যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতি উদযাপন করল মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবস একদিকে আনন্দের, গৌরবে উদ্দীপ্ত হওয়ার দিন, অপরদিকে শহিদদের রক্তের বিনিময়ে এ বিজয় লাখো শহিদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া। গতকাল শনিবার মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৫২তম বার্ষিকীতে সমগ্র জাতি বীর সন্তানদের স্মরণ করে, যাদের রক্তের বিনিময়ে দুই যুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটেছিল এবং বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।
বিজয়ের এই দিনে বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষরা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে উত্খাত, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিসহ সব ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ রুখে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে দিবসটি উদ্যাপিত হয়েছে।
বিজয় দিবসে সাভারে গতকাল শনিবার লাখো মানুষের স্রোত গিয়ে মিশেছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সমবেত হয়। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জীবিত জাতি দিবসটি উদযাপন করে অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে। বুকের রক্ত ঢেলে যারা বাংলাদেশের জন্য বিজয় এনেছিল তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে তারা। স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। শীত উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষ ভোর থেকেই সাভারে স্মৃতিসৌধের বাইরে ও আশপাশের মহাসড়ক এলাকা এবং ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সমবেত হতে থাকে।
ভোরের সূর্য ওঠার আগেই হাতে ফুল, মাথায় বিজয় দিবস লেখা ব্যান্ড, জাতীয় পতাকা নিয়ে স্মৃতিসৌধে নেমেছিল জনতার ঢল। বিনম্র চিত্তে সমগ্র জাতি ৩০ লাখ শহিদকে আরো একবার জানিয়ে দিল ‘আমরা তোমাদের ভুলব না।’
দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়।
সকাল সাড়ে ৬টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যদিয়ে শুরু হয় শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ সময় শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পরে শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধস্থল ত্যাগ করার পর তা সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুলে দিলে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। এ সময়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, শ্রমিক আর শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা নিবেদনে ফুলে ফুলে ভরে উঠে স্মৃতিসৌধের বেদি।
শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিজয় উল্লাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সি মানুষের পদচারণায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক, নৈরাজ্যকর কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে নানা স্লোগান, দেশাত্মবোধক গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বেজে চলছিল বিরামহীনভাবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এই ঢল অব্যাহত থাকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। একে একে বেদিতে শহিদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা, বিএনপি, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানায়। এ ছাড়া আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতীলীগ, জাতীয় পার্টি-জেপি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও স্মৃতিসৌধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
এদিকে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডিন্থ ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিনি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খানের নেতৃত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সকালে রাজারবাগ স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। এতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ডিএমপির একটি চৌকশ দল গার্ড অব অনার প্রদান করে শহিদদের সম্মান জানায়।
বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সকল সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হয়। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রং-বেরঙের পতাকায় সাজানো হয়।
শহিদদের আত্মার শান্তি, জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পবিত্র কুরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
ফায়ার সার্ভিসের মহান বিজয় দিবস উদযাপন: বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। গতকাল ঢাকার মিরপুর ট্রেনিং কমপ্লেক্সে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে এবং শহিদ স্মৃতিস্তম্ভে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণে বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এছাড়া দিনব্যাপী ছিল নানা আয়োজন।
বিসিক-এর উদ্?যাপন: জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতার ম্যুরালে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে বিসিক। এছাড়া বিসিক কর্মকর্তা সমিতি ও বিসিক শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের যৌথ আয়োজনে বিসিকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিশুদের অংশগ্রহণে চিত্রাঙ্কন ও কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রম: সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা, কলাবাগানসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করে সোসাইটি। এছাড়া রাজধানীর হলিফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের উন্নতমানের খাবার বিতরণ করা হয়।
এদিকে দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বিজয় শোভাযাত্রার আয়োজন করে। শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরীর সভাপতিত্বে র্যালিপূর্ব সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন প্রমুখ।
জাতীয় পার্টি-জেপির শ্রদ্ধা: যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন করেছে জাতীয় পার্টি-জেপি। এ উপলক্ষ্যে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের নেতৃবৃন্দ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাদেক সিদ্দিকী, ভাইস চেয়ারম্যান মির হারুনুর রশিদ, যুগ্ম- মহাসচিব ও জাতীয় যুব সংহতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এনামুল ইসলাম রুবেল, যুগ্ম- মহাসচিব আমিনুল ইসলাম তপন, আলী আব্দুল্লাহ টিংকু, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল খায়ের সিদ্দিকী আবু, প্রচার সম্পাদক জীবন কৃষ্ণ বৈরাগী, যুব-বিষয়ক সম্পাদক- সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন নান্নু, মানবধিকার সম্পাদক জেপি ও জাতীয় যুব সংহতির সহসভাপতি মঞ্জুর হাবিব মঞ্জু, যুগ্ম-আইন বিষয়ক সম্পাদক- সৈয়দ নাজমুল হুদা, যুগ্ম-যুব বিষয়ক সম্পাদক কে এম এ তাহের, যুগ্ম- তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক- মো. আপেল মাহমুদ, জাতীয় যুব সংহতির সহ-সভাপতি জেড সেলিম প্রমুখ। এর আগে সকাল সাড়ে ৬টায় জেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দলের সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।