বিশ্ববাজারে বেশ কয়েক মাস ধরেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম ঊর্ধ্বমুখী। কিছুদিন ধরেই এর দাম ইউনিটপ্রতি (এমএমবিটিইউ) ৪০ ডলারের ওপরে রয়েছে। স্পট মার্কেটে (খোলাবাজার) এলএনজির এই উচ্চমূল্যের কারণে চলতি মাসের শুরু থেকে তা কেনা বন্ধ রেখেছে সরকার। এতে দেশের দৈনিক ১০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হচ্ছে।
যদিও এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়েছে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম এখন ৪০ ডলারের বেশি, যা আমাদের মতো দেশের জন্য বেশ ব্যয়বহুল। দাম না কমা পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার কোনো পরিকল্পনা নেই। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রাখায় দৈনিক দেশের সাশ্রয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। মূলত এই সাশ্রয়ের কারণেই কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে। ’
পেট্রোবাংলার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্পট মার্কেটের এলএনজির উচ্চমূল্য দেশকে আর্থিক সংকটে ফেলতে পারে। তাই সেদিকে আর পেট্রোবাংলাকে না তাকিয়ে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশের গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রমে স্থানীয় উৎসের বাইরে দুটি উৎস থেকে এলএনজি আমদানি করা হয়। এর একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, অন্যটি স্পট মার্কেট। এর মধ্যে বর্তমানে স্পট মার্কেট থেকে আপাতত সরকার এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে যে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে তা আসছে মূলত কাতার ও ওমান থেকে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, ‘বর্তমান মূল্যে স্পট মার্কেট থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানি করতে আমাদের ব্যয় হতো প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এক কার্গোতে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি থাকে। এই এলএনজি দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে মাত্র ১৫ দিন জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হতো। এই ঘাটতি মেটানোর জন্য দেশীয় কূপগুলো থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। ’
নাজমুল আহসান আরো বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে স্পট মার্কেটের ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজিসহ গড়ে দৈনিক প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এখন প্রায় দুই হাজার ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। তার মধ্যে দেশীয় কূপগুলো থেকে আসছে দৈনিক প্রায় দুই হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আসছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি। ’ এতে শিল্প-কারখানাসহ দেশের কোথাও গ্যাসের সংকট হচ্ছে না। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে বেশ কিছু গ্যাসকূপ ওয়ার্কওভার, অনুসন্ধান ও উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখায় শতকোটি টাকা সাশ্রয়ের বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। আমরা কখনোই স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার পক্ষে ছিলাম না। কারণ এটার এতই উচ্চমূল্য, যা দেশকে আর্থিক সংকটে ফেলতে পারে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি আমরা বহুদিন ধরেই বলে আসছি। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান করাসহ বহুভাবেই গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। ’
বদরুল ইমাম আরো বলেন, ‘এখন পেট্রোবাংলা গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ওয়ার্কওভারসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সেই কাজগুলো যদি সঠিকভাবে করা হয় তাহলে দৈনিক আরো ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো যাবে। ফলে তখন আর স্পট মার্কেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। আমাদের সংকটগুলো ধীরে ধীরে কেটে যাবে। ’
এদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধিতে খরচ সাশ্রয়ের জন্য পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা কমানো হয়েছে। ফলে বেড়েছে লোড শেডিং। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ‘স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় গ্যাসসংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দামও বাড়তি। তাই তেলচালিত বিদ্যুেকন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে শিডিউল করে এলাকাভিত্তিক লোড শেডিং দিতে হচ্ছে। ’