেলেরা মাঠে নামতে পেরেছিল, আর কী দারুণ জয়! জসপ্রীত বুমরাহর বিরুদ্ধে হেডের ব্যাটিং দেখে অন্যরকম লাগছিল। প্রায়শই আপনি পরের স্থানে থাকেন না…কিন্তু কতটা ভালো ছিল এই দুজন! মার্নাস সেখানে চাপ সামলে নিয়েছিলেন—তিনি একেবারে অসাধারণ ছিলেন এবং হেডি, ফাইনালে চাপের মধ্যে যা খেলেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।’
মিচেল মার্শ
‘দারুণ আনন্দদায়ক। আমি কিছুদিন আগেই দলের কয়েক জনকে বলেছিলাম, এটা কঠিন ছিল। শ্রীলঙ্কা যখন ১২০ রানে ০ ছিল তখন আমরা জিতেছিলাম। মনে হচ্ছে সারা জীবন আগের মতো। কিন্তু এই দলের সঙ্গে থাকতে পারাটা অবিশ্বাস্য।’