বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন কৃত্রিম সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান অবনতি ঘটেছে।
ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবের মুখোমুখি হওয়ার ফলে জনগণ নাজেহাল হয়ে পড়ছে। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং নানাবিধ সংকটের মুখে দেশের জনগণের ক্রয় ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এই সমস্যার প্রভাব বিশাল। বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, এবং আয়ের অসমতা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলছে। এর সাথে যোগ হয়েছে কৃত্রিম সংকট, যা জনগণকে নাজেহাল করে তুলেছে।
এই তো সেদিন চা খাওয়ার জন্য বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি চায়ের দোকানে ঢুকলাম। একটি টেবিল খালি আছে দেখে সেখানেই বসে পড়লাম। বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আশেপাশের টেবিলগুলোতে দেখি সবাই যে যার মতো করে কথা বলছিল। পাশের টেবিলে একজন আরেক জনকে বলছে ভাইরে আর বাঁচবো না ! বাঁচার রাস্তাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। পাশের জন বলেছেন কেন কি হয়েছে আপনার ? বড় কোন অসুখ হইছে নাকি? না-রে ভাই অসুখ-বিসুখ তেমন কিছু না। তাহলে ! ভাই যে হারে চাল, ডাল, তেল, আলু-পোটল, আটা, ময়দা, চিনি, সুজি, ডিমসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে না খেয়ে মরা ছাড়া উপায় নাই। আয়ের সাথে ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেতে পারছি না। চাল কিনলে ডাল কিনতে পারছি না, আবার ডাল কিনলে লবন, তেল কিনতে পারি না। কবে যে মাছ-মাংস খেয়েছি তাও ভুলে গেছি। জীবন বাঁচাতে গিয়ে প্রতিদিনই ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছি।
এলাকার প্রায় ৯০ভাগ পরিবার কোন না কোন এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নেওয়া। প্রায় সবাই এনজিও কিস্তি চালাচ্ছে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই শুনি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এখন ১ কোটি মানুষ ভোগ করছেন আর সতেরো কোটি মানুষ হা করে তাকিয়ে আছেন। জীবন আজ কালো ধোঁয়ার মত অন্ধকার। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আজ নাগালের বাহিরে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির দৌড়ে পিছিয়ে আছি আমরা সাধারণ মানুষ। যাদের নূন আনতে পান্থা ফুরোয়।
সাধারণ জনগণ বেশি কিছু চায় না। চায়শুধু মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের নিশ্চয়তা। সতের কোটি মানুষের জন্য গড়ে প্রতিদিন প্রায় চার কোটি কেজি চাল লাগে। প্রতি কেজি চালে যদি নূন্যতম দশ টাকা করে অতিরিক্ত ব্যবসা করে তাহলে দৈনিক অতিরিক্ত লাভ করে চল্লিশ কোটি টাকা এবং এক মাসে অতিরিক্ত লাভ করে এক হাজার দুইশত কোটি টাকা এবং এক বছরে অতিরিক্ত লাভ করে চৌদ্দ হাজার চারশত কোটি টাকা। আমাদের ব্যবসায়ীরা শুধু সিন্ডিকেড করার পাশপাশি খাদ্যে ভেজাল, কীটনাশক,ক্যামিক্যাল মেশানোর মতো জগন্যতম অপারাধের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলছেন।
দিন দিন শ্রেণি বৈষম্য প্রকোট হচ্ছে , বাড়ছে হতাশা , নৈরাজ্য , ঘুষ , দুর্নীতি , লুটপাট , আয় বৈষম্য। আর তাই এক শ্রেণির মানুষ দিন দিন আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হচ্ছে। রাতের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের সচল গতিশীল অর্থনীতি। সিন্ডকেট জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, পারিবারিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করে। এর ফলে পাবিবারিক কলহ, ভাঙ্গন এবং দন্ধ-সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোন সভ্য দেশে এই সিন্ডিকেট থাকতে পারে না। যেই সিন্ডকেটের কারসাজির কারণে এই দুর্ভোগ এবং সংকট, গুটিকতক সিন্ডকেট কালোবাজারীর হাতে সমগ্র জনগণের দীর্ঘশ্বাস। কোন সভ্য মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। গোটা দেশ , দেশের আঠারো কোটি মানুষ জিম্মী হয়ে পড়েছে এই সিন্ডকেট কারসাজিদের কাছে।
মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য এক নম্বরে। নিয়মিত রোজগার দিয়ে এই চাহিদা মেটাতে পারছেন না অনেক মানুষ। খাদ্য ঘাটতি পূরণে ঋণ করতে হয় দেশের ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারকে। বছরে গড়ে ৪৯ হাজার টাকা ঋণ করে থাকে এসব পরিবার। আত্মীয়, মহাজন এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে পরিবারগুলো। সেই হিসাবে, দেশের ৪ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ঋণ করে খাদ্যঘাটতি মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাতে নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা অর্জন নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া অনুচ্ছেদ ১৮(১)-এ বলা হয়েছে, জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে।
খাদ্যপণ্যসহ মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, সে হারে মজুরি বা আয় বাড়েনি সাধারণ মানুষের। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যে কোনো পেশার চেয়ে কৃষিজীবী পরিবারগুলোয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি। কৃষিকাজের মাধ্যমে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে দেশের এমন ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যও। ছেলে মেয়েদের শিক্ষা উপকরণ সামগ্রিও বই, খাতা, কাগজ, কলম, পেন্সিল, ইরেজার ইত্যাদির দামও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবহন ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ায় প্রয়োজনেও বাহিরে যেতে তিন বার ভাবি। নদী খেকো, বালু খেকো, বন খেকো, পাহাড় খেকোদের দৌরাত্বে অতিষ্ট আমাদের জীবন। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ভাই শুধু যে না খেয়ে মরবো তা নয়, অশিক্ষিত হয়ে, অশিক্ষিত রেখেই মরতে হবে।
সিন্ডিকেটদের কবলে শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যই নয়, বন্দি দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা। ডেঙ্গুকে কেন্দ্র করে ১০০টাকার স্যালাইন ৫০০টাকা থেকে ১০০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন খরচ নেই কিংবা উৎপাদন খরচ একেবারেই কম সেসবের দাম কীভাবে আকাশছোঁয়া হয়, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। সিন্ডকেটের কবলে বন্দি ৩০লক্ষ শহীদেরে জীবনের বিনিমিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশের সর্বত্র সিন্ডকেটদের দৌরাত্ব। ধান, চাল, চামড়া, পিঁয়াজ এবং মৌসুমী সবজিসহ সবখানেই সিন্ডকেটদের কারসাজি। এই সিন্ডিকেট আমাদের উন্নয়ন এবং অর্জনগুলোকে দিনের পর দিন প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে।
দেশে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এক ধরনের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে এবং গুজব রটানোর মধ্য দিয়ে চোখের সামনে দিনের আলোতে পকেট কেটে নিয়ে যায় আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা। আমরা অসহায়ের মত চেয়ে রই। কিছুই বলতে পারি না। প্রয়োজনের সামনে জিম্মি করে হাত পা বেঁধে কুটকৌশলে আমাদের সর্বস লুটে নিচ্ছে ডাকাত সিন্ডিকেটের দল। সিন্ডিকেটের প্রভাবে বেড়েছে পারিবারিক কলহ, ভাঙ্গন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, আত্মহত্যা। আমাদের উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, আমাদেরর অর্থনীতি এবং অর্জনগুলোকে গতিশীল রাখতে হলে সিন্ডিকেট ভাঙ্গার বিকল্প নেই। যারা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, যাদের ঘাম এবং মেহনতে এদশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে সেই কৃষক ও শ্রমিকের অধিকারের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে তারা অধিক উৎপাদনে আগ্রহী হয়। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে, কৃত্রিম সংকট থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে, দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে এবং সমৃদ্ধির চাকা সজল রাখতে সিন্ডিকেট ভাঙ্গা এবং বিদেশে টাকা পাচার রোধের কোন বিকল্প নেই।
রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক এবং প্রসাশনিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে আরো শক্তিশালী এবং সক্রিয় করার পাশাপাশি ভোক্তা অধিকারকেও আরো বেশি কার্যকর করে তুলতে হবে। আমরা সিন্ডিকেট মুক্ত দেশ চাই। ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চিয়তা চাই। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা চাই।