গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং গত ১৪ জুলাই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার সরকার থেকে রাজাপক্ষে ভাইদের বিদায় নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি দেশটির আন্দোলনকারী জনতার জন্য যে খুব একটা সুখকর হয়নি এর প্রমাণ রনিল বিক্রমাসিংহের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া। আন্দোলনকারী জনতা রাজাপক্ষেদের ক্ষমতার বাইরে দেখতে যেমন মরিয়া হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ঠিক একইভাবে তারা রনিলের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটির শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে না। আর এই কারণে তারা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে যখন নতুন করে তাদের সরকারবিরোধী কর্মসূচি শুরু করে, আমরা দেখতে পেলাম সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং কমান্ডোদের যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে তাদের রাজপথ থেকে বিতাড়িত করা হলো।
এর আগে থেকেই এমনটা হবে বুঝতে পেরে নির্বাচিত হওয়ার পরপরই নতুন প্রেসিডেন্ট দেশের সব মানুষকে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পরামর্শ দিয়েছেন। এর অন্যথা হলে কঠোরভাবে সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আর তা হচ্ছে, এর আগে মাহিন্দা এবং গোতাবায়ার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন কর্মসূচিতে সেনাবাহিনীর দিক থেকে সাধারণ জনগণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়নি। এর মানে এই নয় যে তারা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার নির্দেশ পায়নি, বরং তাদের তরফ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় সরকারবিরোধী জনতার কর্মসূচিতে তারা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না।
এখন কথা হচ্ছে, গোতাবায়ার পতনের পর নতুন প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করতে সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যে ভূমিকা পালন করছে, এটা আসলে কী বার্তা বহন করছে? এখানে বিষয়টিকে আমরা কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিশ্লেষণ করতে পারি। এর আগে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে চলমান দেশটির তামিল বিদ্রোহ দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সদ্য পদত্যাগকারী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া তখন ছিলেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এই বিদ্রোহ দমনে মূল কৃতিত্ব এই দুই রাজাপক্ষে ভাইদের দেওয়া হলেও এর নেপথ্য কারিগর ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শরৎ ফনসেকা। বলা যায়, সরকারের প্রতি আনুকূল্যের চেয়েও এক ধরনের রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে তিনি মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে তাঁর সেনাবাহিনীকে এই তামিল বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেন, ফলে বিদ্রোহ দমনকালে তামিল নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণসহ প্রধান তামিল বিদ্রোহীরা যেমন সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন, তেমনি অনেক নিরীহ তামিল এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। জাতিসংঘের তরফ থেকে বলা হয়েছে, চূড়ান্তভাবে তামিল বিদ্রোহ দমনকালে কমপক্ষে ৪০ হাজার বেসামরিক তামিলকে হত্যা করা হয়। এই বিদ্রোহ দমন পরবর্তী সময়ে জেনারেল শরৎ ফনসেকা সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দিলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়। অন্যদিকে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে রাজাপক্ষে পরিবার যেভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে প্রয়াসী হয়, এই বিষয়টি সেনাবাহিনী যে খুব ভালোভাবে নিয়েছে সেটি ভাবার কারণ নেই। বলা যায়, যদিও শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনী কখনো সেভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেনি, তবে তাদের ইমেজ যে রাজাপক্ষেদের দ্বারা অনেকটা আন্তর্জাতিকভাবে মলিন হয়েছে এই বিষয়টা তাদের ভালো লাগেনি। বলা যায়, রাজাপক্ষেদের রক্ষার বিষয়ে তারা সেভাবে কাজ না করলেও নতুন প্রেসিডেন্টকে যে তারা রক্ষা করতে চাইছে, সেটাও নয়, বরং তারা তাদের নিজেদের ইমেজ রক্ষার স্বার্থে এবং একই সঙ্গে দেশকে কিভাবে বর্তমান আর্থিক দৈন্যদশা থেকে টেনে তোলা যায় সেই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর, যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং হচ্ছেন দেশটির রাজনীতিবিদরা।
দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা এবং নতুন প্রেসিডেন্টকে মেনে নেওয়া আন্দোলনকারী মানুষের জন্য বেশ কষ্টকর। এখানে আমরা সবাই জানি যে এই রনিল বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে গত ৫০ বছর ধরে দাপিয়ে বেড়ালেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি কার্যত একজন জনবিচ্ছিন্ন নেতা হিসেবে পরিচিত। ভারতপন্থী হিসেবে তিনি শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেও তামিল বিদ্রোহ দমনোত্তর সময়ে চীনপন্থী রাজাপক্ষেদের রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে তিনি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েন। মাঝে এক মেয়াদে মাইথ্রিপালা সিরিসেনা মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে পরাজিত করে (২০১৫ সালে) শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে রনিলের ইউনাইটেড ন্যাশনালিস্ট পার্টি (ইউএনপি) পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং রনিল দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ওই সময় বর্তমান বিরোধী দলনেতা সাজিথ প্রেমাদাসা ইউএনপি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০২০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে সাজিথ প্রেমাদাসা ইউএনপি থেকে বেরিয়ে গেলে দেখা যায় জনসমর্থনের পাল্লাটা সাজিথ প্রেমাদাসার দিকেই বেশি ভারী। এর কারণ হিসেবে রনিলের ক্ষমতার মোহে যখন-তখন যে কারো সঙ্গে আপসকামিতাকেই দেখছেন অনেকে।
শ্রীলঙ্কার বিগত নির্বাচনটিও আমাদের আজকের শ্রীলঙ্কার অবস্থা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ক্যান্ডি বুদ্ধ মন্দিরসহ কিছু জায়গায় যে সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়, মূলত এটির ওপর ভর করে গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সহজেই নির্বাচিত হয়ে আসেন। এই হামলার নেপথ্যে ছিল আইএসের সহযোগিতায় দেশটির কিছু উগ্র মুসলিমপন্থী গ্রুপ, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী দ্বারা দীর্ঘ সময় ধরে বৈষম্যের স্বীকার বলে দাবি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে তামিলদের সঙ্গে সিংহলীদের ঐতিহাসিক দূরত্ব। এই সব কিছুকে পুঁজি করে মাহিন্দা এবং গোতাবায়া রাজাপক্ষেরা সহজেই মানুষের মনকে জয় করে নেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের মনে এই ধারণাই কাজ করে যে তামিল বিদ্রোহ দমন করে রাজাপক্ষে পরিবার কার্যত শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সিংহলীদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেটিকে অব্যাহত রাখতে গেলে তাদের রাজাপক্ষেদেরই দরকার। অন্যদিকে সাজিথ প্রেমাদাসার সমর্থনের মূল জায়গা ছিল তামিল এবং দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মুসলিমদের মধ্যে। এভাবে রাজাপক্ষেদের নির্বাচিত হয়ে আসার মধ্য দিয়ে আসলে শ্রীলঙ্কার গোটা রাজনীতি ত্রিধাবিভক্ত হয়ে ওঠে।
রাজনীতির এহেন ধোঁয়াশার মধ্যে অনেকটাই নিজের ঠিকানা হারিয়ে রনিল আশ্রয় খুঁজে পান রাজাপক্ষেদের মাঝে। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোট প্রাপ্ত ভোটের হিসাব-নিকাশের কোটায় তিনি এমপি হিসেবে আসেন। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার ক্ষেত্রে রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে সব বিরোধী দল, এমনকি ক্ষমতাসীন এসএলপিপির অনেক পার্লামেন্ট সদস্য যখন দেশবাসীর সঙ্গে প্রতিবাদে সরব, সেই সময় রনিলকেই দেখা গেল একমাত্র রাজাপক্ষে পরিবারের প্রতি আস্থাভাজন থাকতে। মাহিন্দা রাজাপক্ষের পতনের পর তাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে রনিলের ওপর আস্থা রেখে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি আপাত সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেই রনিলের ওপরই আস্থা রেখে তিনি দেশত্যাগ করলেন এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর দলের সমর্থনে পার্লামেন্টে জনগণের দিক থেকে সবচেয়ে কম সমর্থন পাওয়া রনিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়াকে প্রকারান্তরে রনিলের ভেতর রাজাপক্ষেদেরই দেখতে পাচ্ছে জনগণ।
এখন আসা যাক শ্রীলঙ্কাকে বর্তমান এই দুরবস্থা থেকে টেনে তুলতে কতটুকু সক্ষম হতে পারবেন রনিল এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায়। শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার। দেশটির মোট জনসংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ, সেই হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৬৫০ ডলার। এখন কথা হচ্ছে, কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগুলো কেন একক বা যৌথভাবে শ্রীলঙ্কাকে এই ঋণের জাল থেকে উদ্ধার করবে, বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কথাই এখানে আসে। আর যখন এই ঋণজালের মূল উৎস চীন সে ক্ষেত্রে সংগত কারণেই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চীনা ঋণের ফাঁদে পড়া শ্রীলঙ্কাকে উদ্ধার করতে আসবে না। এ ক্ষেত্রে ভারত এককভাবে চেষ্টা করেছে এবং করছে, তবে তারাও কতটা এই পরিস্থিতিতে পেরে উঠবে, সেটা সন্দেহ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে গোতাবায়ার একটা কৌশল হিসেবে এখানে রনিলকে টেনে আনা, যাতে ভারতের দিক থেকে সহায়তার দিকটি নিশ্চিত করা যায়, যা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। ভারত এ পর্যন্ত তাদের ক্রেডিট লাইন থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণের বাইরেও আরো ৫০০ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি সরবরাহ করে শ্রীলঙ্কাকে যে সহায়তা করেছে, তা অনন্য। রনিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাই তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অব্যাহত সহায়তা কামনা করেছেন, যার বিশেষ ইঙ্গিত রয়েছে।
যে রাজনৈতিক সংকট শ্রীলঙ্কাকে ঘিরে আছে তা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোকেই ঠিক করতে হবে যে তারা এই মুহূর্তে কোন ধরনের রাজনীতি করবে, ক্ষমতা দখলের, নাকি দেশকে এই দুরবস্থা থেকে টেনে তোলার। আর এ ক্ষেত্রে যদি তারা ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারে, তাহলে কিন্তু কোনো দেশই তাদের এই সংকট থেকে পার পেতে সাহায্য করতে আসবে না। ধরে নিলাম রনিলকে শ্রীলঙ্কার কেউই পছন্দ করছে না, কিন্তু সাংবিধানিক উপায়ে এই মুহূর্তে নতুন করে নির্বাচন দিয়ে নতুন নেতৃত্ব আনার সুযোগ সীমিত। দাতারাও চাইছে নতুন করে ঋণ আলোচনার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার সহায়তায় এগিয়ে আসতে, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি রনিলকে নিয়েও এগোতে পারে তাহলে ভালো, তবে বিষয়টি খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।