মহামানুষদের মৃত্যু যদি চুপচাপ নির্ভেজাল ভাবে সম্পন্ন হয় তবেতো সে মৃত্যুর কোন বিশেষত্ব থাকে না। মহামানবদের প্রস্থান হতে হয় মহা-প্রস্থান, তবেইতো সেটা হবে তার কর্মের সমান মহিয়ান।
হাজার বছরের বাঙ্গালী! আসলেই কী হাজার বছরের? ইতিহাসতো বলে কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই বঙ্গ ছিলো, পুরান ও মহাভারতে এর প্রমানও আছে।
কোন জাতি হঠাৎ করে জন্ম নিতে পারে না। ধাপেধাপে জাতীয় সংস্কৃতী এগিয়ে চলে, মহাভারতের কালেই বাংলার ভিত্তি দাড়িয়ে যায়। সংস্কৃতীর সাথে ভাষার বিবর্তনও চলতে থাকে, পাল সাম্রাজ্যে বাঙ্গলা ভাষার আধিরুপ দাড়িয়ে যায় আর ১০শতকে একটা ভদ্ররূপ ধারণ করে।
কবি সাহিত্যিকরা ভাষার জন্ম দেন না তারা একটা সার্বজনীন ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। তেমনি মধ্যযুগের মহাকবি বরু চন্ডিদাস এই ভাষায় তার সাহিত্য রচনা করে বাঙ্গলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে।
আর বাঙ্গলার ভূখণ্ডকে সমৃদ্ধ করেছে এর রাজা-প্রজা মিলে, এদেশ কখনো স্বাধীন আবার কখনো পরাধীনতায় কাটিয়েছে। বারোভূইয়াদের থেকে মোগোলরা আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার পরে ইংরেজদের হাত হয়ে পাকিস্তানের হাতে নিষ্পেষিত হয়ে ৫২তে যে আন্দলন শুরু হয় তা চুড়ান্ত রুপ পায় ৭১ এর ৭ই মার্চ।
সে দিন “এবারের সংগ্রাম” বলে বারোভূইয়াদের উত্তরসুরী সারা বাঙ্গলা চষে এসে রেসকোর্সে দাড়িয়ে পাকিস্তানিদের বুকে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে বাঙ্গালীকে কাপিয়ে তুলে দুর্বার করে দেন। ঘুম ভেঙ্গে আবার উঠে দাড়ায় পাল সম্রাটদের বাংলা।
রবি ঠাকুর ও সুভাষ বসু যে বাংলাকে জাগাতে পারেনি সেই বাঙ্গলাকে কাজী নজরুলের বিদ্রোহের বানী বুকে ধরে এক ঝাকুনিতে অস্ত্র হাতে দাড় করিয়ে দিয়েছেন পরাধিনতা মানতে না চাওয়া শেষ ভূইয়া, স্বাধীনতার নির্মাতা শেখ মুজিব।
এক কবি মধ্যযুগে বলেছেন “সবার উপর মানুষ সত্যি, তাহার উপর নাই”। আর আধুনিক কবি আমাদের শুনিয়েছে ”এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। কারন সেই কবি জানে স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ হয়ে কোন লাভ নাই। তিনি স্বপ্নের কবি নন, তিনি যে মানুষের মুক্তির কবি, তিনি স্বাধীনতা নির্মানের কবি। কলম দিয়ে নয় তিনি অস্ত্র দিয়ে কবিতা লিখে গিয়েছেন, তাইতো আমরা স্বাধীন।
৭ই মার্চ তিনি সাধারন ভাবে কাটিয়ে দিলে ২৬মার্চও একটা সাধারণ দিন হিসাবেই কাটিয়ে দিত দেশের মানুষ। আর যদি তাই হতো তবে ১৬ ডিসেম্বর কখনও দেখা দিতো না। কিন্তু তা হতে দিতে রাজি ছিলেন না সাধীনতার নির্মাতা তার কবিতাটা বজ্রকন্ঠে রচনা করে সাধীনতার পথ দেখিয়ে দিলেন বাংলার শেষ পিতা।
মহাত্বা গান্ধী একবার তার কাঙ্খিত মৃত্যু নিয়ে কথা বলার সময় বলেছিলেন আমি সারা জীবন যে কাজ করেছি তাতে যদি অসুস্থ হয়ে বিছানায় মারা যাই সেটা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ হয় না। যদি বন্দুকের গুলিতে মারা যাই তবে সেটাই হবে আসল পথ! তবেই না আমার কাজের মূল্য পাব। গান্ধী তার কাঙ্খিত পন্থাতেই মৃত্যু গ্রহন করেছেন, তার অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ভারত-পাকিস্তানসহ সারা পৃথিবীকে ঝাকুনি দিয়েছিলো।
মহামানুষদের মৃত্যু যদি চুপচাপ নির্ভেজাল ভাবে সম্পন্ন হয় তবেতো সে মৃত্যুর কোন বিশেষত্ব থাকে না। মহামানবদের প্রস্থান হতে হয় মহা-প্রস্থান, তবেইতো সেটা হবে তার কর্মের সমান মহিয়ান। সর্বকালের সেরা চিন্তাবিদ, সেরা জ্ঞানী সক্রেটিসও স্বাভাবিক মৃত্যুকে গ্রহন করতে অস্বিকার করেছিলেন বলেই আজ ২৫০০ বছর পরেও আমরা হাহাকার করছি, তাইতো তার জীবন যেমন মহিমান্বিত ছিলো মৃত্যুও তার সার্থক হয়েছে।
৭ই মার্চ তেমনই এক মহিমান্বিত মৃত্যুর প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছিলো। ৭০ এ গরম হতে থাকা বাংলাদেশ ৭ই মার্চ, ৭১এ ফুটতে শুরু করে ২৫শে মার্চ রাতে ওভারফ্লোতে দিশেহারা জাতি দিশা পেয়েছে ৭ই মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠে। সেই বজ্রকণ্ঠই আমাদের দিশা যা এখনও আমাদের পথ দেখাচ্ছে কিন্তু আমারা কি সে পথ দেখছি? দেখছি না বলেই এখনো আমারা সেই কম্বলটা খুঁজে চলছি যেটা পিতাও তখন খুঁজেছিলেন।
এই লেখায় প্রাসঙ্গিক না তাও একটু বলে যাই-২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধু অ্যারেস্ট না হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হইত, স্বাধীনতাও হয়তো স্বপ্নই থেকে যেত!
যে স্থপতি ২৪ বছরের গাথুনির উপর ৭মার্চ নির্মাণ করে ২৬ মার্চ হয়ে ১৬ ডিসেম্বর উপহার দিলেন তার মৃত্যুটা এমন ভাবে কাম্য ছিলো না তার জন্য। তার মৃত্যুটা অন্যভাবেও হতে পারতো, হয়তো তাই হয়াই উচিত ছিলো কিন্তু তবেতো তার মৃত্যু নিয়ে এতো গান-কবিতা জন্ম নিতো না, এতো মানুষ হয়তো এমন শোক করতো না (যদিও তার দল সেই দুঃখের দিনটা উৎসবের দিনে পরিনত করেছে) এতো চোখ জল ঝরাতো না।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে আর এই স্বাধীনতার জন্য পুরা একটা প্রজন্ম তাদের জীবন বাজি ধরেছিলো। দেশের প্রথম প্রজন্মের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ পতন হলো, জীবন অনিশ্চিত হয়ে গেলো তাঁরা তা মেনে নিলেন স্বাধীনতার জন্য। দ্বিতীয় প্রজন্মের নারীদের জন্য দেশটা নরকে পরিনত হলো। তৃতীয় প্রজন্মের জীবন হয়ে গেলো অনিশ্চিত এমনকি অনেকে জীবনই হারালো। আর দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেরাতো ইচ্ছে করেই নিজেদের জীবন বাজি ধরে, দলে দলে ঝাপিয়ে পরলো যুদ্ধের আগুনে। কিসের আশায়, কোন স্বপ্নে তারা নিজেকেই বাজি ধরলেন?
পিতা সেদিন নিজের স্বপ্ন সবাইকে দেখালেন এবং সেই স্বপ্নকে বাঁচাতে ডাক দিলেন দেশের সন্তানকে, পিতার ডাকে পুরা জাতী নেমে গেলো দেশ মাতাকে বাঁচাতে। পিতা-মাতাকে রক্ষা করাতো সন্তানের দায়ীত্ব, সেই দায় থেকে ধামাল ছেলেরা ঘর ছেড়ে মাঠে নেমে গেলেন। কেউ-কেউ সেই মাঠে নিজেকে বিলিন করে দিলেন আর বাকিরা মাথা উচু করে পিতা-মাতাকে রক্ষা করে ঘরে ফিরে এলেন।
দেশটা তার যুব সমাজের প্রায় অর্ধেকের শরীর নিজের বুকে ধারণ করে মুক্ত হয়েছে, উর্বর হয়েছে, শুদ্ধ হয়েছে। এতো এতো মহিমান্বিত প্রাণ, আমাদের মহান জাতি করে দিয়ে গেলো আর আমরা তাদের ভুলে গেলাম! অনেকে হয়তো বলবেন সরকতো তাদের জন্য কত কিছু করছে। তারাতো কিছু পাওয়ার জন্য যুদ্ধে যায়নি তারা গিয়েছিলো দেশটাকে শোষণমুক্ত করতে, অপরাধমুক্ত করতে। যারা জীবিত আছে তাদের না হয় কিছুটা প্রতিদান দেয়া যাচ্ছে কিন্তু যারা জীবন দিয়ে দিলো তাদের দায় শোধ হবে কীভাবে? তাদের ঋণ শোধ করতে হলে শতভাগ মানুষকে সৎ হতে হবে। তাদের ভুলে গেলে চলবে না, শ্রোদ্ধার সাথে মনে রাখতে হবে।
কিন্তু নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ বাদ দিলে বাকি সবাই চোর, ঠক, ছিন্তাইবাজ। এরা নদী খায়, জমি খায়, বন খায়, মানুষের টাকা খায় আবার মানুষের রক্তও খায়। সারাক্ষণ এরা খাইখাই রোগে ভোগে। সরকার এদের থামায় না উল্ট এরাই সরকার চালায়(!)
সরকারের কোন সেক্টরে টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না, টাকা ছাড়া কোন কাজ করা যায় না অথচ এই কাজ করার জন্যই তারা নিয়োগপ্রাপ্ত, তার পরেও নাকি তাদের কাছে জনগন কোন কাজ নিয়ে গেলে পারিশ্রমিক দিতে হবে? এটা কেমন কথা? সরকার তাদের দেখে না, আমরা প্রতিবাদ করলেই সরকার সেখানে ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়।
প্রতিবছর মার্চ আসে আর যায় আমরা বকধার্মিকদের মত মহাধুমধামে পালন করে পরের দিন ভুলেই যাই মার্চ মাস চলছে, আর ভুলে যাই বলেই পিতা যে কম্বলটা খুঁজে পায়নি আমরা আজও সেটা খুঁজছি।
মার্চ যদি আমাদের চেতনা হয়ে থাকে, বাঙ্গলার পিতা যাদি আমাদের আদর্শ হয়, মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের অস্তিত্ব হয় আর শহীদরা যদি হয় স্বাধীনতা তবে আমাদের কাছে আমাদের কম্বলটা এমনিতেই আসুক।
একদল হায়না নিজেদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন তছনছ করে দিয়ে দেশটা একেবারেে অমানবিক করে ফেলেছে, চেটেপুটে নোংড়া করেছে।
ওদের হাত গুড়িয়ে দিয়ে সমাজটাকে আয়নার মত স্বচ্ছ করে এই খাইখাই বাহিনি দেশের সকল পদ থেকে বিতারিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের দেশ গড়ে, তাদের চেতনা জাগিয়ে তুলে এখন একটা মানবিক দেশ নির্মাণ করা দরকার। আর এটাই হোক আমাদের মার্চের চেতনা।