দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ানোই অন্যতম চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর ভোট বর্জন ও আন্দোলনের মুখে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করাই এখন মূল ভাবনা সংস্থাটির। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটারদের উপস্থিতি ও ভোটের হার নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাদের। নির্বাচনে কত ভাগ ভোট পড়ল তার চেয়ে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই লক্ষ্য তাদের।
ইসি সূত্র জানায়, কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়িয়ে নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করতে চায় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না এলে ভোটারদের আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিরোধী দলের বর্জনে ভোটের পরিবেশ সহিংস হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এসব আশঙ্কা থেকে জনগণকে মুক্ত করে তাদের ভোট কেন্দ্রমুখী করাটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে কমিশনের জন্য। সেজন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে চায় সংস্থাটি। তারা মনে করছে, রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত ও নির্বাচনকে সহিংসতামুক্ত রাখা গেলে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে। সেই লক্ষ্য অর্জনে মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চার জন নির্বাচন কমিশনার ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ সফর করে বিভাগীয়, আঞ্চলিক ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। ডিসি-এসপিদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় কমিশনার মো. আলমগীর প্রশাসন, ‘পুলিশ ও ইসির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনে ভোট কম পড়লেও সমস্যা নেই। তবে ভোটকেন্দ্রে গণ্ডগোল ও অনিয়ম যেন না হয়। আইন ও বিধি মোতাবেক ভোটগ্রহণ করার দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপিসহ সমমনাবিরোধী দলগুলোর চলমান আন্দোলন মোকাবিলা; অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান; নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বড় অংশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এড়ানো; ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো; ভোটের হার বৃদ্ধি; সবার জন্য লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম ঠেকানোসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এর মধ্যে ভোটের হার বাড়ানোই অন্যতম চ্যালেঞ্জ সংস্থাটির। যদিও বিষয়টিকে সামনে আনতে চাইছে না কমিশন। সরকারেরও একই মনোভাব। তাদের মতে, কোন দল এলো বা না এলো সেটা বড় কথা নয়। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছে কি না সেটাই বড় বিষয়। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আমাদের দেশে যদি এক শতাংশ ভোট পড়ে, ৯৯ শতাংশ না পড়ে, তাহলে লিগ্যালি নির্বাচন সঠিক। প্রশ্ন উঠবে লেজিটিমেসি নিয়ে, লিগ্যালিটি নিয়ে নয়। কাজেই লিগ্যালিটি এবং লেজিটিমেসি নিয়ে কনফ্লিক্ট আছে।’ নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান একই মনোভাব ব্যক্ত করে বুধবার কুমিল্লায় বিভাগীয় সফরে বলেছেন, ‘কত শতাংশ ভোট পড়েছে আমার সেটা দেখব না। নির্বাচন নির্বাচনের গতিতে চলবে। সংবিধানে কোথাও লেখা নেই কত ভোট কাস্ট হতে হবে।’
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই, বরং পুরোপুরি উৎসবের মেজাজে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে—এক ব্রিফিংয়ে ৯০টি রাষ্ট্রকে এমন কথাই আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল দিল্লিতে এ ব্রিফ করেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই ভোট বিমুখ হওয়া শুরু হয় নাগরিকদের। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধীদের বর্জনের মুখে ঐ বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। যা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনে সরাসরি ভোট হওয়া ১৪৭টি আসনে ৪০ ভাগেরও কম ভোট পড়েছিল। ঢাকায় পড়েছিল ২২ শতাংশ। ৩০০ আসনকে হিসাবে আনলে এই হার অর্ধেকে নেমে আসবে। এরপর ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে বিভিন্ন এলাকায় ভোট হয়ে যাওয়ার কথা উঠে আসে বিভিন্ন মাধ্যমে। জাতীয় সংসদ ছাড়াও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা যায়। বিরোধীদের বর্জনের মুখে সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শন এবং অনেক জায়গায় ফলাফলে প্রভাব বিস্তারের কারণে দিন দিন আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে ভোটারদের মধ্যে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছেন নাগরিকরা। সরকারবিরোধীদের বর্জন, একতরফা নির্বাচন, দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী, সহিংসতা, ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার ও ফলাফলে আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছেন ভোটাররা। সাম্প্রতিক সময়ের সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন উপনির্বাচনে এমন চিত্র দেখা যায়। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয় আসনে গড়ে ভোট পড়ে ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা ১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎসবমুখর ভোটের জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকা আবশ্যক। পছন্দের দল এবং শক্ত প্রার্থী থাকলে ভোটাররাও আগ্রহ নিয়ে ভোট দিতে আসেন। সেজন্য ভোটের হার বাড়াতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন।