মেয়েটি অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছিল। ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সাধারণত ব্লেড ও চাকু থাকে। বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হতে পারত। এমনকি মারাও যেতে পারত। এই রকম ঝুঁকি নেওয়া একেবারেই নিরাপদ নয়। জীবন বাজি রেখে অপরাধীকে ধরা অনেক বড় বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা। ভাগ্য ভালো তার কোনো ক্ষতি হয়নি। ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর রাজধানীর টিকাটুলিতে ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে তাদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবু তালহা খন্দকারের। আসলে মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের জন্য সংগৃহীত গবেষণা খোয়া যাওয়ার আশঙ্কায় নিজেকে সামলাতে পারেনি হয়তো। আমরা জানি, মোবাইল হারালে মোবাইল ফিরে পাওয়া যেত; কিন্তু জীবন গেলে সে জীবন আর ফিরে আসবে না। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই ছিনতাইকারীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষে শিক্ষার্থী পারিসা আক্তারকে ধন্যবাদ। সে সাহসের সঙ্গে একটি যুদ্ধ শেষ করে ইতিহাস হয়ে থাকল। এ থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিক্ষা নেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীর সাহসী কাজকে আমরা সম্মান জানাই।
ছিনতাইকারীকে ঝাপটে ধরে বুকের ওপর চেপে বসে মারধরের ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এটা একমাত্র জ্ঞানহীন, অজ্ঞ মানুষের দ্বারাই সম্ভব। অথচ জবি শিক্ষার্থী পারিসা আক্তারের মোবাইল হারিয়ে শিশুর মতো অঝোরে কান্নার কষ্ট ওরা অনুভব করতে পারেনি। এ কান্না কী শুধু মোবাইল হারানোর কষ্ট! থিসিস বা গবেষণাকর্মের তথ্য-উপাথ্য, ডকুমেন্ট বা ফটো খোয়া যাওয়া যে কত বড় কষ্টের তা শুধুমাত্র মূর্খরাই বুঝবেন, তথাকথিত জ্ঞানীদের বোঝার কথা নয়। আইনের প্রতি অনাস্থা কতটা অসহায় হলে মানুষ এভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে। একজন ছিনতাইকারীর জন্য অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। এমনকি অনেক নিরীহ মানুষ মারা যায়। দূরপাল্লার বাস, ট্রেন বা লঞ্চ থেকে রাজধানীতে নেমেই তিক্ত ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। তারপরও পারিসা দেখিয়েছে। যা সমাজের অনেক পুরুষও দেখাতে অক্ষম।
ছিনতাইকারীরা মহিলাদের গলার চেন ছিনতাই, কান ছিড়ে গহনা নেওয়া, হ্যাঁচকা টানে মহিলাদের পার্স ছিনতাইয়ে মহিলাদের পড়ে যাওয়ার পর মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। এইতো মাত্র কয়েকদিন হলো সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বুলবুল আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাশে গাজী কালু টিলা লাগোয়া ‘নিউজিল্যান্ড’ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ৭ জুলাই রাজধানী ঢাকার অদূরে আবদুল্লাহপুর ব্রিজের কাছে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নির্মাণ শ্রমিক মো. সাহেদ নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ছিনতাইকারীরা সাহেদকে ছুরি মেরে খুনের পর তার কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে। এছাড়া ৭ জুলাই সেনাবাহিনীর সৈনিক হিসেবে কর্মরত শাহিন আলমকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাদানীনগর এলাকায় ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করে। তাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা যান। ২৭ মার্চ রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বুলবুল হোসেন নামে এক ডেন্টাল চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। যে ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। ডা. বুলবুল দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। শুধু স্বাবলম্বীদের কাছ থেকে ফি নিতেন। ইতিপূর্বে রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের হ্যাঁচকা টানে মায়ের কোল থেকে পড়ে মারা যায় ছয় মাস বয়সি আরাফাত। একইভাবে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মারা যান জাতীয় হƒদরোগ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ আলম। ২০২১ সালের ৫ মে ভোর ৬টার দিকে রাজধানীতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মুগদা বৌদ্ধ মন্দিরের ক্লিনার সুনিতা রানি দাসের মৃত্যু হয়েছিল। সুনিতা তার বোনের ছেলে সুজিতকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় করে বৌদ্ধ মন্দিরে যাচ্ছিলেন। পথে ছিনতাইকারীরা চলন্ত রিকশা থেকে সুনিতার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেওয়ায় রিকশা থেকে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাতে তার মৃত্যু হয়।
জবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী পারিসা আক্তার দুঃসাহসের সঙ্গে এক ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করেছেন, আরেক ছিনতাইকারীকে কৌশলে ডেকে এনে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। থিসিসের কাজে ২৩ জুলাই রাজধানীর সদরঘাট থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানা গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী। কাজ শেষে সেখান থেকে তানজিল পরিবহনের একটি বাসে করে যাচ্ছিলেন সদরঘাট। বাসে কথা বলার সময় কারওয়ান বাজারের যানজটে হ্যাঁচকা টানে মোবাইল নিয়ে লাপাত্তা এক ছিনতাইকারী। মুহূর্তের মধ্যে বাস থেকে নেমে ওই ছাত্রী ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করেন। কিন্তু ভিড়-ভাট্টায় ধরতে পারেননি। মোবাইল ফোনে থাকা ভার্সিটির কোর্সের গবেষণা প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হারিয়ে কারওয়ান বাজারের মূল সড়কের পাশে ইত্তেফাকের গলিতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল ছাত্রীটি। ঠিক তখনই সামনে দিয়ে অন্য এক ছিনতাইকারী আরেক নারীর ব্যাগ ছিনতাই করে পালাচ্ছিল। ছাত্রীটি ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরে মারধর করেন। তারপর দুজনকেই পুলিশে সোপর্দ করা হয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ছাত্রী ছিনতাইকারীর পকেট তল্লাশি করে একটি মোবাইল ফোন পান। তবে সেটি তার নয়। পরে কৌশলে ছিনতাইকারীকে দিয়ে ফোন করে তার সহযোগীকে ডেকে এনে তাকেও পেটানো হয়। তবে তার কাছেও ছিল না ছাত্রীর মোবাইল ফোন। এরপর ছিনতাইকারী তুষার ও তার সহযোগী রাসেলকে তেজগাঁও থানা-পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
মোবাইল ফোন ছিনতাই হওয়ায় পুলিশের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন পারিসা আক্তার। একটি ভিডিও ফুটেজে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘দুজন ছিনতাইকারীকে ধরিয়ে দিলাম। এরপরও পুলিশ যদি আমার মোবাইল উদ্ধার করে দিতে না পারে, এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কিছু নেই।’ পারিসা বলেন, ‘মোবাইলের আমার থিসিসের অনেক ডকুমেন্ট ছিল। মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নতুন করে আবার থিসিসের কাজ করা খুব কষ্টকর। এক ধরনের মানসিক বিষণ্নতার মধ্যে রয়েছি।’
যখন আইন ঘুমাতে থাকে, তখনই সাধারণ জনগণের নিজের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ছাড়া কী করার থাকে! ছিনতাইকারীরা কীভাবে সহজেই জামিনে বের হয়ে আসে। তা ছাড়া ওরা ছিনতাই করে অভাবে নাকি স্বভাবে, তার অনুন্ধান করে সমাধান করা জরুরি। এ দেশের আইন অপরাধীদের দমন করতে না পারলেও অপরাধীর জš§ দিতে পারে। এক নারী শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীকে ধরেছে, এক পুরুষ শিক্ষার্থী (আহমেদ রনি) একাই রেলের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এগুলো ভালো লক্ষণ কি? আমরা পারিসা ও আহমেদ রনির সাহসিকতার উত্তর চাই। সবার দ্বারা কী এভাবে দৌড়ে, জাপটে ছিনতাইকারীদের ধরা সম্ভব?
আশ্চর্য এক ‘ভিডিও প্রজন্ম গড়ে উঠছে আমাদের চারপাশে! এখন দেখা যায়, মরতে মরতেও ভিডিও করছে। সবাই দেখবে আর ভিডিও করবে, এটাই যেন সারা বাংলাদেশের চিত্র! দেশের মানুষ দর্শক বা ভিডিওগ্রাফার হিসেবে খুব ভালো! পারিসা আক্তারের সঙ্গে থাকা সহপাঠী বন্ধু শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘অনেক মানুষ এই ভিডিও করছিল। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিল না। ভিডিও করা শেষে সবাই যে যার মতো চলেও যেতে শুরু করেছিল। তখন আমাদের ভয় লাগতে শুরু করে। আমরা পুলিশে ফোন দিই। এক গণমাধ্যমকর্মী আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।’
ছিনতাইকারীকে পুলিশ ধরতে পারে না এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে কী? পুলিশের কি জানা নেই কোথায় ছিনতাই হয়, আর কারা করে? রাজনৈতিক ঝামেলা ঠেকানো ও ভিআইপিদের নিরাপত্তায় পুলিশ মহাব্যস্ত! জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে তারা ন্যূনতম সচেষ্ট নয়। শুধু সক্ষমতা দিয়েই সবকিছু হয় না, ইচ্ছাও থাকতে হয়। দেশের কতিপয় পুলিশের (সবাই নয়) ডিউটি যেন শুধু ‘গাড়ি স্যারের পাশে দার করান’। নানা অজুহাতে বাইকারদের জরিমানা, রিকশার চাকা ফুটা করা বা উল্টানো এই যেন তাদের কর্ম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারীকে ধরতে যাবে, এটা তো তার কাজ নয়। মানুষ ছিনতাইয়ের মতো বিপদে পড়লে যে ধরনের সহায়তামূলক আচরণ পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া উচিত, অনেক ক্ষেত্রেই তা পায় না। এজন্য অনেকেই থানায়ও যেতে চায় না। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পুলিশকে আরো গণমুখী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে না পারায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। থানা-পুলিশের মামলা না নেওয়ার অভিযোগ তো রয়েছেই।
ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে। হেঁটে, রিকশায়, বাসে বা বাইকে যেভাবেই হোক, ছিনতাইকারীদের নাগালের বাইরে যাওয়া কঠিন। গুলি করে বা ছুরি মেরে, কখনো অস্ত্রের ভয় দেখিয়েই সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মোটরসাইকেল বা গাড়িতে করে এসে রিকশাযাত্রীদের ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁচকা টানে পড়ে গিয়ে মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বহুবার।
রাজধানীর সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মিরপুর, এয়ারপোর্ট, আব্দুল্লাহপুর, আজমপুর, টঙ্গী, কলেজগেট, গাজিপুরে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব স্পটে নিয়মিত ৮-১০টা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। বর্তমান বাস্তবতায় পুলিশ এটা জানে না, এটি কোনোক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে পুলিশ ভালোভাবেই জানে কারা ছিনতাইকারী…; বাকিটা ইতিহাস!