চারিদিকে দূষণের রাজত্ব চলছে। যে যেভাবে পারছে প্রত্যেকেই তার ব্যক্তি স্বার্থে দুষণ করে চলছে। কখনো কখনো দেখি লোকজন ভাড়া করে দূষণ কাজ পরিচালনা করছে। যেনো কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। পরিবেশ দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা যা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতির পথে একটি বড় বাধা তৈরি করে।
শব্দ দষূণ, বায়ু দূষন, খাদ্য দূষণ, জল দূষণ, সাগর দূষণ, নদী দূষণ, খাল দূষণ, মাটি দুষণ, পাহাড় দূষণ, অফিস দূষণ, পরিবেশ দূষণ। চারিদিকে দূষণের মিছিল। এই দূষণ জীবনযাত্রাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বেড়েই চলছে দূষণের রাজত্ব। দূষণই যেনো আমাদের নিয়তি হয়ে উঠেছে। দূষণের কবলে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবন ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে উঠেছে।
দূষণের প্রভাব অনেকটাই জটিল এবং দুঃখদায়ক। বায়ু দূষণ একে অপরের সামাজিক এবং পরিবেশে প্রভাবিত করতে পারে। জল দূষণ বা জলের দূষণের ফলে জীবজন্তু ও মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং ভূমি দূষণ সমৃদ্ধ মাটি এবং জীববৈচিত্র্যের অবনতির জন্য একটি বড় উত্তেজনা হিসেবে উত্থিত হতে পারে। পরিবেশের ক্ষতি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে তা টেকসই হতে পারে না। পরিবেশ দূষণ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতি বছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণ জনিত অসুখবিসুখের কারণে। প্রধানত কৃষি ও শিল্প কারখানা থেকে প্রসারিত কার্সিনোজেন, কাদামসেন্ট, আমোনিয়া, ফসফরাস, জীবাণুবিদ্যুত ইত্যাদরি কারণে নদী ও হ্রদপ্রদেশে জল দূষণরে মাত্রা বাড়ছে। গাড়ি, কারখানা, বা প্রস্তুত খাবারের কারখানা থেকে মুক্ত হওয়া ধূলো ও জ্বালানিতে পরিবেশের বায়ু দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রধানত শিল্প কারখানা, বাড়ি এবং কৃষি ক্ষেত্রে প্রস্তুত কতপিয় বিষাক্ত পদার্থের প্রসারের কারণে মাটি দূষণ বেড়েছে।
পরিবেশ দূষণের প্রভাব অত্যন্ত বিরূপ। পরিবেশ দূষণের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খড়া, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস ইত্যাদি। বিলুপ্ত হয়েছে অনেক প্রজাতির মাছ, প্রাণি, উদ্ভিদ এবং বিলুপ্তি পথে অনেক উপকারী, উদ্ভিদ, প্রাণি।
পরিবেশ দূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের অবনতির জন্য একে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অপরকে প্রভাবিত করে। এটি মানব স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের সংরক্ষণের জন্য অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এটি সামাজিক, আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক দিকেও অবনতির জন্য দায়ী হতে পারে।
বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের মূল কারণ হিসেবে বায়ু, জল, ও ভূমি দূষণ উল্লেখযোগ্য। গাড়ি যান, কারখানা, বা পরিষেবা সেবা সংস্থাগুলি বায়ু এবং জল দূষণের উল্লেখযোগ্য উৎস। বায়ু দূষণের পরিণামে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা উন্মোচন হতে পারে। জল দূষণ কৃমি, জীবাণু, মেটালস, প্লাস্টিক এবং অন্যান্য পারিবেশিক অপশক্তির কারণে বিভিন্ন রোগের উৎপত্তির কারণ হতে পারে। ভূমি দূষণ কৃমি, টক্সিন, মেটালস, প্লাস্টিক এবং প্রকৃতি সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রভাবিত হতে পারে।
দূষণের শিকার দরিদ্র নারী, শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বায়ু দূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
শিল্প কলকারখানার বজ্য মানব দেহের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। এসব পানি ব্যবহার চর্মরোগ, টাইফয়েড, জন্ডিস বা হেপাটাইটিসের মতো রোগ হতে পারে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে ক্ষতিকর পদার্থ আবার মানব দেহের শরীরে চলে আসে। ফলে সরাসরি দূষিত পানির কাছাকাছি না থাকলেও, সেসব দুষিত পদার্থ এসব মাছের মাধ্যমে মানব দেহে আসে, যার ফলে ত্রুটিপূর্ণ জন্ম বা ক্যান্সার হতে পারে। এমনকি খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢুকছে সীসা, প্লাস্টিকসহ নানা ক্ষতিকর পদার্থ।
পথের শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতিমধ্যেই দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। তারা বধিরতায় আক্রান্ত তো হবেই, পাশাপাশি ক্ষুধামান্দ্য, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করাসহ হৃদ্রোগের সমস্যাও হতে পারে। অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ত্রুটি তৈরি হতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে ব্লাড প্রেশার, শ্বাসের সমস্যা এমনকি হজমের সমস্যার তৈরি হতে পারে।
খাদ্য দূষণের কারণে অন্ত্রের নানা রোগ, লিভার, কিডনি বা পাকস্থলী কার্যকারিতা হারাচ্ছে। গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ নানা সমস্যার তৈরি হচ্ছে। কখনো কখনো এসব কারণে ক্যান্সারেরও তৈরি হচ্ছে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে এ ধরণের দুষিত খাবার খাওয়ার ফলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বা বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। দূষনের বর্তমান পর্যায় মোকবিলা এবং প্রতিরোধ করতে না পারলে আমদের জন্য মহাবিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের মূল উৎস হিসেবে শব্দ, বায়ু, জল, এবং ভূমি দূষণ উল্লেখযোগ্য। শহরের বায়ু দূষণের সমস্যা অত্যন্ত চূড়ান্ত হয়ে উঠছে, যেখানে বায়ু নির্ধারণের ধারা অতিক্রম হচ্ছে। যে কোনও প্রধান শহরে বায়ু গুণমান মানসিকভাবে অবনতির সৃষ্টিতে দায়ী হতে পারে, যেটা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর অত্যন্ত ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।
জল দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে কৃষি কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার , কীটনাশক এবং শিল্প কারখানার বর্জ্য ইত্যাদি। পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। আর বায়ু দূষণের ফলেই ৫৫ শতাংশ অকাল মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস-২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, বায়ু দূষণ, অনিরাপদ পানি, নিম্নমানের স্যানিটেশন ও হাইজিন এবং সীসা দূষণ বছরে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি অকাল মৃত্যুর কারণ। এর ফলে বছরে ৫.২ বিলিয়ন দিন অসুস্থতায় অতিবাহিত হয়। এসব পরিবেশগত কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপির ১৭.৬ শতাংশ সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। ঘরের এবং বাইরের বায়ু দূষণ স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যা ৫৫ শতাংশ অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী এবং যা ২০১৯ সালের জিডিপির ৮.৩২ শতাংশের সমপরিমাণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে। রিজিওনাল ডাইমেনশনে এখন বায়ুদূষণ হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ বাংলাদেশের একটি গুরুতর সমস্যা যা প্রানি, মানুষ, ও প্রাকৃতিক সম্পদ, জীবনকে ধ্বংস করছে। এই দূষণ বিভিন্ন ধরণের উপাদানের প্রসারের ফলে উৎপন্ন হতে পারে কাদামসেন্ট, কার্বন ডাইঅক্সাইড, ফেনিল, লোভারিক, ও আরো অনেক কিছু।
সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য এই দূষণ প্রতিরোধ জরুরী। এই দূষণ রোধ করা সম্ভব না হলে আগামী পাঁচ বছরে এই অকাল মৃত্যুর হার দ্বিগুণ হবে। সময়মতো এবং সঠিক নীতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের ধারা পাল্টে ফেলতে হবে। দূষণরোধে দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন। তা না হলো দুষণের কবলে পড়ে আমরা নিজেরাই একসময় দূষিত হয়ে পড়বো।
পরিবেশের দূষণ ও প্রতিরোধে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আঞ্চলিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। দূষণের সমস্যা সমাধানের জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার, গোষ্ঠী, সংস্থা, এবং ব্যক্তি সবাইকে সচেতন ও পরিবেশবাদী হওয়া প্রয়োজন। পরিবেশের দূষণ এবং তার প্রভাব সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা উন্নয়ন জরুরী। পরিবেশের দূষণ বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতি ও উন্নয়নের পথে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
বায়ু দূষণ নিয়ে সচেতনতা উন্নয়ন এবং শহরে গাড়ির ব্যবহারের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সুস্থ ও উন্নত কৃষিপ্রণালী বিতরণ এবং প্রচলিত পরিবার উন্নত কৃষি পদ্ধতি বেশি উন্নত করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা সহযোগিতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা যাবে।
শিক্ষা বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ব্যাপক পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
অধিক ফলেন লোভে অতিরিক্ত কীটনাশক এবং রাসায়নিক ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরতে হবে। শব্দ দূষণ রোধে আরও কার্যকর এবং উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্লাস্টিক পণ্য এবং পলিথিন ব্যবহারে আরও সচেতন এবং কঠোর হতে হবে। পলিথিনকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে এবং এর বিকল্প নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে আরও কঠোর হতে হবে।
দূষণ থেকে দেশেকে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে, দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে, উন্নয়নকে স্থায়ী করতে রাষ্ট্রের প্রতিটি দপ্তর,অধিদপ্তর, বিভাগ এবং মন্ত্রণালয়সমূহকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত করে সকল লোভেরে উর্ধ্বে থাকতে হবে। তাহলেই হয়তো দুষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠন সম্ভব হবে এবং সেই সাথে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশে রেখে যাওয়া সম্ভব হবে।