সুস্থ দেহে সুস্থ মন। ক্রীড়াই শক্তি , ক্রীড়াই বল, ক্রীড়াতে বিশ্বজয়। জীবনের জন্য খেলাধুলা, জীবনের জন্য শারীরিক শিক্ষা। খেলাধুলা সম্পর্কে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জিনিস হল এটি মানুষকে একত্রিত করার ক্ষমতা।
খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষাই একটি অন্যতম মাধ্যম যার মাধ্যমে শারীরিক এবং মানসিক পরিপূর্ণ সুস্থতা ও বিকাশ সাধন সম্ভব আবার সম্ভবত পৃথিবীতে আমারই একমাত্র দেশ যেখানে খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলার মাঠ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। খেলাধুলা এখন শুধু প্রতিযোগিতা না, খেলাধুলা এখন অন্যতম বিনোদনের উপকরণ হলেও এর প্রতি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা আগ্রহ হারাচ্ছে। শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ কোন বিষয় নয় বরং এটি একটি জাতির জন্য সুখ-সমৃদ্ধি, খ্যাতি-যশ-সম্মান অর্থনৈতিক উন্নতি বয়ে আনে। আর এই ভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে একটি সুস্থ জাতি গঠন করা কখনো সম্ভব হবে না। খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষার সামাজিক গুরুত্ব অনেক বেশি যদিও আমাদের দেশে তা উপেক্ষিত।
শারীরিক শক্তি ও মানসিক চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিমত্তা বিকাশে লেখাপড়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে খেলাধুলা। খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক বিকাশসহ বিভিন্ন উপায়ে শিখতে এবং বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। খেলাধুলা শিশুদের সৃজনশীলতা এবং কল্পনা বিকাশেও সহায়তা করে। সুস্থ জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষা আর খেলাধুলার ভূমিকা অনস্বীকার্য। খেলাধুলা শুধুমাত্র শারীরিক কার্যকলাপই নয় খেলাধুলা এক উন্নত শিল্পও। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে। সুস্থ দেহ ও মন কাজের প্রতি আগ্রহ এবং কাজের গতি বাড়ায়। আর দেহ ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। খেলাধুলার মাধ্যমে একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা লাভের পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও নেতৃত্বের গুণ অর্জন করে। কিন্তু আমাদের দেশে খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকার ফলে বর্তমান প্রজন্ম হচ্ছে শারীরিকভাবে দুর্বল ও মানসিকভাবে বিষন্নতায় ভোগে, বিপথগামী হয়ে উঠে, মাদকাসক্ত হয়ে উঠে এবং নিজেদের কিশোর গ্যাং এর সাথে যুক্ত করছে আবার অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে।
অত্যন্ত কার্যকর একটি শারীরিক শিক্ষা কর্মসূচির লক্ষ্য হল দক্ষতা, জ্ঞান, শারীরিক সুস্থতা এবং আত্মবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে শারীরিক সাক্ষরতা বিকাশ করা। শারীরিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম শিশুদের সুস্থ বিকাশে উৎসাহিত করে, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ এবং খেলাধুলায় আগ্রহকে উৎসাহিত করে, স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষার ধারণাগুলি শেখার উন্নতি করে, এবং প্রতিটি শিশু স্বাস্থ্য সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করার জন্য ছাত্র জনসংখ্যার মধ্যে পার্থক্যগুলিকে মিটমাট করে। এই মূল নীতিগুলি খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, ক্রীড়া দক্ষতা উন্নয়ন, শারীরিক সুস্থতা ও স্বাস্থ্যের জ্ঞান, সেইসাথে মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক অভিযোজনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যে হারে আমাদের দেশের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মোবাইল আসক্ত হচ্ছে তাতে আমাদের সামনে একটি শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থ জাতি অপেক্ষা করছে । শিক্ষার্থীরা এখন মাঠে যেতে যায় না। তারা এখন স্ক্রীনে আসক্ত হয়ে উঠেছে। যা আমদের কোন ভাবেই কাম্য নয়। আমাদের দেশে একদিকে খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষা হ্রাস পাচ্ছে আর অন্যদিকে ডায়োববেটিকস, হৃদরোগসহ নানারকম শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় দক্ষ পরিকল্পনার অভাব স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি। খেলাধুলার ক্ষেত্রে আমরা স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতিকে পরিহার করতে পারলে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে আমরাও খেলাধুলায় এগিয়ে যাবে অনেক দূর।
এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই জিডিপির ২-৩% প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে ১০% পর্যন্ত অবদান রাখতে সম্ভব। স্কটল্যান্ডের জিডিপির ২.২৫% যুক্তরাজ্যে জিডিপির ২.২০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপির ২.৫০% এবং কানাডা নিউজিল্যান্ডে জিডিপির ১.৫% খেলাধুলার প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে। যে কোনো কাঠামোগত এবং/অথবা পুনরাবৃত্তিমূলক শারীরিক কার্যকলাপ সম্পাদিত বা অনুশীলন করা হয় যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য হল উন্নত শারীরিক সুস্থতা অর্জন করা। খেলাধুলা ভিত্তিক পদ্ধতির সম্ভাব্যতা ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারে উন্নয়নের ফলাফল আন্তর্জাতিক নীতি জুড়ে স্বীকৃত হয়েছে ঘোষণা, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে টেকসই জন্য ২০৩০ এজেন্ডা উন্নয়ন। করতে টেকসই উন্নয়নে খেলাধুলা ভিত্তিক নীতির অবদান, শারীরিক কার্যকলাপ এবং শারীরিক শিক্ষা নীতি এসডিজিতে মুখ্য খেলাধুলার টেকসই উন্নয়ন, শারীরিক শিক্ষা এবং শারীরিক কার্যকলাপ নীতি এবং গঠনমূলক এবং সমষ্টিগত উভয় নীতির জন্য দক্ষ পরিকল্পনা এবং নকশা প্রয়োজন। শারীরিক শিক্ষা, শারীরিক কার্যকলাপ এবং খেলাধুলায় বিনিয়োগ। খেলাধুলা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বিস্তার করে, গবেষণা ও উন্নয়ন, ক্রীড়া পর্যটন, ক্রীড়া পণ্য বিক্রয় এবং বাণিজ্য, নির্মাণ এবং ক্রীড়া স্থান রক্ষণাবেক্ষণ, সংগঠন ক্রীড়া ইভেন্ট, এবং বিপণন এবং বিজ্ঞাপন. এটাও সৃষ্টি করে বিভিন্ন চাকরি এবং ব্যবসার সুযোগ (যেমন ইঞ্জিনিয়ার এবং ডেভেলপার, মডেলিং, কোচ এবং স্পোর্ট ডাক্তার, খেলাধুলা সাংবাদিক এবং ভাষ্যকার, ক্রীড়া সামগ্রী এবং সরঞ্জামের খুচরা বিক্রেতা ইত্যাদি)। ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের উপর অসুস্থ স্বাস্থ্যের বোঝা কমানো। উপরন্তু, এটি অন্যদের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে শিক্ষা, রিয়েল এস্টেট এবং পর্যটনসহ প্রায় সকল সেক্টর।
খেলাধুলা শীর্ষস্থানীয় মূলধারার কার্যকলাপের মধ্যে স্থান পেয়েছে অর্থনীতিতে ক্রীড়া পর্যটন দেখায় যে আনুমানিক $৩ বিলিয়ন প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি হয়েছিল বিদেশী পর্যটনের মাধ্যমে ২০১৫ সালে ৮৩টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এবং মাল্টিস্পোর্ট গেম। এই ৮৩টি ঘটনা ইভেন্ট থেকে ১.৭ মিলিয়নেরও বেশি বেড নাইট এবং $৪৩৭ মিলিয়ন প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি করেছে অংশগ্রহণকারী এবং মিডিয়া একা। ক্রীড়া শিল্প বছরে ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বৈশ্বিক জিডিপির ১ শতাংশের মতো আয় করে। যখন খেলাধুলার সামগ্রী, পোশাক, সরঞ্জাম, এবং স্বাস্থ্য এবং ফিটনেস খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিশ্বব্যাপী ক্রীড়া বাজার ২০২২ সালে $৪৮৬.৬১ বিলিয়ন থেকে ২০২৩ সালে $৫১২.১৪ বিলিয়ন হয়েছে। যে বাজারে পাওয়া গেছে ক্রীড়া ইভেন্টের জন্য (অর্থাৎ টিকিট, মিডিয়ার অধিকার এবং স্পনসরশিপের জন্য আয়) মূল্য US$৮০ বিলিয়নের কাছাকাছি। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ, যা বেশিরভাগ দেশের জিডিপির চেয়ে দ্রুত। বাজার গবেষণা সংস্থা আশা করে যে এই সংখ্যাটি ২০২৭ সালের মধ্যে $৬২৩.৬৩ বিলিয়নে পৌঁছাবে।
খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষার সুবিধা , অর্থনৈতিক উন্নয়ন , সমৃদ্ধি, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রতি এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও দক্ষ একটি জাতি গঠনে খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষার বিকল্প কিছু হতে পারে না। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার স্তরগুলোতে খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন তা না হলে বছরে দুই –চারটি টুনার্মেন্টের আয়োজন করা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শারীরিক শিক্ষার একজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক থাকা সত্বেও শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলা চরমভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত, বিশেষ করে কলেজ পর্যায়ে । কলেজ পর্যায়ে শুধু শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলাই অবহেলিত নয় কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকরা ( শরীরচর্চা শিক্ষকরা ) চরমভাবে অবহেলিত। তারা অশিক্ষক । কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি চালুর মাধ্যমে এই বিষয়ের শিক্ষকদের প্রভাষক পদমর্যদায় উন্নত করে তাদের মেধা এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটনোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মেধা, শারীরিক, মানসিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব। আর যার ইতিবাচক ফল ভোগ করবে সমগ্র জাতি। শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকদের মেধা এবং দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারলে আমরা আগামী দিনে একটি শারীরিক , মানসিকভাবে সুস্থ , দক্ষ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ একটি দেশ গঠন করতে পারবো। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সরকারও জীবনের জন্য খেলাধুলা এবং জীবনের শারীরিক শিক্ষা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন, একটি দক্ষ এবং কার্যকর পরিকল্পনা করে সামনের দিকে এগিয়ে নিবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।