ফোনের ঐপাশ থেকে কেউ একজন বা কয়েকজন ভয়ংকর কণ্ঠে চিৎকার করে বলছে, ‘আমরা তোমার মেয়েকে/ছেলেকে ধরে রেখেছি, অতি শিঘ্রই আমাদের কাছে টাকা পাঠাও নতুবা সে মারা যাবে বা আমরা তাকে মেরে ফেলবো‘। এবং পাশাপাশি আপনি এও শুনতে পাচ্ছেন যে, ‘বাবা/মা, দয়া করে আমাকে বাঁচাও!‘
এতক্ষনে হয়তো আপনার হৃদয় থেমে গেছে, কেননা এটা আপনার সন্তানের কণ্ঠ!
ঠিক যেন বাংলা সিনেমার গল্পের মত, তাই না! তবে সিনেমার মত হলেও বিষয় টা হালকা ভাবে নেয়ার মত না। বর্তমানে এটা হরহামেশাই ঘটছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমন কি, সুরক্ষিত এবং নিরাপত্তা বেষ্টিত এই আমেরিকাতেও। অবাক লাগছে তাই? তবে বিষয় টা সংঘটিত হচ্ছে অনলাইনের সহয়তায়, যেখানে হয়তো অপহৃত ব্যক্তির কোন অস্তিত্বই নাই অর্থাৎ, সম্পুর্নটাই হল আপনাকে বোকা বানিয়ে টাকা/অর্থ হাতিয়ে নেয়ার একটা কৌশল। তবে এরা কোন সাধারণ অপহরণকারী না, এরা একটা চক্র বা দল, যারা তথ্য ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে আমার-আপনার পরিবারের মানুষদের বোকা বানিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এটাকে বলা হয় Cyber kidnapping বা ভার্চুয়াল অপহরণ স্ক্যাম।
আমার আজকের বিষয় Cyber kidnapping, বা ভার্চুয়াল অপহরণ স্ক্যাম। বিষয়ের গভীরে যাওয়ার পুর্বে প্রথমে আমাদের জানতে হবে আসলে এই জিনিসটা কি? ভার্চুয়াল অপহরণ স্ক্যামে, অপরাধী ভিকটিমকে বিশ্বাস করায় যে তার প্রিয়জন কেউ অপহৃত হয়েছে। এটি প্রায়শই ফোন কল বা মেসেজের মাধ্যমে করা হয়, যেখানে অপরাধী চক্র অপহৃত ব্যক্তির “মুক্তির” জন্য মুক্তিপণ দাবি করে, যদিও প্রকৃতপক্ষে অপহৃত ব্যক্তি ঘটনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগতই নয়। অর্থাৎ, বাস্তবে কোন প্রকার অপহরণের ঘটনা ঘটেই নি; এটি শুধুমাত্র মানষিক ম্যানিপুলেশন ট্যাকটিক যার উদ্দেশ্য হলো ভিকটিমের কাছ থেকে মুক্তিপণ বা অন্যান্য ফর্মের সম্পদ আদায় করা। সহজ কথায়, এটি একটি চাঁদাবাজির একটা পন্থা, যেখানে অপরাধীরা সন্দেহভাজন মানুষদের বিশ্বাস করায় যে তাদের পরিবারের সদস্যরা বিপদে আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উন্নত ভিডিও যোগাযোগ এবং মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রাপ্যতার কারনে, এই প্রতারণাটি অনেক বেশি জটিল, ভয়ঙ্কর এবং অবিশ্বাস্যরকম লাভজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ব্যবহৃত প্রযুক্তি:
- প্রতারণা (কলার আইডি স্পুফিং): অপরাধীরা এমন ভাবে আপনাকে কল করবে যে কলটি দেখে মনে হবে যে এটি আপনার কোন পরিচিত বা স্থানীয় নম্বর থেকে এসেছে, এমনকি মনেহবে যে কলটি অপহৃত ব্যক্তির নম্বর থেকেই এসেছে (এক কথায় যাকে বলা হয় ক্লোনিং)।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (সোশ্যাল মিডিয়া): অপরাধীরা সামাজিক মাধ্যমের (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ইত্যাদি) প্রোফাইল থেকে অপহৃত ব্যক্তির তথ্য ব্যবহার করে তাদের দাবিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
- কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence): অপরাধীরা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এমন কিছু ভয়েজ বা কথা তৈরি করে যা শুনতে একই মনে হবে, ঠিক যেন অপহৃত ব্যক্তিই কথা বলছে।
- পুর্বে ধারণকৃত অডিও: বিশ্বাসযোগ্য বাড়ানোর জন্য অপহৃত ব্যক্তির কোন চিৎকার বা আতঙ্কের পূর্ব-রেকর্ডযুক্ত অডিও ব্যবহার করতে পারে, যাতে আপনার বিশ্বাস হয় যে অত্যাচারের কারনে অপহৃত ব্যক্তি চিৎকার করছে।
- ডীপফেক প্রযুক্তি: এই প্রযুক্রির মাধ্যমে খুব সহজেই ভিডিওতে বা ছবিতে, একজন মানুষের মুখমণ্ডলের ছবি অন্য মানুষের মুখমণ্ডলের ছবি দ্বারা অতি সহজেই প্রতিস্থাপন করা যা এমনকি তার অভিব্যাক্তি সহ। এটা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো।
বছরের শুরুর দিকে Utah তে, পুলিশ একটি ১৭ বছরের চীনা ছাত্রকে উদ্ধার করে, যাকে অপরাধীরা তার আমেরিকান হোস্ট পরিবার বাড়ি থেকে পলায়ন করতে উৎসাহিত করেছিলো এবং পাশাপাশি পাহাড়ের উপর একটি তাঁবুতে নিজেকে সীমাবদ্ধ করতে বলেছিলো। তাকে বলা হয়েছিলো এমনকিছু ছবি তুলতে যা দেখে মনেহয় যে, সে অনেকটা আতঙ্কের মধ্যে আছে। পরবর্তিতে সেই ছবি তার অবর্তমানে, চীনে থাকা পরিবারে কাছে পাঠানো হয়েছিল যাতে তার পরিবার তার এই ছবি দেখে ভাবতে পারেন যে, তাদের ছেলেকে অপহরন করা হয়েছে এবং এই জন্য তার পরিবারের কাছে মুক্তিপনও চাওয়া হয়। তার অসহায় পরিবার অর্থাৎ তার বাবা-মা তার মুক্তি নিশ্চিত করতে $৮০,০০০ ডলার প্রদান করে অপরাধীদের কে। অথচ সেই ছেলে এই বিষয়ে জানেই না যে তার বাবা-মার সাথে প্রতারণা করে অপরাধীরা এই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এমন কি পরবর্তিতে তার বাবা-মা সেই ছেলের সাথে কথা বলার বুঝতে পারে আসলে তার ছেলেকে অপহরণ করাই হয় নাই। এটা ছিল সম্পুর্ন মিথ্যা অপহরণের ঘটনা, যা তার বুঝতেই পারে নাই।
Utah রাজ্যে চীনা ছেলের এই মামলাটি অস্ট্রেলিয়ান প্রতারণার একটি উদাহরণ এবং দ্রুতই ওয়াশিংটন ডিসি, সিডনি এবং লন্ডনের চীনা দূতাবাসসহ সব বিভিন্ন দূতাবাসে এই ঘটনার সতর্ক বার্তা প্রেরন করা হয়েছে।
এপ্রিলে Arizona তে জেনিফার ডেস্টেফানো নামের এক মা, তার মোবাইল ফোনে অজানা নম্বর থেকে একটি কল পেয়েছিলেন, যখন তার 15 বছরের মেয়ে ব্রিয়ানা স্কি উৎসবে ছিল। যখন তিনি ফোনটা রিসিভ করেন, তিনি শুনতে পান তার নিজের মেয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে কাঁদছে এবং বলছিল যে, ‘মা, এই খারাপ লোকেরা আমাকে ধরেছে। সাহায্য কর, সাহায্য কর, আমাকে বাঁচাও!‘ ডেস্টেফানো বলেছেন যে, এটা যে তার মেয়েই ছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না, কারন এটি তার মেয়েরই কণ্ঠ ছিল। ডেস্টেফানো কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেন, ‘আমি এক সেকেন্ড এর জন্যেও সন্দেহ করি নাই যে সেটি আমার মেয়ে ছিল না। এটি এমন এক অদ্ভুত বিষয় যা আমাকে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।‘ তবে সত্যিকার অর্থে, এটি যে ডেস্টেফানোর মেয়ে ব্রিয়ানা ছিল না তা ডেস্টেফানোর স্বামীর বুদ্ধিতে বেড়িয়ে আসে। প্রতারকরা যখন ১ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপন দাবি করে, অন্যদিকে ডেস্টেফানোর স্বামী তাদের টাকা দেওয়ার আগেই ব্রিয়ানা ঠিক আছেন তা নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। পরবর্তিতে, জেনিফার ডেস্টেফানো শুনেছিলেন যে, সম্ভাবত তার শোনা তার মেয়ের করুন আর্তনাদটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি হয়েছিল। ডীপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীরা সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট হওয়া ছোট ছবির এবং ভিডিওর মাধ্যমে বাস্তবায়িত অনুকরণ তৈরি করতে পারে (এই ডীপফেক বিষয়ে আলোচনা পরে হবে)।
২০২২ সালের মে মাসে একজন Houston, Texas নাগরিকের ফোন হ্যাক হয় এবং সে তার মায়ের নাম্বার হতে একটা কল রিসিভ করে। অপর প্রান্ত থেকে একটি ভয়ানক কণ্ঠে বলেছিল যে, তার মা তাদের হাতে বন্দি এবং তিনি যদি ভেনমো (Venmo) (এক ধরনের পেমেন্ট অ্যাপ) এর মাধ্যমে তাড়াতাড়ি $৯০০ ডলার স্থানান্তর না করেন, তাহলে তার মাকে প্রহার করা হবে। তিনি খুবই ভয় পেয়ে যান, কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না! সৌভাগ্য বসত, ঘটনার কয়েক মিনিট পরে তার ভাই তার মোবাইলে টেক্স উত্তর দেন বা বার্তা পাঠান যে, তাদের মা-বাবা নিশ্চিন্তে বাসার দোতলায় তাদের নিজেদের রুমে ঘুমাচ্ছেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, তাদের সাথে, প্রতারণা করা হচ্ছে বা হয়েছে। একবার ভাবুন তো তার ভাইয়ের ফোন থেকে মেসেজ/বার্তা না আসলে কি হত?
এই অবস্থায় কিভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন?
- আগাম পরিকল্পনা করুন: আপনার প্রিয়জনের সাথে সাইবার অপহরণ স্ক্যাম নিয়ে আলোচনা করুন, বিশেষ করে যারা ভ্রমণ করছেন বা দূরে আছেন। একটি নিরাপদ বা গোপন শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহার করুন যা আপনি সাধারণ কথোপকথনে ব্যবহার করেন না। যেমন টা বাংলা/হিন্দি সিনামায় দেখা যায় ভিলেনরা একটা গোপন কোড বা শব্দ ব্যবহার করেন যেটা শুধু সঠিক ব্যাক্তিই জানেন।
- যাচাইকরণ টুল: অপহরণের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে, আপনার প্রিয়জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে বলুন দ্রুত। যদি তারা সত্যিই বন্দী হয়, তবে তারা স্বাধীনভাবে উত্তর দিতে বা নিরাপদ শব্দ ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না।
- শান্ত হোন, যাচাই করুন: আতঙ্কিত হবেন না। সন্দেহজনক যোগাযোগ বন্ধ করুন এবং আপনার আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্বস্ত চ্যানেলের মাধ্যমে সরাসরি আপনার প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করুন (যেমন, একটি নির্দিষ্ট অ্যাপ বা পূর্ব-নির্ধারিত বন্ধুকে কল করা, ইত্যাদি)।
- রিপোর্ট: যদি এটি একটি সত্যিকার অর্থে স্ক্যাম/ভুয়া হয়, কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি রিপোর্ট করুন।
মনে রাখবেন, আইন প্রয়োগকারীরা কখনই ফোনে মুক্তিপণ দাবি করবেন না। যদি আপনি সন্দেহ করেন বা মনে করেন যে, এটি একটি স্ক্যাম, তাহলে শান্ত থাকুন, একটি বিশ্বস্ত চ্যানেলের মাধ্যমে আপনার প্রিয়জনের নিরাপত্তা যাচাই করুন এবং যত দ্রুত সম্ভব, কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি রিপোর্ট করুন৷