কোন রকম নিয়ম না মেনে অন্যদের সততার ছবক দেয়া আইজিপ বেনজীর নজিরবিহিন অপরাধ করে নিজের বাহিনীর ভয়ে আত্মগোপনে বে-নজীর! কু-পথে অর্জিত সম্পত্তির নিচে চাপা পরা বেজী. পুলিশের থেকে পালিয়ে বাড়াচ্ছে সাবেক মহাপরিদর্শক। এখন সে সম্পদের অনুসন্ধান করতে ঘুম থেকে জেগেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এক দিকে অনুসন্ধান চলছে, কিন্তু ঘুম থেকে মাত্র জেগে ওঠায় দুদক চোখ খোলার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে সাবেক এই পুলিশ কর্তা বেজী।
সে এখন কোথায়? এবং পালালো কীভাবেই তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না কেউ।
সর্বস্তরে ঘুড়ে বেড়ানো প্রশ্ন, তদন্ত শুরু হলে সে দেশ থেকে বেড় হলো কী ভাবে! নাকি তাকে রক্ষা করার জন্যই এই তদন্ত তদন্ত খেলা? যদি খেলা না হয় তবেতো আগে তাকে আটক করা উচিৎ ছিলো।
সরকার যদি তার বিচার সত্যিই করতে চায় তবে তাকে জনগনের সামনে উপস্থিত করুক।
এখন প্রায় সবাই জানি ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে চেপে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে সাবেক এই পুলিশ কর্তা।
কোনো কোনো মাধ্যম বলছে, বেনজীর সিঙ্গাপুর আছে। আবার কেউ বলছে সে বর্তমানে দুবাইয়ে আছে।
এর মধ্যে আবার খবর বেড়িয়েছে তুরস্কে নিজের বাড়িতে আছে অভিযুক্ত সাবেক এই আইজিপি।
আসলেই সে কোথায় আছে তা নিয়ে কাটছে না ধোঁয়াশা।
আবার অনেকে সন্দেহ করছে কোন এক মহা শক্তিশালী গডফাদের তত্তাবধানে দেশেই আছে বেনজীর।
বুধবার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে সাবেক আইজিপির বর্তমান অবস্থান সাংবাদিকরা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. খান জানান, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা শুনেছেন। তবে তিনি নিশ্চিত না।
“আমার আশা তিনি ফিরে আসবেন। তিনি এসে নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ফেস করবেন,” বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
দুদকের আইনজীবী মি. খান বুধবার সুপ্রীম কোর্টে সাংবাদিকদের বলেন, “গণমাধ্যম যেভাবে সন্দেহ করছে উনি তুরস্কে, আইনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক সেটি বলতে পারে না। কারণ আগাম অনুমান করার সুযোগ আইন দুদককে দেয়নি”।
বেনজীর আহমেদ যেহেতু নিখোঁজ সেহেতু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক এখনই কোনো মন্তব্য করতে চান না।
বেনজীর আহমেদের এই রাজকীয় বিত্ত নিয়ে গত ৩১শে মার্চ প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে “যুগান্তর”। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার সম্পদ নিয়ে খবর প্রকাশ শুরু হয়।
সাবেক এই আইজিপি ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সর্বস্তরে আলোচনা হওয়ায় গত ১৮ই এপ্রিল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় দুদক।
পরে গত ২০ এপ্রিল ভিডিও বার্তায় মি. আহমেদ দাবি করেন তিনি ও তার পরিবারের নামে যে সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে তা সত্যি না।
২৩শে মে তার সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দের করার আদেশ দেন আদালত।
এরপর সাবেক পুলিশ প্রধান ও তার পরিবারের অঢেল সম্পত্তির খবর বের হতে থাকে গণমাধ্যমে।
অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলাকালে তিনি দেশ ছাড়তে পারেন কি না এমন প্রশ্ন সামনে আসার পর বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন “আদালত থেকে দেশ ছাড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। কারো নামে যদি নিষেধাজ্ঞা না থাকে তাহলে তো দেশ ছাড়তে বাধা থাকার কথা না”।
তদন্ত বা অনুসন্ধান চলাকালে দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে কী আইনি আছে?
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, “যেহেতু দুদক মাত্র অনুসন্ধান শুরু করেছে এখনও কিছু নিশ্চিত না। অভিযোগের একটা প্রাইমারি গ্রাউন্ড যদি না থাকে তাহলে মুভমেন্ট বন্ধ করার পথ নাই”।
টিআইবি বলেছে তার দেশের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়টি হয়তো সরকারের সাথে আঁতাত করেই ঘটেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক মি. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এমন আলোচিত ঘটনার তদন্ত শুরুর আগেই পালিয়ে গেলে সেটিকে খুব সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না”।
তিনি বলেন, “তার মতো একজন সুপরিচিত ব্যক্তি গোপনে পালিয়ে যাবে, দেশত্যাগ করবে আর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ চিনবে না? সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে না? এটাকে খুব সহজে মেনে নেয়ার সুযোগ নেই”।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর পর দুদকের কাছে তার সম্পত্তির অনেক তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬ই জুন বৃহস্পতিবার মি আহমেদকে এবং ৯ই জুন তার স্ত্রী জীশান মির্জাসহ সন্তানদের দুদক তলব করেছে।
একই সাথে মি. আহমেদের দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পদের বিষয়টি নিয়েও অনুসন্ধান চলছে।
বুধবার দুদকের আইনজীবী মি. খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের কাছে তার বিদেশ চলে যাওয়ার অফিসিয়াল কোনো রেকর্ড নাই। দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে একটা সুযোগ দিয়েছে। আমরা মনে করি উনি সুযোগটা গ্রহণ করবেন। তিনি যেখানেই থাকুক দুদকের ডাকে সাড়া দিয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন”।
এদিকে বুধবার দুদকের কমিশনার জহুরুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ”আমি শুনেছি, দুদকের অনুসন্ধান দলের কাছে বেনজীর ১৫ দিনের সময় চেয়েছেন। আইন অনুযায়ী তাকে হয়তো সময় দেওয়া হবে।”
এর আগে তিনি মঙ্গলবার বলেছিলেন, দুদক কাউকে নোটিশ পাঠালে তিনি আসতে বাধ্য কি না, আইনে এমন কিছু বলা নেই। কেউ হাজির না হলে ধরে নেয়া হবে তার কোন বক্তব্য নেই। তবে তারা দুদকের কাছে সময় চাইতে পারে। এক্ষেত্রে দুদক ১৫ দিন পর্যন্ত সময় দিতে পারে।
বেনজীর আহমেদর একের পর এক সম্পত্তির খোঁজ মিললেও কেন তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে না সেটি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে দুদকের আইনজীবী মি. খান বলেন, “এখনো অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষ হওয়ার আগে মামলা করা যায় না। আমরা যে তথ্য উপাত্তগুলো পেয়েছি সেগুলো যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে। আরো সম্পদ মিললে সেগুলোও জব্দ করা হবে”।
বেনজীর আহমেদ যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে তার নানা বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে।
দায়িত্ব ছাড়ার পর মি. আহমেদের দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তিও রয়েছে আওয়ামী লীগে।
বিএনপি বলছে, মি. আহমেদের দুর্নীতি দায় সরকার এড়াতে পারে না। কারণ তিনি ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় ও পদে থেকেই এই দুর্নীতি করেছেন।
মঙ্গলবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “বেনজীরের ভয়াবহ দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ হওয়ার পর সরকারই তাকে বাঁচাতে গোপনে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে”।
তবে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “এখন সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন? কী মনে হয় সরকার জেনেও গোপন করেছে? বেনজীর আহমেদ দেশের বাইরে থাকলেও তার বিরুদ্ধে বিচার চলবে”।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দায় সরকারের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক মি. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, “ক্ষমতায় থেকে তিনি যে অপরাধ করেছেন সেটি তো তিনি এককভাবে করেন নাই। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত থেকে করেছেন বলেই দায় নিতে হবে, সেই সাথে জবাবদিহিতার দায়টাও সরকারের”।
তবে ভিন্ন মত দিয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মি. হুদা।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাধারণত ক্রিমিনাল ল’ অনুযায়ী অপরাধ যিনি করেন দায় তারই থাকে। যার এটা তদারকি করার উচিত ছিল সে যদি ফেইল করে তাহলে তারও একই ধরনের অপরাধে অপরাধী হতে হবে”।