পত্রিকা, ক্যটালগ, স্যুভিনির সংগ্রহ করা আমার একটা বাতিকের মত। যদি কোনদিন কোন কাজে লাগে। ফলে এ সম্পদ আমার অনেক। এজন্য অনেকের কাছে আমি নন্দিত, আবার অনেকের কাছে নিন্দত। কিন্তু কি করব ‘দোষ যায় না মোলে’ ফেলবো বলে মাঝে মাঝে বাছাই করতে বসি, কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে তা কমে না। মনে হয় এটাতো একটি ইতিহাস, যদি কোনদিন মনে হয় ওটা কাজে লাগবে তাহলেতো আর কোথাও পাবো না।
এভাবেই কিছুদিন আগে চোখের সামনে উঠে আসে ১৯৮৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর প্রকাশিত “ঢাকা ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানের দিপ্র গাথা” ক্যাটালগটি। ঢাকা নগর জাদুঘর আয়োজিত আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের প্রদর্শনী ক্যাটলক। প্রচ্ছদে স্লোগানরত সেই কিশোরের ছবিটি।
এই ছবিটি এর আগে নানা ভাবে নানা জায়গায় আমি দেখেছি, কিন্তু এবার মনের মধ্যে কাজে লাগার অনুমানটা একটু দুলে উঠলো। টেবিলের উপরে চোখের সামনে রেখে দিলাম।
মনে পড়ছিলো যখন প্রদর্শনী দেখেছি তখন শুনেছিলাম এই ছবিটি তোলার পর সেই মিছিলে গুলি হয়েছিল এবং সেখানেই ছেলেটি মারা যায়। এটাই এতোদিন জেনে এসেছি, সবাই তাই জানতো সে জন্যই হয়তো কেউ আর তাকে নিয়ে ভাবেনি। তাই কেউ তাকে কোন খেতাব দেয়নি। যেমন আসাদ, মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক এর নামের সাথে আমরা শহীদ খেতাব যুক্ত করেছি। ওর কোন খেতাব নেই কারণ বাংলাদেশের স্থপতি ওর নাম দিয়েছিলো ‘পালোয়ান’।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে আত্মগোপনে চলে যাওয়া সেই পালোয়ান ৫৪ বছর পরে বেরিয়ে এসেছে মানবজমিন এর অনুসন্ধানে, এখন জানি তার নাম ‘হোসেন আলী’।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেড়িয়ে এসেছি কিন্তু এমন বাস্তব সত্যকে নামহীন ভাবে আর কতদিন বয়ে বেড়াতে পারতাম আমরা? অনেকের কাছে শুনেছি এই ছেলেটি সেদিন অবিস্মরনীয় সেই স্লোগানটি দিচ্ছিল “কেউ খাবেতো কেউ খাবেনা, তা হবে না, তা হবে না।” এই স্লোগানটি নাকি এর আগে কেউ কোথাও শোনেনি। পাঠক একটু ভেবে দেখুন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার দাবিগুলো এই স্লোগান এর মধ্যে এক লাইনেই প্রকাশ পেয়েছিল কি? যা পাকিস্তানিরা সহ্য করতে পারেনি।
৬৯ সালের এই ছেলেটির বয়স ছয় কি সাত, মানে ৭১এ আট-নয় বছর, আমার বয়সের। নিজের ছেলেবেলা মানে ৭১’এর কথা মনে পড়ছে।
পিরোজপুর শহরে ২৫শে মার্চ এর পরে পাকিস্তানি আর্মি আসার আগেই শরণার্থী হয়ে আমরা তুষখালি নানার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। এক বৃষ্টির দিনে খালের পাড়ে গ্রামের ছেলে সেলিম, মামা সিদ্দিক ও খালাতো ভাইদের সঙ্গে খেলছিলাম আর কাঁচা বিলাতি গাবের বিচি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ খালে একটি মৃতদেহ ভেসে আসলো। পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়া মানুষটির হাত পিঠের দিকে বাঁধা। আমার কিশোর মন যেন সারা জীবনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেছে। মৃত মানুষের লাশ ভেসে যায়, দাফোন হয়না? স্বাধীনতা চাইতে গিয়ে একজন মানুষের এই পরিণতি! হতভম্ব হয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। এখনো বৃষ্টির দিনে লাল কিছু চোখে পরলে ওই লাশ দেখার হৃদকম্পন অনুভব করি, আমার শরীর কেঁপে ওঠে।
এদিকে আব্বা চাকরিতে জয়েন করেছেন, কারণ সরকারি চাকরি, বাসায় একা। তাই আমরা আবার জুন মাসে পিরোজপুরে ফিরে এলাম। আমাদের বাসা ততদিনে লুট হয়ে গেছে, কেবল আগুনটা দেওয়া হয়নি, যেদিন আগুন দিতে আর্মিরা এসেছিল সেদিন পাড়ার চাচা ‘আনোয়ার মোল্লা’ এটা মুসলমানের বাড়ি বলে প্রমাণ করেছিল। পাকিস্তানি আর্মিদের জানানো হয়েছিল এ দেশের স্বাধীনতাকামী সকল মানুষ হিন্দু। শহরের অন্যান্য সব মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি আগেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা রাজাকারদের সহায়তায়।
বাসায় এসে প্রথম রাতেই আব্বার কাছ শুনেছিলাম পাকিস্তানিরা নির্বিচারে মানুষ মারছে, যখন যেখানে যেভাবে পাচ্ছে। আব্বা জানালেন কয়েক দিন আগে আমাদের বাসার পিছনে ধান ক্ষেতের মধ্যে একজন মানুষকে পানি পানি করে কাতরাতে শুনেছিল অনেকে, কিন্তু গুলিবিদ্ধ এই মানুষটির কাছে কেউ সহযোগিতার জন্য যায়নি, নিজ জীবন বিপন্ন হওয়ার ভয়ে।
পরের দিন বিকালেই নদীর পাড়ে গুলির শব্দ শুনলাম। খেয়া ঘাট থেকে আর্মিরা চলে গেলে দোকানদার ও খেয়ামাঝিরা বের হয়, তাদের দেখে অনেকের সাথে আমিও খেয়া ঘাটে যাই। গিয়ে দেখি তিন চারজন গুলিবিদ্ধ মৃত মানুষ পানিতে পড়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে নদী। একজন দৌড়ে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল, তাকেও চৌধুরীদের বাগানের মধ্যে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। গুলি বুকের ভেতর থেকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে, নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে তা দেখলাম। খেয়া মাঝিদের কাছে শুনলাম এই দৃশ্য নিত্যদিনের। কতদিন চলবে? হয়তো দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত, কে জানে। এভাবে মানুষের জীবনাবসান! কিন্তু কি চেয়েছিল এদেশের মানুষ, বাংলা ভাষা আর একটা শোষণহীন স্বাধীন দেশ।
শহরটা চলছে শুনশান, আতঙ্কিত মানুষরা শহরে বের হলেও দ্রুত ফিরে যায় বাসায়। এক নীরব অন্ধকার সবাইকে গ্রাস করে ফেলেছে। গভমেন্ট স্কুলর এক দিকে ক্লাশরুম, অন্য দিকে আর্মির ক্যম্প। সামনে এসডিও ওফিস, টর্চার সেল। আমার মেঝে ভাই রোজ ঐ সব বিভৎস দৃশ্য দেখে বাসায় চুপচাপ বসে থাকে, মাঝে মাঝে আমাকে বলে। আমি উত্তরপাড়া ইস্কুলে পড়ি, বাসা থেকে অনেক দুরে, একা একা যাই, আমার দুরন্তপনায় বাসার সবাই চিন্তিত, তাই ঐ স্কুলে আম্মা পাঠাতে চায় না। কিছু দিনের মধ্যেই আমাকে উত্তরপাড়া স্কুল থেকে বাসার সামনে আদর্শ স্কুলে ভর্তি করা হয়।
আমার দুরন্তপনা তাতেও থামেনি, আমি আর শাহান (ওর বাবা ম্যালেরিয়া অফিসার ছিলেন) প্রায় প্রতিদিন স্কুলে মান্নান স্যারের কাছে শাস্তি পেতাম, কারণ আমরা আমাদের বাসার সামনের স্কুলের সীমানায় পিঠা সড়া গাছের উঠে চিৎকার করে “আমার সোনার বাংলা” গানটা গাইতাম। গাছের অনেক উপরে উঠতাম যেন অনেক দুর থেকে পাড়ার সবাই শুনতে পায়। মান্নান স্যার বলতেন, তোর জন্য একদিন আমরা সবাই পাকিস্তানীদের হাতে মারা পারবো।
আমার একটা প্লাস্টিকের ফুটবল ছিল ওটা দিয়ে পাড়ার সবাই আমাদের বাসার পাশের মাঠে খেলতাম। খেলা শেষে রাস্তার পাশের পুকুরে অনেকক্ষণ গোছল করতাম। সাঁতার না জানলেও চলত, কারণ ওখান পানি ছিল হাঁটু সমান।
একদিন দেখি রাইফেল নিয়ে টহল দিতে এসে তিন চার জন আর্মি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখছে। হঠাৎ করে আমাদের খেলাঘুরে গেল। কেউ একজন বল দূরে ফেলে দিয়ে বলল, আয় জয় বাংলা জয় বাংলা খেলি। একদল জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা চাইবি, অন্যদল হাতে বন্দুক নিয়ে তাদেরকে পাকড়াও করে পুকুরে গুলি করে মারবে, ঠিক প্রতিদিন যেমন নদীর পাড়ে মানুষ মারা হতো। খেলা ঘুরে যেতেই আর্মিদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল, কারণ জয় বাংলা শ্লোগান চলছে ওদের সামনে, তবে কৌতুহলী চোখে অপেক্ষা করছে এবার কি করি দেখার জন্য। একজনকে পুকুর পাড়ে এনে নিজেদের বানানো উর্দুতে জিজ্ঞাস করা হতো, ‘তুম মুক্তি হ্যায়?’ হ্যা আমি মুক্তিবাহিনী। ‘তুম স্বাধীন বাংলা চায়েগা?’ স্বাধীন বাংলা চাই। নেহি, বোল পাকিস্তান জিন্দাবাদ। না, জয় বাংলা, জয় বাংলা। সাথে সাথে আংগুলের বন্দুক দিয়ে গুলি করে, আর আমরা নদীতে পড়ে যাওয়ার মত করে পুকুরে পড়ে যাই। আর্মিরা হেসে ওঠে। বুঝতেই পারেনা ওদের নিয়ে কত বড় ঠাট্টায় মেতেছি আমরা।
কিন্তু খেলা থামে না আবার পুকুরের ওপর দিয়ে উঠে স্লোগান দেই আবার গ্রেফতার হই, এভাবেই চলতে থাকে, আর্মিরা চলে গেলে এ খেলা বন্ধ হয়।
আবার একদিন আর্মি আসলে খেলা ঘুরিয়ে জয় বাংলা খেলা আরম্ভ করি। দ্বিতীয় দিনের খেলার ধরণ কিছুটা ভিন্ন, এদিন আমাদের আর্মিরা গুলি করছে না, বারবার প্রশ্ন করছে, আর মুক্তিযোদ্ধারা গলা ফাটিয়ে বারবার জয় বাংলা বলতে থাকে। ওই দিন পাকিস্তানি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, গম্ভীর হয়ে নদীর পার দিয়ে খেয়াঘাট হয়ে শহরে চলে যায়। এখন মনে মনে ভাবি কেন সেদিন এতটা করেছিলাম? একটুও ভয়ের তোয়াক্কা না করে!
প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে কেমন যেন সব গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। জয় বাংলার খেলার কয়েকদিন পর মিলু, মজনু ভাই আমি কামরুল সহ অনেকে মুচি বাড়ির একটু আগেই নদীর পাড়ে দাড়িয়ে মানুষ মারা দেখছিলাম। আমরা খেলে ছিলাম মিথ্যা মিথ্যা খেলা, আর ওরা সত্যি সত্যি মৃত্যু নিয়ে খেলছে। একজন আমাদের দেখে এমন ভাবে গুলি চালিয়েছিল যেন আমরাও তার টার্গেটে পড়ে যাই, আমাদের খুব কাছে থেকে গুলি যাওয়ার শব্দ পেলাম, লাফদিয়ে বাগানের মধ্যে ঢুকে গেলাম। মনে হয়েছিল আমাদের চিনেছে। কেন করছিলাম এমন?
প্রতিদিন আম্মার সাথে খেয়াঘাট এসে লাশ দেখতাম কারন ভাইয়া যুদ্ধে গেছে, তাই নদীর পাড়ে কাকে মারা হল তা আম্মার দেখতেই হবে, সে দিন হোক বা রাত বারোটা হাক।