অতিমানবীয় কিংবা নাটকীয় কিছু না ঘটলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নিলে এবং উদ্ভূত নির্বাচনি রসায়ন, সব ধরনের উপাদান, আলামত ও হিসাব-নিকাশও তা-ই বলছে। তবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পর গঠন হতে যাওয়া দ্বাদশ সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে কারা বসতে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত নয়। জাতীয় পার্টি (জাপা) বর্তমান একাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দল হলেও নতুন সংসদে এক্ষেত্রে চমক দেখা যেতে পারে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন রয়েছে।
সংরক্ষিত চারটিসহ মোট ২৬টি আসন নিয়ে বর্তমান সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে রয়েছে জাপা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপরীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন থাকায় স্বাভাবিক নিয়মেই জাপা প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তবে, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাপা কতটি আসন পাবে, কিংবা কতটি আসনে জয়ী হতে পারবে—তা নিয়ে খোদ জাপার ভেতরেই নানা কথা চাউর রয়েছে। জাপার বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে কান পাতলে ভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে।
জাপার দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন-সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করেছে জাপা। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন-সমঝোতায় ২২টি আসনে ‘লাঙ্গল’ প্রতীকে জয়ী হয়েছিলেন জাপার প্রার্থীরা। তবে এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার আসন-সমঝোতা হবে কি না, হলেও জাপাকে কতটি আসনে ছাড় দেওয়া হবে—তা নিয়ে বিভিন্ন সূত্র নানা আভাস দিচ্ছে। বেশির ভাগ সূত্রের আভাসমতে, বর্তমান সংসদের তুলনায় পরবর্তী সংসদে জাপার আসন সংখ্যা অর্ধেক কিংবা এর কিছু কমবেশি হতে পারে। আসন্ন নির্বাচনে আসন নিয়ে জাপার দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা সম্পর্কে খোঁজ নিয়েও প্রায় অভিন্ন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে এবার জাপার আসন সমঝোতার বিষয়টি এখন পর্যন্ত যেমন ধোঁয়াশায় ঢাকা, তেমনি জাপার ভেতরের বিভক্তি সেই ধোঁয়াশা অবস্থাকে আরো গাঢ় করে তুলেছে। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, নাকি দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপা নতুন সংসদে যাবে—তা-ও এখনো নিশ্চিত নয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত আসন-সমঝোতা হলেও সেটি জি এম কাদের নাকি রওশনের সঙ্গে হবে, তা নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। এমনও শোনা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে এবার আসন-সমঝোতা হলেও সেটি জি এম কাদের ও রওশনের সঙ্গে পৃথকভাবে হতে পারে। আবার রওশন বা জি এম কাদের কারো সঙ্গেই না হয়ে জাপার কোনো কোনো সম্ভাব্য এমপির সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবেও হওয়ার সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে।
নানা নাটকীয়তা শেষে বুধবার জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আমরা এবার কারো সঙ্গে আসন সমঝোতার চিন্তা করছি না। ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ পরদিন, বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ‘জাপা ৩০০ আসনেই নিজস্ব প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করবে। কারণ, কোনো জোটে যেতে আমরা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিইনি। রাজনীতিতে বিভিন্ন কৌশল থাকে। আমরা আমাদের নিজস্ব কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাব।’
নতুন সংসদে জাপার সম্ভাব্য আসন সংখ্যা নিয়ে এরকম জল্পনাকল্পনার মধ্যেই বিভিন্ন সূত্রের দাবি, দ্বাদশ সংসদে জাপার বদলে অন্য কোনো দলকে এককভাবে কিংবা নতুন কোনো জোটকে সম্মিলিত প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দেখা যেতে পারে। সূত্রের দাবি, জাপার পরিবর্তে এককভাবে কোনো রাজনৈতিক দল প্রধান বিরোধী দল হলে সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশি সম্প্রতি আলোচনায় আসা ‘তৃণমূল বিএনপি’র। বিভিন্ন মহলেও পরবর্তী সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূল বিএনপির নাম উচ্চারিত হচ্ছে।
বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল বিএনপি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত। দলটির নির্বাচনি প্রতীক ‘সোনালী আঁশ’। দলটির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার ১৯ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা জোটবদ্ধভাবে ৩০০ আসনেই নির্বাচন করব, অনেক দল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। শক্তিশালী জোট গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সরকার গঠন করব। আর যদি না-ও পারি, তবে আগামীতে আমরা হব দেশের প্রধান বিরোধী দল।’
তৃণমূল বিএনপি এরই মধ্যে জোটবদ্ধ হয়েছে ১৫টি ইসলামী, বাম ও উদারপন্থি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত ‘প্রগতিশীল ইসলামী জোট’-এর সঙ্গে। প্রগতিশীল ইসলামী জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করবে বলে ইসিকেও চিঠি দিয়ে জানিয়েছে তৃণমূল বিএনপি। জানা গেছে, সমমনা পুরোনো একাধিক জোট ও নতুন কয়েকটি দলকে নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের লক্ষ্যে গত কয়েক দিন ধরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছেন তৃণমূল বিএনপি ও প্রগতিশীল ইসলামী জোটের শীর্ষ নেতৃত্ব। ইসিতে নতুন নিবন্ধন পেয়ে আলোচনায় আসা বিএনএম এবং বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদ্য বহিষ্কৃত সদস্য আহসান হাবীবের নেতৃত্বে সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করা ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ও শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর এই জোটে ভিড়ে যেতে পারে। সূত্রের দাবি, বৃহত্তর এই জোট গঠিত হলে দ্বাদশ সংসদে তারা বসতে পারে প্রধান বিরোধী দলের আসনে।
তৃণমূল বিএনপির জোট শরিক প্রগতিশীল ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য লায়ন এম এ আউয়াল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা একটি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা করছি। অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা চলছে। আশা করছি খুব শিগিগরই এ ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, জোটবদ্ধভাবে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। স্বাভাবিক কারণেই আমরা চাইব জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যেন সরকার গঠন করতে পারি। আর সরকার গঠন করতে না পারলেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন নিয়ে দ্বাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসতে পারা আমাদের বিকল্প প্রত্যাশা। আশা করছি, সবকিছু ঠিক থাকলে দেশের জনগণ একটা চমক দেখতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘জোট হবে বিভিন্নভাবে। কার সঙ্গে কার জোট হবে, কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল। জোট হতেও পারে নির্বাচনের আগে, সময় আছে। এমনও হতে পারে আপনিও ভাবছেন না, আমিও ভাবছি না। কিন্তু কার সঙ্গে কার জোট হয়, কেউ ভাবতে পারে না।’
প্রসঙ্গত, সংসদে বিরোধী দল কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে দেশের সংবিধানে কিছু বলা নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার সংসদের স্পিকারের। সংসদের কর্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট)- তে বলা বলা হয়েছে, “‘বিরোধীদলীয় নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা।’’
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার গঠন করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকতে হবে, এটা সংবিধানে বলা আছে। যে দল রাষ্ট্রপতির কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে প্রতীয়মান হবে, সেই দলের নেতাকে উনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। আর সংবিধানে অনাস্থা ভোটের বিষয়ে বলা হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলা নেই। তবে, প্রথা বা রেওয়াজ হচ্ছে—সরকারি দলের পর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দলই বিরোধী দল হবে এবং সেই দলের নেতা বিরোধী দলের নেতা হবেন। সেখানে তাদের কতটি আসন থাকতে হবে, এরকম কোনো বিষয় নেই।
তবে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছিল ২৯৩টি আসন। আর বিরোধী ছোট ছোট কয়েকটি দল মিলে পেয়েছিল বাকি সাতটি আসন। সেসময় এসব দল যৌথভাবে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খানকে তাদের নেতা উল্লেখ করে বিরোধী দলের নেতার মর্যাদা দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন জানান। তবে তত্কালীন সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে একটি রাজনৈতিক দলের অবশ্যই কমপক্ষে ২৫টি আসন থাকতে হবে। নাহলে তাদেরকে পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসেবে বলা যেতে পারে, কিন্তু বিরোধী দল নয়। এখনো সেই ধারাটিই অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।