আমার ভাষা আমার অধিকার, আমার ভাষা আমার ঐতিহ্য, আমার সংস্কৃতি, আমার জীবনবোধ। আমার ভাষা আমার গর্ব, আমার ভাষা আমার অহংকার। চলছে ভাষার মাস। আমার ভাষা আমার মর্যাদা, আমার শিকড়।
এই মাস ছিল আমাদের ভাষার অধিকার আদায়ের মাস। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর চলছে। আমরা রক্তের বিনিময়ের আদায় করেছি আমাদের মাতৃভাষার অধিকার। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে চর্চা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে না লিখলে, না চর্চা করলে ভাষার অমর্যাদা হয়। নিজেদের আত্মসম্মান লোপ পায়। নিজের ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিজের মর্যাদার মতো সম্মানের।
মাতৃভাষার অমর্যাদা, অশুদ্ধ চর্চা শুধু মর্যাদাহানিকরই নয়, অপরাধেররও সামিল। দেশপ্রেম যদি ঈমানের অঙ্গ
হয় তবে মাতৃভাষার প্রতি সম্মান, শুদ্ধ চর্চা, শুদ্ধভাবে লিখাও দেশপ্রেম এবং ঈমানের অঙ্গ।
সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য, ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে, রক্ষা করতে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেন। আর আমরা সেই মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা করবো না, শুদ্ধভাবে লিখব না এটা অন্যায়, অনৈতিক ও অমর্যাদাকর।
ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য, ভাষার সমৃদ্ধির জন্য শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় শিক্ষা যতটা
সহজ, সাবলীল, হৃদয়াঙ্গম ও প্রাণবন্ত হয় অন্য ভাষাতে তা কখনোই সম্ভব নয়। মাতৃভাষায় শিক্ষার মধ্য দিয়ে ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হয়। শিক্ষার জন্য মাতৃভাষা এবং জ্ঞানার্জনের জন্য অন্য ভাষার প্রয়োজন আছে বৈকি কিন্তু তা কোনভাবেই মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জন যতটা সহজ, প্রাণঞ্জল অন্যকোন ভাষায় ততোটা সহজ নয়। মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জনে প্রাণশক্তি পাওয়া যায়। আমি আমার শিকড়কে কোন ভাবেই অস্বীকার করতে পারি না।
আজকাল কিছু কিছু ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ও বেসরকারি রেডিওর কিছু কিছু অনুষ্ঠানে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে বিদেশিদের ঢং এ উচ্চারণ করে। যা গোটা জাতির জন্য অপমান ও লজ্জাজনক এবং একে অপরাধ হিসেবে আমলে নিয়ে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো প্রয়োজন। অশুদ্ধ চর্চা ও লিখনি শহীদদের প্রতিও অসম্মান।
খুব আহত হই এবং খুব লজ্জা লাগে যখন দেখি ২১শে ফেব্রুয়ারি , ২৬মার্চ, ১৪ ডিসেম্বর, ১৬ ডিসেম্বরের মতো জাতীয় দিবসগুলোতে যখন দেখি কিছু শিক্ষক তাদের ছাত্রদেরকে প্রাইভেট পড়ানোর মাধ্যমে জাতীয় দিবসগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। তারা আসলে কী শিক্ষক নাকি শিক্ষা ব্যবসায়ী? তারা আসলে জাতীয় চেতনা বিরোধী জাতি গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করছেন।
জাতীয় দিবসগুলোও শিক্ষার একটি অংশ। যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা দায়বদ্ধতা শিখতে পারে নচেৎ শিক্ষার্থীরা গড়ে উঠেন একজন স্বার্থপর মানুষ হিসেবে। যার ফলে শিক্ষার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। শিক্ষাকে ফলপ্রসু করতে হলে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা বাংলা।
এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকারসহ উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। তবে আমরা কেন ভিন্ন পথে ? দুঃখজনক হলে এটাই সত্যি যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না আছে উচ্চ শিক্ষায় , না আছে উচ্চ আদালতে। আমাদের দেশের অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র মাতৃভাষা ( বাংলা ভাষার ) ব্যবহার আমাদের নিজেদের মর্যাদা ও দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে। মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষর্থীর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ ঘটে।
মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষার সম্পূর্ণ তাৎপর্য উপলব্দি করা যায় না। আমি যদি আমার ভাষাকে ভালোবাসতে না
পারলাম, ভাষাকে সম্মান করতে না পারলাম, না শিখলাম তবে আমার পক্ষে দেশপ্রেম সমৃদ্ধ মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। দেশপ্রেম বর্জিত একজন মানুষ কোন অপরাধ করতে চিন্তাই করে না। আজকের শিশু আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক। যোগ্যতার মাপকাঠির বিচারে দেশপ্রেম অগ্রগন্য। মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়।
মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ও সাহিত্য সম্পর্কে স্বচ্ছ এবং পূর্ণ ধারণা লাভ করা যায়। অন্যভাষাতে তা আদৌ সম্ভব নয়। শিক্ষা যেখানে সহজাত অধিকার , সভ্যতার ক্রমপ্রগতির অনিবার্য অঙ্গীকার, সেখানে কৃত্রিমতার কোন অবকাশ নেই।
কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করতে হলে, তাকে চির পরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়। আমাদের মন তেরো, চৌদ্দ বছর বয়স হতে জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে, সেই সময়েই অহরহ যদি তার উপর বিদেশি ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্ত বিদ্যার শিলাবৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকে তবে তা পুষ্টি লাভ করবে কী করে।
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় সহজবোধ্যতার ভিত্তি নাই। পরভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষালাভে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক শক্তির যথেষ্ট অপচয় হয়। মাতৃভাষা ভিন্ন অন্যভাষায় জ্ঞানার্জন করতে গেলে বিষয় ও বাহন উভয়ের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে বিদ্যার্জনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনা গড়ে ওঠে মাতৃভাষার মাধ্যমে।
মাতৃভাষা বাংলা হউক আমাদের শিক্ষার অনিবার্য পরিণতি। মাতৃভাষার উন্নতির মধ্যে দেশের প্রকৃত উন্নতি
নিহিত। মাতৃভাষার ভীত যতটা মজবুত দেশের উন্নতির ভীত ঠিক ততটইা মজবুত হয়। মাতৃভাষার ভীত মজবুত করার জন্য রাষ্ট্রকে প্রযোজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও উদ্যোগ ছাড়া যেমন মাতৃভাষার ভীত মজবুত হয় না, তেমনি শিক্ষা ও উন্নতির ভীত মজবুত হয় না। মাতৃভাষায় শিক্ষা সমৃদ্ধশীল হয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায় মাতৃভাষার গুরুত্ব যত বেশি তারা উন্নয়নের ধারায় ততো বেশি এগিয়ে। শিক্ষা ও উন্নয়নে মাতৃভাষা বাংলাকে যেভাবে মূল্যায়ন করা দরকার তা আমাদের এখানে অনেক পিছিয়ে।
মাতৃভাষাকে দুর্বল রেখে বিদেশি ভাষার সবলতার আশা করা দুরাশার নামান্তর বরং মাতৃভাষাকে কেন্দ্রে রেখেই বিভিন্ন ভাষার একটি আবহ তৈরি করাই কাম্য। যার মাধ্যমে বিশ্বের নানান দেশের জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য গ্রহণ করে সে সবকে নিজের দেশ ও সমাজে প্রয়োগ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে।
মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই প্রকৃত পক্ষে দেশের মানুষের চিন্তাশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, সৃষ্টি-শক্তি ও কল্পনা-শক্তির যর্থাথ
বিকাশ সম্ভব। রাষ্ট্রীয় আইন, বিচারিক আদলতেও মাতৃভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। জীবন ও শিক্ষার সম্বনয় সাধন করতে পারে একমাত্র মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মাধ্যমে সজহজেই শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষণীয় বিষয়ে আনন্দ খুঁজে পায়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার গাঁথুনিটা খুব মজবুত করে দিতে পারলে যে কোন ভাষায় শিক্ষার্থীরা অতি সহজে পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে।
আজ পৃথিবীর সকল সভ্য দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। আমরা বিপর্যয় চাই না, উন্নতি চাই। রাষ্ট্রের সকল সরকারি-বেসরকারি সকল দপ্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিৎ করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের নিকট ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরতে হবে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সরসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানে সংবাদকর্মীরা যখন আজকের প্রজন্মের কাছে আমাদের জাতীয় দিবসগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন তখন অনেকেই তার সঠিক উত্তর দিতে পারছেন ভাষা আন্দোলনের ৭২বছরে এসে আর স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না।
যে জাতির নতুন প্রজন্ম তার দেশের সঠিক ইতিহাস জানে না সেই জাতি কখনোই দেশপ্রেমসমৃদ্ধ জাতি হিসে্বে এগিয়ে যেতে পারে না। আমাদেরকেও মাতৃভাষারয় শিক্ষা-দীক্ষা ও রাষ্ট্র পরিচালনার পথে হাঁটতে হবে অন্যথায় আমাদের জাতীয় জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে।