শিক্ষা তো শিক্ষাই। এখানে সরকারি-বেসরকারি কথাটাই অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক, অমানবিক এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিক্ষা মানুষের জন্মগত মৌলিক মানবিক অধিকার ও গুণ। শিক্ষার সার্বিক প্রসার এবং মানবিক গুণ বিকাশের গুরুদায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত। শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধতার প্রকাশ বা বাস্তবায়ন।
একটি উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বাস্তব জ্ঞানসমৃদ্ধ মানবিক শিক্ষার বিকল্প নেই। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চার ধারায় বিভক্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দাবি ওঠে চার ধারায় শিক্ষা নয়, একই ধারায় শিক্ষা চাই। যার মধ্য পুরো জাতি একই বিশ্বাস ও জাতীয়তায় গড়ে উঠবে। শিক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর তারাও চার ধারায় বিভক্ত। ফলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
একজন শিক্ষক সমাজের বিবেক জাগিয়ে তোলেন। একজন ছাত্রের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করেন। তিনিই সমাজ বিনির্মাণের কারিগর। তিনিই সমাজ এবং জাতির প্রয়োজনে আলোর দিশারী হিসেবে পথ দেখান এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে সর্বদা প্রস্তুত ইতিহাস এমনটাই সাক্ষী দেয়। আমাদের দেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থযান, সাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ দেশের শিক্ষক সমাজের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দেন। কিন্তু তাকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। তাই বলা হয়, গুরুদক্ষিণা ছাড়া শিক্ষা সম্পন্ন হয় না। বিদ্যানের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র। পৃথিবীর যে দেশ শিক্ষকদের যত বেশি মর্যাদা দিয়েছেন সেই দেশ সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তত বেশি উন্নত। ইতিহাস বলে, যুগে যুগে অতি অত্যাচারী শাসকও নত শিরে গুরুর সামনে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের দৃষ্টতা কেউ দেখাননি।
জাতি গঠন এবং উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো শিক্ষা। আর শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়গুলো হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি। তবে এ প্রসঙ্গে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। কেননা শিক্ষকই হচ্ছেন, শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং একটি মহান পেশা। একজন আদর্শ শিক্ষক জানেন, তার চলার পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ এবং ভবিষ্যৎ বিড়ম্বনাময়। তবু তিনি হৃদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এ জন্য তাকে জীবনব্যাপী সংগ্রাম করতে হলেও তিনি আদর্শচ্যুত হন না। সর্বদা ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপসহীন। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর এ নামেই আখ্যায়িত। শিক্ষা নিকেতন তার কর্মশালা। তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তির বিকাশ পরিশীলন ও উন্নয়ন প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বলা যায়, একজন আদর্শ শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে অন্যতম।
একই সিলেবাস এবং কারিকুলাম ও নিয়মনীতি মেনে সরকারি শিক্ষকরা প্রারম্ভিক বেতন স্কেল ১৬,০০০ টাকা এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন স্কেল ১২,৫০০ টাকা, সরকারি শিক্ষকদের চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, সরকারিদের মূল বেতনের ১০০%, এমপিওভুক্তদের মূল বেতনের ২৫%, বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ৪৫-৪০% এমপিওভুক্তদের শুধু ১০০০ টাকা। সরকারিদের ক্ষেত্রে মূল বেতনের ৯০ %-এর ৩০০ গুণ, এমপিওভুক্তদের মূল বেতনের ৭৫ গুণ, সরকারিদের ক্ষেত্রে অবসরকালীন মাসিক ভাতা মূল বেতনের ৯০% ও চিকিৎসা ভাতা। কিন্তু এমপিওভুক্তদের কোনো সুবিধা নেই। অবসর সুবিধার জন্য সরকারিদের কোনো চাঁদা জমা দিতে হয় না। এমপিওভুক্তদের মূল বেতনের ৬% দিতে হয়।
সরকারিরা সুবিধাজনক স্থানে বদলির সুযোগ পান। কিন্তু এমপিওভুক্তদের বদলির কোনো সুযোগ নেই। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির সুযোগ না থাকায় শিক্ষকদরকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেতে। পরিবার এবং সন্তানদের দুশ্চন্তিায় অনেক শিক্ষকের মৃত্যুর খবর আমরা প্রায় শুনে থাকি মিডিয়ার কল্যাণে। যেন বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য দ্রব্যমূল্য তুলনামূলকভাবে কম এবং চিকিৎসাসেবা ও বাড়ি ভাড়া অনেক সহজলভ্য। চাকরিতে যোগদান থেকে শুরু করে অবসরজীবন পর্যন্ত পদে পদে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। আরও একটি দুঃখজনক বিষয় হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা এখনো তারা অনুদানের চেকের মাধ্যমে মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন। অনুদান কোনো সম্মানের বিষয় হতে পারে না। আজকের দিনে আমাদের দেশে কোথাও কি ১০০০ টাকায় বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া সম্ভব? এই প্রশ্ন জাতির বিবেকের কাছে রেখে গেলাম।
শিক্ষকদের জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে শুধু শিক্ষকরাই নন, সমগ্র জাতি এর সুফল ভোগ করবে। আমাদের উন্নয়ন ও উন্নতি স্থায়ী হবে। শিক্ষাই যে উন্নতির একমাত্র মাধ্যম তা আমরা সর্বশেষ জাপানের দিকে তাকালেই বুঝি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তখন জাপান সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা করে এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করে জাপান আজকে উন্নত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
শিক্ষকের চোখেই আমরা জগৎ দেখি। মানবসভ্যতা বিনির্মাণে শিক্ষক সমাজের রয়েছে বড় অবদান। আর এ জন্যই যুগে যুগে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা সবার ওপরে। তাকে সম্মান করো যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো। মহান সৃষ্টিকর্তাই তাদের মর্যাদার মুকুট পরিয়েছেন।যেই দেশের শিক্ষক তার ছাত্রদের থেকে কম সুযোগসুবিধা ও সম্মান পান। সেই দেশের শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে, তারই বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. নীলিমা ইব্রাহীমকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে সব প্রটোকল ভেঙে ছুটে গেলেন তার কাছে। পা ছুঁয়ে সালাম করলেন এবং আশীর্বাদ নিলেন। সম্মানিত শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে বঙ্গবন্ধু এভাবেই শিখিয়েছেন তার সন্তানদের।
আর এখনকার দিনে শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, তাদের হুমকি প্রদান ও হত্যা করা এবং লাঞ্ছনার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লজ্জা যে গোটা জাতির। এ দেশে অনেক শিক্ষক হত্যাসহ অনেকবার শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানো এবং তাদের বারবার লাঞ্ছনার শিকার হতে হলেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ঘটনারই বিচার হয়নি। ফলে অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্য কর্মকা- ঘটাতে উৎসাহী হয়ে উঠছে, যা জাতির জন্য চরম আশনিসংকেত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলন, দেশের সম্পদ রক্ষা আন্দোলনসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। দেশ ও জাতির স্বার্থেই শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত থাকলেও বাংলাদেশে এর লেশমাত্র নেই।
শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার পেছনে মূলত তিনটি কারণ দায়ী। প্রথমত, সন্তানদের সামনে অভিভাবকদের নীতিবাচক সমালোচনা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। ফলে শিক্ষকরা এখন আর আগের মতো মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে পাঠদান করেন না। আর তৃতীয়ত, শিক্ষকদের পেশার সামাজিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা নেই। এই বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় এবং শিক্ষারও উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই কর্র্তৃপক্ষের কাছে আবেদন, শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
শিক্ষা সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষা সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। আর এই বিবেক তৈরির কারিগর হলেন শিক্ষক। যারা সর্বজন সমাদৃত এবং পূজনীয়। পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচতে পারে না তেমনি শিক্ষক ছাড়াও শিক্ষা আলোকিত হতে পারে না। যেভাবেই বলি না কেন, সমাজ, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অগ্রগতিতে শিক্ষা এবং শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য।
শিক্ষকরা যখন তাদের বাঁচা-মরার অধিকার প্রশ্নে রাজপথে আন্দোলনে, তখনই শিক্ষকদের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানবিক নির্যাতন। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখি, শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষকদের ওপরে লাঠিচার্জ করা হয়। তখন জাতি হিসেবে আমরা নির্বোধের মতো চেয়ে থাকি। শিক্ষক হিসেবে আমরা কতটা অবহেলিত? শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার সময় এসেছে। জাতিকে শক্ত মেরুদ-ের ওপর দাঁড় করাতে হলে শিক্ষা এবং শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। কারিগর যদি মেধাবী এবং দক্ষ না হয় তাহলে তার উৎপাদনও আশানুরূপ হবে না। জার্মানিতে একজন শিক্ষককে চ্যান্সেলর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শিক্ষকদের বেতন এবং সামাজিক মর্যাদা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির পরবর্তী স্থান। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মধ্যে মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে না পারলে উন্নত দেশ ও জাতি গঠন কখনই সম্ভব নয়।
বেসরকারি শিক্ষকরা এ থেকে মুক্তি চায় এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ হস্তক্ষেপ কামনা করে। আজকের বাজারমূল্যে শিক্ষকদের অবস্থা নুন আনতে পান্থা ফুরানোর মতো। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল নামক একটি মুলা ঝুলছে গত ১০ বছর ধরে। হল মার্কের চার হাজার কোটি টাকা, ডেসটিনির প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাচার হওয়া অর্থ, ঋণখেলাপি এবং কালোটাকার পরিমাণ আমাদের বাজেটের তিন ভাগের একভাগ। গত দশ বছরে শুধু চালের বাজার থেকে দেশীয় লুটেরা হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। এই টাকা উদ্ধার করতে পারলে গোটা দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে।
ব্রিটিশদের মতো আমাদের স্বাধীন দেশের সরকারগুলোও কি দেশের মানুষকে শোষণ এবং কেরানি তৈরি করার জন্য যতটুকু শিক্ষার প্রয়োজন, ততটুকুই দিচ্ছে? শিক্ষা এবং শিক্ষকদের উন্নতি না হলে,সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিৎ করতে না পারলে কোনোভাবেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নত দেশের মানদন্ড অর্জন করতে পারব না।