যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি গত মঙ্গলবার রাতে গোপনে চীনের তাইওয়ান দ্বীপে অবতরণ করেন। এর মধ্য দিয়ে তাইওয়ান প্রণালি ও চীন-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে তাঁরই পুঁতে রাখা মাইনটির তিনি বিস্ফোরণ ঘটালেন। এই সফরের ধরনটি কতটা বিপজ্জনক এবং পরিণতি কতটা মারাত্মক হতে পারে, সে ব্যাপারে চীন বারবার সতর্ক করে দিয়েছিল। এর পরও পেলোসি বধির হয়ে থাকলেন।
আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারও সফরটি বন্ধ করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিল না। ফলে সফরটি তাইওয়ান প্রণালিজুড়ে নতুন করে উত্তেজনা ও তীব্র চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
এই দফায় গোটা বিশ্ব স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করল, তাইওয়ান প্রণালির স্থিতাবস্থায় কারা পরিবর্তন আনছে, কারা আগ বাড়িয়ে উসকানি দিয়েছে এবং কারা প্রণালির উভয় পারে শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করছে। এটি নির্মম সত্য যে এই তিনটি বিষয় কিছু সময়ের জন্য চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জনমতের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাইওয়ান ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেদের ‘ভিকটিম’ ও সিমপ্যাথি কার্ডে পরিণত করার সুযোগ নিয়েছেন। তাই হঠাৎ করে তাইওয়ানকে ঘিরে আন্তর্জাতিক জনমত ব্যাপকভাবে আলোড়িত হয়েছে।
তবে পেলোসির তাইওয়ান সফরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কালোকে সাদা বলার বাগ্মিতা, তার আধিপত্যবাদী মানসিকতা ও মাস্তানি যুক্তি ও স্বাধীনতার এজেন্ডা বাস্তবায়নে ডিপিপি নেতৃত্বের মার্কিন নির্ভরতার প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। সুতরাং সফরটি ঘিরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের পাল্টা মিথ্যা অভিযোগ মার্কিন মিত্র ও তার অংশীদারদের বোঝাতে পারেনি তারা কী করতে চাচ্ছে। এমনকি তারা যুক্তরাষ্ট্রের আচরণও ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল কিটিং, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং এবং অন্যান্য বিশ্ব নেতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত সৃষ্টির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বিবৃতিগুলো নিঃসন্দেহে পেলোসির আচরণকে সমর্থন করেনি। ডিপিপি নেতৃত্বের সাধারণত শক্তি প্রদর্শনের জন্য কিছু একটা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, যা এই সফরের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
সুতরাং পেলোসির নির্বোধ, বেপরোয়া ও বিপজ্জনক উসকানিমূলক তৎপরতা তাইওয়ান প্রণালিজুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার পুরো দায়দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্র ও ডিপিপি কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ান শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে অশুভ আঁতাত বাড়ার একটি নতুন মাত্রা, যা তাইওয়ান প্রণালির স্থিতাবস্থায় একটি গুরুতর ও ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন আনা এবং চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার প্রদর্শনী। এর ওপর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এক চীন নীতি এবং তিন দফা যৌথ বিবৃতির লঙ্ঘন করার পাশাপাশি এই সফর জাতিসংঘের ২৭৫৮ নম্বর প্রস্তাবকে লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদ তথাকথিত ‘ক্ষমতার বিভাজনকে’ দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টাকে ছদ্মবেশ হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু তাঁদের যুক্তি একেবারেই দানা বাঁধে না।
যেকোনো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ কখনোই তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন করতে বিদেশি হস্তক্ষেপকারী শক্তি ও অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে যৌথভাবে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ দেবে না এবং চীনের মতো একটি বড় দেশ সেটা অবশ্যই করবে না। তাই চীনের মূল স্বার্থ রক্ষার জন্য চীনের গ্রহণ করা যেকোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া বৈধ ও প্রয়োজনীয় এবং একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে তার অধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পাল্টা পদক্ষেপের প্রভাব বেশি হয়ে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে প্রথমেই পেলোসি যে ধরনের বড় ঝুঁকি তৈরি করেছেন, তা অবশ্যই তাঁর ওপর প্রতিঘাত হিসেবে ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্য কথায়, আমাদের উচিত পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে এমন ঝুঁকি সৃষ্টি করা, যাতে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতার অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। আমাদের উচিত পেলোসির মতো লোকদের বুঝিয়ে দেওয়া যে তাইওয়ান এমন কোনো জায়গা নয়, যেখানে তারা চাইলেই সফর করতে পারে। মঙ্গলবার পেলোসি যে বিমানটি ব্যবহার করেছেন, সেটির রুট দেখে বোঝা যায় যে চীনের সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সংশ্লিষ্ট জলসীমায় চলমান সামরিক মহড়া পরিচালনা করার ভয়ে তাঁর বিমানটি দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, চীনের সামরিক প্রতিরোধব্যবস্থা পেলোসিকে বিপদ অনুভব করতে বাধ্য করেছে।
দ্বিতীয়ত, চীনের পাল্টা পদক্ষেপ এইটুকুতেই শেষ হবে না, বরং তা হবে দীর্ঘমেয়াদি, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও অবিচলিত অগ্রসরমাণ পদক্ষেপের সংমিশ্রণ। পেলোসি যখন তাইওয়ানের দিকে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই পিএলএর এয়ার ফোর্স তাইওয়ান প্রণালি অতিক্রম করার জন্য তাদের এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান পাঠায়। পিএলএর ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড মঙ্গলবার রাত থেকে দ্বীপটির উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যৌথ নৌ ও বিমান মহড়া, তাইওয়ান প্রণালিতে দূরপাল্লার আর্টিলারি শুটিং এবং দ্বীপের পূর্ব দিকে সমুদ্র অঞ্চলে প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মহড়ার মাধ্যমে তাইওয়ান দ্বীপের চারপাশে যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এ ছাড়া পিএলএ বৃহস্পতিবার (আজ) থেকে আগামী রবিবার পর্যন্ত তাইওয়ান দ্বীপকে ঘিরে লাইভ-ফায়ার মহড়াসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মহড়া এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
তাইওয়ান প্রণালির ‘মধ্যবর্তী লাইন’ কার্যত ভেঙে ফেলা থেকে শুরু করে তাইওয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিম ‘আকাশসীমা’ এবং দ্বীপটির চারপাশে বৃত্তাকারে পিএলএর নিয়মিত বিমান টহল এটাই স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে তাইওয়ান প্রণালি আন্তর্জাতিক জলসীমা নয়। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের প্রতিটি উসকানিমূলক পদক্ষেপের বিপরীতে তাইওয়ান প্রণালির ওপর মূল ভূখণ্ডের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
তৃতীয়ত, চীনের পাল্টা পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় পুনর্মিলনের প্রক্রিয়াকে উন্নীত করা। মাতৃভূমির পুনর্মিলন অর্জনের সময় ও গতি সর্বদা দৃঢ়ভাবে আমাদের নিজের হাতে রয়েছে। তাইওয়ানকে সমর্থন করার জন্য এবং মূল ভূখণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন, পেলোসির মতো শক্তিগুলো এই ঐতিহাসিক ও আইনি সত্যকে পরিবর্তন করতে পারবে না যে তাইওয়ান চীনের অন্তর্গত। এ ছাড়া তারা চীনের সম্পূর্ণ পুনর্মিলন উপলব্ধি করার প্রবণতাকেও বাধা দিতে পারে না। এটা মনে রাখা উচিত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহিঃশক্তি ও ডিপিপি নেতৃত্ব প্রতিটি পদক্ষেপের মাধ্যমে যতই তাদের গোপন আঁতাত ও উসকানির পরিমাণ বাড়াক না কেন, চীন আরো দ্রুত পুনর্মিলনকে অনুভব করবে।
‘উপদ্রবের রাজনৈতিক দেবতা’র মতো পেলোসি তাইওয়ানে ঝুঁকি ও উত্তেজনা আনা ছাড়া এ অঞ্চলের জন্য কোনো ভালো কাজ করেননি। তাইওয়ানের কিছু মিডিয়া প্রকাশ করেছে যে ডিপিপি কর্তৃপক্ষ গোপনে পেলোসিকে দেওয়া তাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নিয়েছে; কিন্তু মার্কিন রাজনীতিবিদের ভয়ে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা তারা ঠিকই অব্যাহত রাখে। এই সংবাদটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, কারণ এটি ডিপিপি কর্তৃপক্ষের নিচু ও জঘন্য মানসিকতা এবং তাইওয়ানের প্রতি পেলোসির গোঁয়ার্তুমি ও স্বার্থপর মনোভাবকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। সুতরাং এই সফর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্কের একটি সত্যিকারের মাইক্রোকোজম (বড় কিছুর ক্ষুদ্র প্রকাশ)।