ডায়াবেটিস রোগীর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার রোগীর কত দিনের ডায়াবেটিস,তার বয়স,লিঙ্গ,দৈহিক স্থূলতা,রোগের পারিবারিক ইতিহাস,শারীরিক শ্রম,খাদ্যাভ্যাস (বিশেষত লবণ খাওয়া) অন্যান্য সংশ্লিষ্ট রোগের উপস্থিতি,বর্ণ,ওষুধ সেবন ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল।
বস্তুত যারা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ দুটিতেই আক্রান্ত তাদের হৃদরোগ,স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে,কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া,চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং সর্বোপরি মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।বিপুলসংখ্যক ডায়াবেটিস রোগী এ দলভুক্ত।একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য উচ্চ রক্তচাপ বলতে ১৪০/৯০ মি.মি পারদ।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা.শাহজাদা সেলিম।
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ পরস্পর সম্পর্কিত কোনো সমস্যা নাকি স্বতন্ত্র স্বাস্থ্য সমস্যা।অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীর উচ্চ রক্তচাপ একটি আলাদা শারীরিক সমস্যা।বিশেষত যারা উচ্চ রক্তচাপ থাকা অবস্থাতেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।২০০৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে,যুক্তরাষ্ট্রর ২০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিস রোগীর ৭৩ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছিল।বাংলাদেশি ডায়াবেটিস রোগীদের মাঝে উচ্চ রক্তচাপে ভোগার হার সুনিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এটি যে অনেক বেশি হবে তা অনুমান করা যায়।
ডায়াবেটিস শরীরের সব অংশেই হানা দেয়।এতে স্বল্পস্থায়ী এবং দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন রকম ক্ষতি সাধিত হতে থাকে।সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় হৃদপিণ্ড ও রক্তনালিসহ রক্ত সংবহনতন্ত্রের সব অংশ।রক্ত নালির দেয়ালের ইলাস্টিসিটি হ্রাস পেতে থাকে।এতে হৃদরোগের ঝুঁকি যেমন বাড়ে তেমনি উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।ডায়াবেটিস না থাকলে এ ঝুঁকি অনেক কম থাকতে পারত।
ডায়াবেটিস রোগীর মস্তিষ্ক,হৃৎপিণ্ড,বৃক্ক,রেটিনা,প্রজনন তন্ত্র,ত্বক অতি ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা।যেসব মহিলা ডায়াবেটিস নিয়েই গর্ভধারণ করেন অথবা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞও প্রসূতিবিদ যেমন খুবই সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চান তেমনি গর্ভবতী ও তার পরিবারকেও গভীরভাবে অনুধাবন করে চিকিৎসায় অংশগ্রহণ করতে হবে।কেননা,এসব গর্ভবতী নারীর প্রি-একলামশিয়া ও একলামশিয়া নামক মারাত্মক গর্ভকালীন জটিলতায় ভোগার ঝুঁকি অনেক বেশি।
উচ্চ রক্তচাপ প্রধানত একটি লক্ষণ বিহীন স্বাস্থ্য সমস্যা।তাই অন্য মানুষদের মতই ডায়াবেটিসেও রক্ত চাপ মেপে তা শনাক্ত করার চেষ্টা করতে হবে।যাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকছে তাদেরও বছরে কমপক্ষে চারবার আদর্শ পদ্ধতিতে রক্তচাপ মেপে তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভোগছেন কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।যদি সিদ্ধান্ত না নেয়া যায় পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতি দিনের বিভিন্ন সময়ের রক্তচাপের গড় হিসেব করে সিদ্ধান্ত নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।আর ডায়াবেটিসের রোগীরা যখন নিয়মিত ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের কাছে যান তখন তিনি সব ডায়াবেটিসের রোগীকেই রক্তচাপ মেপে রোগ শনাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
ডায়াবেটিস এখন মহামারী আকারে বিরাজ করছে।উচ্চ রক্তচাপ পৃথিবী ব্যাপী একটি নীরব ঘাতক এবং দুটোই বর্তমানের চেয়ে রোগীর জন্য ভবিষ্যতে বেশি ঝুঁকি তৈরি করে।অতএব,রোগীর চিকিৎসা তো করতে হবেই বরং রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যতটা বেশি উদ্যোগ নেয়া যায় ততটা লাভজনক হবে।ডায়াবেটিসের সব রোগীর সব অবস্থাতেই প্রথম ও প্রধানতম কাজ হল – কাক্সিক্ষত মাত্রায় রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ।যদিও এটি রোগীভেদে বিভিন্ন রকম হবে। আর উচ্চ রক্তচাপকে বিবেচনায় নিয়ে নিন্মোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে :
-নিয়মিত রক্তচাপের রের্কড সংগ্রহ করুন
-উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করা
-যাদের এখনও রক্তচাপ স্বাভাবিক আছে সেসব ডায়াবেটিসের রোগীর জন্য আনন্দের বার্তা হল – সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আপনি দীর্ঘদিন রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সমর্থ হবেন।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ
-লবণ খাওয়া কমাতে হবে [আলগা লবণ বর্জন করুন,তরকারি-ভাজি-ভর্তাতে লবণ সীমিত করুন,অতিরিক্ত লবণ দেয়া খাদ্য বর্জন করুন (সল্টেট বিস্কুট, ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার ইত্যাদি)]
-দৈহিক উচ্চতা অনুসারে কাক্সিক্ষত দৈহিক ওজন অর্জন করুন ও বজায় রাখুন
-শারীরিক শ্রমময় জীবনযাপন করুন।যাদের জীবনযাপন প্রধানত শারীরিক শ্রমহীন,তাদের শারীরিক শ্রম বৃদ্ধির প্রয়াশ নিতে হবে
-সপ্তাহের অধিকাংশ দিন (পারলে প্রতিদিন) ৩০ মিনিট করে হাঁটুন।যাদের পক্ষে তা সম্ভব নয় তারা সপ্তাহে ১ দিন একটানা ১৫০ মিনিট হাঁটতে পারেন।
-অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাদ্য,প্রাণিজ চর্বি জাতীয় খাদ্য সীমিত করুন।
-প্রচুর শাক-সবজি (আলু বাদে) খাওয়ার অভ্যাস করুন
-তাজা ফল-মূল খাবেন (কলা,আম ইত্যাদি যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো)
-মাছ খুব ভালো খাদ্য
-মাংস খাওয়া যাবে তবে তা চর্র্বিমুক্ত হলে ভালো
-রান্নায় তেল ব্যবহার যতটা সম্ভব কমাতে হবে
চিকিৎসার ক্ষেত্রে লাইফস্টাইলের অপটিমাইজেশন মূল ভিত্তি।