ঢাকা বিভাগীয় বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক পদটি শূন্য আছে। এই পদ পেতে আগ্রহী নিপুন রায় চৌধুরী, শাহজাহান মিয়া সম্রাট, সাইয়্যিদুল ইসলাম বাবুল ও মুজিবুর রহমান। এটি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির একটি শূন্য পদ পেতে ‘লড়াইয়ের’ খণ্ডচিত্র।
একইভাবে দলের কেন্দ্রীয় অন্তত ৭০টি শূন্য পদ পেতে বিভিন্ন স্থানে তদবির করছেন কয়েক শ নেতা।
এই দৌড়ে কেন্দ্রীয় থেকে জেলা পর্যায়ের নেতারাও আছেন। একই চিত্র দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও। সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ একটি পদের বিপরীতে চারজন থেকে এক ডজন নেতা তদবির করছেন। এর বাইরে কেন্দ্রীয় পদে থেকেও জেলার পদ ‘দখল’ করে রেখেছেন অনেক নেতা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইশরাক হোসেনের মতো রাজনীতিতে একেবারে নবীন নেতা ঢাকা মহানগর দক্ষিণের শীর্ষ পদ ছাড়া অন্য পদ নিতে চাইছেন না। মীর হেলাল রাজনীতির মাঠে তরুণ। তিনি একাধারে নির্বাহী কমিটির সদস্য, দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য এবং সদ্য গঠিত দলের মিডিয়া সেলেরও সদস্য। এর পরও দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে মরিয়া।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অব্যাহতি, বহিষ্কার, মৃত্যু, দলত্যাগসহ নানা কারণে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ৭০টির বেশি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য আছে। সাধারণত কাউন্সিলে নেতাদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিএনপির গঠনতন্ত্রে তিন বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বিধান থাকলেও ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ সর্বশেষ কাউন্সিল করেছে বিএনপি। নানা কারণে শিগগিরই কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাঁর ক্ষমতাবলে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শূন্য পদ পূরণ করেছেন। একই প্রক্রিয়ায় অন্য শূন্য পদও পূরণ হতে পারে বলে গুঞ্জন আছে। কিছু পদবিন্যাস কিংবা সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে।
তবে বেশির ভাগ নেতাই তাঁর যোগ্যতা, সামর্থ্য ও রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় না এনে ‘বড়’ পদ ‘আবদার’ করছেন—এমন মন্তব্য দলটির নীতিনির্ধারকদের। দলের সর্বস্তরের নেতাদের পদ পাওয়ার চেষ্টার কারণে দলে কিছুটা উপদলেরও সৃষ্টি হয়েছে। কারণ কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ নেতারা তাঁদের অনুসারীদের পদ দিয়ে নিজের পাল্লা ভারী করতে চাইছেন।
জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বিএনপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। এটি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম। ১৯ সদস্যের এই ফোরামের পাঁচটি পদ শূন্য আছে। এই পাঁচ পদে আসতে এক ডজন নেতা আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সাবেক ছাত্রদল নেতা আছেন।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এই পদে আসতে পারেন ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আব্দুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মোহাম্মদ শাহজাহান, বরকতউল্লা বুলু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনের মধ্যে যে কেউ।
সাবেক ছাত্র নেতাদের আরো কয়েকজন আছেন যাঁরা তারুণ্যনির্ভর বিএনপি গড়ে তোলার পক্ষে কথা বলে স্থায়ী কমিটিতে পদ পেতে চান। তাঁদের দাবি, মওদুদ আহমদসহ অনেক নেতাই ৪০ বছর বয়সের পরপরই স্থায়ী কমিটির পদ পেয়েছেন। তাহলে তাঁদের ক্ষেত্রে নয় কেন?
ঢাকা বিভাগীয় বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক পদের অন্যতম দাবিদার হলেন নিপুন রায় চৌধুরী। তিনি কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানা বিএনপির সভাপতি। ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদেও তাঁর আগ্রহ আছে। সম্প্রতি তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসা দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, দুই পদের একটি নিপুন পাচ্ছেন, এটি ধারণা করা যায়।
শাহজাহান মিয়া সম্রাট ছাত্ররাজনীতির পর দীর্ঘদিন কৃষক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কেন সহসাংগঠনিক পদের জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করেন, জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে সম্রাট বলেন, ৪২ বছর বিএনপি করছেন। দলের সঙ্গে বেঈমানী করেননি। ১৯৯০ সালে ছাত্র আন্দোলনের রাজপথে ছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনেও মাঠ ছাড়েননি। কেন্দ্রীয় ও ঢাকা জেলার রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর জানাশোনাও বেশ ভালো।
সাইয়্যিদুল ইসলাম বাবুল গাজীপুর জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক। জেলা সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়ে ভোটে পরাজিত হন তিনি। কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান। তাঁর নির্বাচনী এলাকার মধ্যে কাশিমপুর কারাগার। বিভিন্ন মামলায় কারাগারে যাওয়া দলের নেতাদের ‘সেবা’ দিয়ে মন জয় করে এখন কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে চাইছেন।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্যসচিব। গত কাউন্সিলে তাঁর যুগ্ম মহাসচিব না হওয়াটা বিব্রতকর ছিল। কারণ, রাজনীতিতে তাঁর জুনিয়র নেতাও যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন হলে তিনি যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন।
যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হতে চান। তাঁর ঘনিষ্ঠদের যুক্তি, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বরকতউল্লা বুলু ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুবদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন। তাহলে নীরব কেন নয়?
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ময়মনসিংহ বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। যুগ্ম মহাসচিব পদের পাশাপাশি দলের দপ্তর সম্পাদক পদেও তাঁর দৃষ্টি বেশি। রিজভী আহমেদের অনুপস্থিতিতে কয়েকবার তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
প্রিন্স কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের জন্য কাজ করছি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যখন যে দায়িত্ব দেবেন, তা সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সততার সঙ্গে পালন করব। ’
যুগ্ম মহাসচিব পদে আগ্রহ আছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবে রহমান শামীমেরও।
ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ দলের ছাত্র সম্পাদক কিংবা স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ পদে আসতে লড়াই করছেন। সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, ওবায়দুল হক নাসির, রাজীব আহসানসহ ডজনখানেক নেতা স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ পদে আসার লড়াইয়ে আছেন। দল চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তরের শীর্ষ পদে থেকে আন্দোলনের মাঠে থাকতে চান এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন। ঢাকা মহানগর উত্তরের শীর্ষ পদে আসতে কেন্দ্রীয় ও মহানগরের অন্তত ১০ জন নেতা আগ্রহ দেখিয়ে মাঠে সক্রিয় আছেন।
বিএনপির ৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের ১১টি পদই ফাঁকা। এসব পদে আসতে অন্তত ৩০ জন নেতা নানাভাবে চেষ্টা করছেন। অর্ধশতাধিক সম্পাদকীয় ও নির্বাহী সদস্যপদ পূরণেও পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। কোষাধ্যক্ষ, আইন সম্পাদক, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পাদক পদ খালি রয়েছে। এসব ছাড়াও গবেষণা, যুব, ছাত্র, আন্তর্জাতিক, ধর্ম, পল্লী উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সম্পাদক এবং অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, গ্রাম, ছাত্র, স্বাস্থ্য, পল্লী উন্নয়নসহ সম্পাদক পদও শূন্য। সাবেক ছাত্র ও যুবদল নেতারা এসব পদে আসতে নানাভাবে তদবির করছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকলে দলে গতিশীলতা থাকে। একই পদ পেতে একাধিক নেতার চাওয়া মানেই কোন্দল নয়। যে কেউ পদ চাইতে পারেন। ’