পাশাপাশি বাড়ি। সে বাড়িতে আমরা কেউই থাকি না আর। আমরা রাস্তার ধারে টং দোকানে বসে প্রথমবারের মতো চা খাচ্ছিলাম। এর আগে যতবার খেয়েছি সেসব গল্প–উপন্যাসে। কবি চাইলেই কাব্যে উর্বশী বালিকাকে গলির মোড়ের দোকানের চা খাওয়াতে পারেন। লেখক চাইলেই গল্পে কড়া লিকারের চায়ে জুড়ে দিতে পারেন অমৃতকল্প। অথচ জীবন গল্পে মফস্বলের একটা মেয়ে চাইলেই গলির মোড়ের টংয়ের দোকানগুলোতে বসে চা খেতে পারে না।
এই প্রথম আমরা ভৈরব আর আত্রাই—দুই নদী মিলে চা খাচ্ছি টং দোকানে বসে। যত দূর জানি মঙ্গল গ্রহের কোনো প্রাণী আমাদের আত্মীয় নয়। তবু উৎসুক দুই একটা দৃষ্টি চোখে পড়ছে। আমাদের দেখছে। আমরা তা দেখেও দেখছি না। এই প্রথম আমরা ওদের চাহনিকে উপেক্ষা করতে শিখে গেছি!
কেটলির টুং টাং শব্দে আমাদের মুখ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে দুই একটা স্মৃতিকথা। বিস্ময়কর কোনো গল্প আমরা করছি না। ছোটবেলায় আমরা কে, কবার মার খেয়েছি এই যা! তবু দোকানদার চাচা বিস্ময় নিয়ে সেসব শুনছেন। তবে আমাদের মধ্যে যে গভীর একটা সম্পর্ক আছে, চাচা তা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। আমরা জন্মসূত্রে আত্মীয়। আমরা দুজন একে অন্যের মামাতো বোন আর ফুপাতো বোন হই। অপরদিকে আমার পুতুল আর ওর পুতুল ছোটবেলা থেকেই স্বামী–স্ত্রী!
এমন অতীত স্মৃতিবিধুরতায় বর্তমান সময়টা কাটছিল বেশ। ঝিরঝির বাতাস সেই ভালো লাগায় দোল দিচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে কেউ যেন পেছনে এসে দাঁড়াল। আচমকা চায়ের কাপ ছুঁল সেই হাত। এই হাত দেখেই আমি বুঝে ফেলি ব্যাগটা খুলতে হবে। হাতটা যে খুব জীর্ণ শীর্ণ। ওতে অভাবের রেখা আঁকা। আমি ব্যাগ খুলি। যত ছোট নোট আছে তা থেকে একটি দেব বলে। কিন্তু পাশের কণ্ঠটি আমাকে অবশ করে দিল। বলল, থামত। তারপর সেই শীর্ণ হাতকে ভাঙতি টাকার প্রস্তাব না করে বলল, ও খালা চা খাইবেননি?
এই কণ্ঠ আমি চিনি। এই কণ্ঠ আমার পাশে বসে থাকা রূপসা নদীর। আমার ফুপাতো বোনের। ও’র নদীর নামে নাম। আমরা বড় হয়েছি একসঙ্গে। তবু কোথায় যেন জলে জলে ভিন্নতা। যেন ভৈরব আর আত্রাই! রূপসা নদী। এই নদীকে কী আমি সত্যিই চিনি?
আমি অচেনা একদৃষ্টিতে চিরদিনের চেনা রূপসাকে দেখছি। ও কী করছে এসব! দেখছি আনুমানিক সত্তর পার হওয়া খালাটা রূপসা নদীর পাশে বসেছে। রূপসা আপ্যায়ন করছে। দোকানদার চাচাকে বলছে, ও চাচা, খালার জন্য একটা ফার্স্টক্লাস চা বানান। সঙ্গে দেন পাউরুটি।
গরম-গরম চা পাউরুটিসহ খালার জন্য তৈরি হলো। আহা কী আয়েশ করে খাচ্ছেন তিনি। আমি অপলক দেখে যাচ্ছি রূপসার খালার তৃপ্ত দুই চোখ। যে চোখের কোণে জল ছলছল কৃতজ্ঞতা। এই কৃতজ্ঞতা যতটা না ক্ষুধা নিবারণের তারও অধিক সম্মান প্রাপ্তির।
আমি বিস্মিত কালো আঁখি মেলে চেয়েই রইলাম। আমি কী কখনো এই নদীর গভীরতা জেনেছি, কতটুকু? আমি কী কখনো পেরেছি আমার অতি, অতি সাধারণ বোনটির মতো করে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি আপ্যায়ন করতে?
শত শত নিমন্ত্রণের কত আয়োজন দেখেছি। কখনো কখনো আয়োজকও ছিলাম। কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির অভূতপূর্ব আপ্যায়ন করার মানসিক সামর্থ্য গড়ে ওঠে না আমাদের অনেকেরই। রূপসা নদীর মতো করে। কী অমায়িক অনুরোধ, ও খালা খাইবেননি!
এই একটা কথা আমাকে যেন শীতল পুকুরের মতো স্নিগ্ধ ভালো লাগায় ভরিয়ে দিল। আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবছি। আমার মন বলে যাচ্ছে বিবেককে; রূপসা কত সাধারণ তবু কত অসাধারণ তুই! আমার নিশ্চুপ ভঙ্গি দেখে রূপসা নদী কলকল ধ্বনি করে বলে ওঠে, সে কীরে, কি হইল তোর? চল যাই।
আমার সংবিৎ যেন ফেরেনি তখনো। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলাম কুঁজো হয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন একজন সম্মানিত অতিথি। আর আমার পাশে বসে আছে সেই অতিথির মহিমান্বিত হোস্ট।
আমার ভৈরবের জলে ভেসে উঠছে শত আয়োজনে সমৃদ্ধ আমাদের অন্দরের নাশতার টেবিল। রূপসার মানবতার আপ্যায়নের কাছে কত ম্লান, জীর্ণ সে সাজানো টেবিল।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নামি নামি করছে। আকাশ জুড়ে রূপালি চাঁদ। হিমশীতল একটা বাতাস বইছে হৃদয়ের এপার ওপার। এই ঘোর লাগা সময়ে একটা কবিতা কণ্ঠে এসে ভিড় করেছে।
আমার অসাধারণ হতে পারার সিলেবাসে যে ওই ছিল, কবিতা–গল্প, সেসব জানতে হবে! রূপসাকে সেই কবিতা শোনাতে ইচ্ছে হচ্ছে। রূপসা নদী কখনো কবিতা পড়েনি। ও যে খুব সাধারণ। এই সাধারণ জানে না, সে কত অসাধারণ!
আমি রূপসার হাতটা ধরে বলি কবিতা শুনবি, রূপসা?
রূপসার হ্যাঁ কিংবা না কিছুই শুনি না। নদীর মতো নিশ্চুপ রূপসা হেঁটে যাচ্ছে। কিংবা বয়ে যাচ্ছে। আমি সেই দোকানদার চাচার মতো অতি সাধারণ এই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি অত্যাশ্চর্য বিস্ময় নিয়ে। কোনো দিন কবিতা না পড়া মেয়েটার মুখে আমি ঠিক যেন দেখতে পাই লেখা আছে:
‘হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে; রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়। রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে!’
অথচ জীবন গল্প এই; আমি কোন জীবনেও পাশে না পাওয়া জীবনানন্দকে চিনি। আজীবন পাশে থাকা রূপসাকে চিনি না! আমরা এমন…এমনই।