সুধীর বরণ মাঝি
শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।
শিক্ষক জাতি তৈরির কারিগড়। এটা আমরা সবাই জানি এবং সর্বজন স্বীকৃত। শিক্ষকের আদর্শ, মূল্যবোধ ও সর্বোপরি নৈতিকতা সুন্দর আগামীর প্রতিষ্ঠাতা। শিক্ষকরা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি ধারন করবেন, লালন করবেন এবং প্রজন্মের মাঝে চর্চা করবেন। তাহলেই আমরা জাতি হিসেবে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি সমৃদ্ধশালী হতে পারবো। একজন শিক্ষক উন্নত জাতি গড়তে সার্বিক ভূমিকা পালন করেন। আমরা সবাই শিক্ষকদের কম বেশি শ্রদ্ধা করি। একজন শিক্ষক ক্লাসের বাইরে গবেষণায় থাকবেন, গবেষণা করবেন কিভাবে তাঁর বিষয়টি প্রানবন্ত ও আধুনিক তথ্য নির্ভর করা যায়। তিনি গবেষণা করবেন কিভাবে জাতিকে শক্ত ভীতের উপর দাঁড় করানো যায়। তিনি গবেষণা করবেন কিভাবে শিক্ষাকে ফলপ্রসু এবং বাস্তমুখী করে তোলা যায়।
যে দেশের শিক্ষকরা যত বেশি নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষত্ব ধারন করবে, লালন করবে এবং চর্চা করবে সেই দেশ এবং জাতি ততো বেশি
জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সদাচার-দেশপ্রেমে ও ধন-সম্পদে উন্নত হবে এবং সেই দেশের নাগরিকও দেশপ্রেমিক হয়ে গড়ে উঠবে, দেশকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা যা দেখি তা খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জাজনকও বটে। প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং বাণিজ্য শিক্ষার মৌলিকত্বকে ধ্বংস করে দেয় এবং তাতে জাতির বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। আমরা দেখি কিছু শিক্ষক তাদের সর্বশ বিসর্জন দিয়ে কিছু অতিরিক্ত রোজগারের জন্য প্রাইভেট পড়ানো, ব্যাচ পড়ানো, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আবার দেখি শিক্ষকরা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছেন। আজকের দিনে খুব কম শিক্ষক আছেন, যারা ক্লাসে ছাত্রদেরকে সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে মৌলিক শিক্ষা প্রদান করেন। যারা করেন তারা সর্বজন সমাদৃত ও শ্রদ্ধেয়।
আজকাল প্রায় শুনা যায় ছাত্ররা আর শিক্ষকদেরকে আগের মতো সম্মান করে না। এর প্রধান কারণ সম্ভবত দুটি। এক. শিক্ষকরা আগের মতো
ক্লাসের প্রতি মনোযোগি নন। দুই. প্রাইভেট পড়ানো, ব্যাচ পড়ানো কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ানোর জন্য অসৎ উপায় অবলম্বন করা। শিক্ষক যদি তাঁর আদর্শ থেকে সরে গিয়ে শুধুমাত্র টাকা কামানোর চিন্তায় মগ্ন থাকেন তবে, সেই শিক্ষক জাতির জন্য যেমন ক্ষতিকর, ঠিক তেমনি সমান ক্ষতিকর নিজ পরিবার ও সমাজের জন্য।
শিক্ষকের মর্যাদা পূঃন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকসহ অন্যান্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার প্রইভেট পড়ানো ও কোচিং বন্ধ করার জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তাকে সাধুবাদ জানাই এবং তা সফল করতে হলে কোন শিক্ষককে এক জেলায় দুই বছরের বেশি চাকুরি করতে দেওয়া যাবে না। দুই বছর হলেই তার বদলীর আদেশ চলে আসবে এবং কোন কারণে তা অমান্য করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষককে প্রতিমাসে ৩পৃষ্ঠার একটি গবেষণা পত্র প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট জমা দিতে হবে। যা তাঁর এ.সি.আরের সাথে যুক্ত থাকবে। তাহলে মেধার বিকাশ ও প্রসার ঘটবে। শিক্ষকতার পেশায় মেধাবীদেরকে আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
আমার জানামতে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে কোন শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ান না বরং তাঁরা বলেন,” এটাতো ছাত্রদের কাজ, আমরা করবো কেন?” এর পিছনের কারণ হলো শিক্ষকদের জন্য রয়েছে মর্যাদা সম্পন্ন বেতন কাঠামো ও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা। আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়েছিল। জাপান সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র শিক্ষার উন্নতির মাধ্যমে। এর জন্য শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করেছিল। আমরাও চাই রাষ্ট্র ও সরকার আমাদের দেশের শিক্ষদের জন্য সর্বোচ্চ বেতন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করবেন। আমরা আরো চাই আমাদের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং বাণিজ্য থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবেন এবং শিক্ষকরা ছাত্রদের মাঝে মৌলিক শিক্ষার বিকাশ ঘটাবেন।
সরকার শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তবসম্মত সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং শিক্ষকরা হবেন এর সফল অংশীদার। এর পাশাপাশি অভিভাবকদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে বোঝাতে হবে ভালো ফলাফল যেমন জরুরী ঠিক তেমনি জরুরী ভালো মানুষ হওয়া। শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করবেন এবং ছাত্রদেরকে মৌলিক শিক্ষা দান করবেন। প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধের জন্য যেমন বাস্তবসম্মত আইন করতে হবে, ঠিক তেমনি তার প্রয়োগও করতে হবে যথাযথভাবে। আইন প্রয়োগকারীকে সকল প্রকার আত্মীয়তা ও তদবিরের উর্ধ্বে উঠতে পারলেই কেবল শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে। অন্যথায় আইন করে এর সুফল পাওয়া যাবে না। ঘটনা যেন এমন না
ঘটে, কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নাই। এর নিশ্চয়তা রাষ্ট্র ও সরকারকেই দিতে হবে জাতির বৃহত্তম স্বার্থে এবং পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র, শিক্ষক এবং অভিবাবকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিৎ করতে পারলেই তবেই বন্ধ হবে প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং বাণিজ্য। আমরা যদি আমাদের দেশের শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে চাই তবে আমাদেরকে রাজনৈতিক ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে কোন ভাবেই দেশের মেধা প্রাচার করতে দেওয়া যাবে না। এটা করতে পারলেই আমরা পাবো মেধাসম্পন্ন একটি সুসভ্য জাতি।
জিপিএ ৫ একটি ছাত্রের জন্য বহুকাঙ্কিত সাধনার ফসল এবং ছাত্র-অভিভাবকরা সবাই তা প্রত্যাশা করেন। আমরা এ রকম জিপিএ ৫ চাই না যেখানে আমরা নিজেদের মেধার মূল্যায়ন করতে পারি না। আমরা এরকম জিপিএ ৫ চাইনা যেখানে প্রজ্ঞা নেই, মূল্যায়নের যোগ্যতা নেই। আমরা জিপিএ ৫ চাই যেখানে আমরা শিক্ষতে পারি, জানতে পারি, পড়তে পারি, প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারি। আমরা এখন জিপিএ ৫ পাচ্ছি কিন্তু শিখছি না কিছুই । তার প্রতিফলন দেখতে পাই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে। আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছি। ভুগর্ভস্ত পানির স্তর যেমন দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে তেমনি আমাদের শিক্ষার মানও দিন দিন কমে যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষার পরিমাণগত পরিবর্তন অনেক বেশি। পরিমাণগত পরিবর্তন এবং গুণগত পরিবর্তনের মধ্যে যদি সমন্বয় এবং সামঞ্জস্য না থাকে তবে সে শিক্ষা কার্যকর কেন শিক্ষা না। আজকের এই অবস্থা থেকে উত্তোরণ জরুরী। তা না হলে সামনের দিনগুলোতে বিপর্যয় অনিবার্য। এই বিপর্যয় পারমানবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর। আমরা এই অবস্থা থেকে উত্তোরণ চাই। আমরা দিন দিন ক্লাস বিমূখ হয়ে পড়ছি কিন্তু কোচিং এবং প্রাইভেট নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। কোচিং এবং প্রাইভেট নির্ভর শিক্ষা শিক্ষার্থীর মনোজগতের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষার মৌলিক ধারায় আমাদেরকে ফিরে আসতে না পারলে আজকের জিপি ৫ আগামী দিনে দেশও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
শৈশব বলে এখন আমাদের আর কিছুই নাই। আছে শুধু জিপিএ ৫ পাওয়ার অসুস্থ ও অনৈতিক চর্চা, অনৈতিক প্রতিযোগিতা। শিক্ষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ক্লাসের প্রতি কিন্তু আগ্রহ বাড়ছে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর প্রতি। শিক্ষকরাও আগের মতো দরদ দিয়ে পড়ান না। শিক্ষকদেরকে পেয়ে বসেছে টাকার নেশায় আর অভিভাবকদেরকে পেয়ে বসেছে জিপিএ ৫ এর নেশায়। মাঝখানে আমাদের(ছাত্রছাত্রী) অবস্থা রসাতলে। কেউ আমাদের শারীরিক ও মানসিক দিকটি বিবেচনায় নিচ্ছেন না। আমরা দিন দিন মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি, শারীরিক যোগ্যতা এবং সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছি। আমাদের জন্য পরীক্ষার হলে সকল প্রকার সহযোগিতা বন্ধ করে দিতে হবে এবং পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও নমনীয়তা পরিহার করতে হবে। আমাদেরকে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি অভিভাবদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবদেরকে বুঝতে হবে সন্তানটি আমার। তাই কোন লোভে পা দিয়ে সন্তানের সাময়িক ভালো করলেও এর ক্ষতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। যা কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বর্তমান থাকে। কেউ যদি সহজ উপায়ে জিপি এ ৫ পাওয়ার পরামর্শ দেয়, তাহলে তাকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
আমরা জিপিএ ৫ চাই তবে তা পড়ে, জেনে ও শিখে। যে জিপিএ আমদের জীবনে অভিশাপ না হয়ে আশির্বাদ হয়ে থাকবে। জীবনে ছায়া হয়ে থাকবে একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ অভিভাবক হিসেবে। ভালো একটি রেজাল্ট যেমন জরুরী ঠিক তেমনি জরুরী ভালো মানুষ হওয়া। ভালো মানুষ হতে না পারলে শুধুমাত্র জিপিএ ৫ দিয়ে জীবন জগতের কোন সমস্যার সঠিক সমাধান সম্ভব নয়। অনৈতিক জিপিএ ৫ পাওয়ার চেয়ে নৈতিকতার সাথে কম জিপিএ নিয়ে পাশ করা অনেক ভালো। আমরা মানুষ হতে চাই আগামী প্রজন্মের। দক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিতে চাই। নৈতিকতা, আদর্শ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আর সদিচ্ছা হউক আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র। এই দেশটা আমাদের, আমরাই বসবাস করবো এই দেশে। দেশের সকল অভিভাবক এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সকলে মিলেই আমাদেরকে সেইভাবে গড়ে তুলবেন। সকলেই আমরা, সকলের তরে, প্রত্যেকেই আমরা পরের তরে। এই প্রত্যাশাই হউক আমার, আপনার ও সকলের।