আমরা জানি দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করা হয়, আবার অনেকে বলেন দেশ আর মা একই। আমি বলি দেশ মায়ের থেকেও বড়। কারও এ কথায় খটকা লাগতে পারে, কিন্তু ভেবে দেখেন মা না থাকলেও মানুষ বেচেঁ থাকতে পারে কিন্তু দেশ না থাকলে কোন মানুষই বাচঁতে পারে না।
ঠিক বিপরিতে সন্তান ছাড়া মা বাচঁতে পারে কিন্তু মানুষ ছাড়া দেশ বাচঁতে পারেনা। তাইতো ১৭৫৭ সালে ‘ভারত’ হায়নার দখলে যাওয়ার পরে অসংখ্য মুক্তিকামী রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তাদের ত্যাগের মূল্যে আমরা ১৯৪৭ পেয়েছি।
এর পরেও বাঙ্গলাদেশ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৭১ এ এসে থমকে গিয়েছিল, আমরা এক অর্থে দেশহীন হওয়ার হুমকিতে পরেছিলাম। সেখান থেকে দেশকে রক্ষা করতে রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন একদল স্বপ্ন নির্মাতা।
সেই নির্মাতাদের একজন স্বপ্নবাজ পিরোজপুর শহরে বেড়ে ওঠা ১৯ বছরের টগবগে তরুণ ‘সামসুদ্দোহা মিলন’।
২৫মার্চ যুদ্ধ ঘোষণা হলে ২৬ মার্চ সকাল থেকে দলবেধে নেমে গেলেন এলাকার মানুষদের বাচাঁতে, কখনো খাদ্য সংগ্রহে মেতেছেন আবার কখনো আত্মরক্ষায় হয়েছেন সচেতন। নিজেকে বাচাঁতে হবে, রক্ষা করতে হবে অন্যদেরকেও। পাহাড় সমান দায়ীত্ব কিন্তু সামার্থ নাই খুব বেশি, আবার থেমে থাকারও ফুসরত নাই। দিন-রাত অক্লান্ত থেকে সংগঠিত করেছেন নিজেদের সেখানে ক্লান্তির চিন্তা করলেতো চলবে না।
তাদের দল ২৬ মার্চ অস্ত্রাগার লুট করে সেখানে থাকা প্রায় সব অস্ত্র নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এই অস্ত্র যুদ্ধে ব্যাবহার করার জন্য কিছু অবসর প্রাপ্ত সেনা সদস্য তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে। এ দিকে আনসার বাহিনীর এক সদস্যদের সাথে কিছুটা যোগাযোগ থাকায় তার থেকে ৩০৩ রাইফেল চালানো শিখেছিলেন, যা যুদ্ধের সময় তাকে সাহায্য করেছে।
তখনও পিরোজপুর শহরে সেনা পৌঁছয়নি তবে রাজাকাররা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে, সেটা একটা সমস্যা। তারাও পার্টির নেতা “রাশেদ খান মেনন” এর তত্ত্বাবধানে নানা রকম বিস্ফ্রোরক দিয়ে বোমা প্রস্তুত আয়ত্ত করেণ ও যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন।
এপ্রিল মাস অনেকটা বাধাহীন ভাবেই চলছিলো কিন্তু ২মে পিরোজপুর পাকিস্তানের সেনা সদস্যের একটা দল চলে এলে মুক্তিকামী যুবকরা গোপনে কর্মকাণ্ড চালাতে বাধ্য হয়।
ট্রেজারী ও অস্ত্রাগার লুটের কথা শুনে সেনারা তাতে জড়িত ৫৫ জনের নামে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে ৮জনকে ধরে এনে মৃত্যুদন্ড কার্যকরও করে। এতে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পরেন ফলে তারা শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। এর ফলে দলটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কেউ মুক্তিযুদ্ধে চলে যায় আবার কেউ আত্বিয় সজনদের বাড়িতে আত্মগোপন করে।
‘সামসুদ্দোহা মিলন’ এই সময় মা-বাবার চাপে নিরাপত্তার জন্য তার মামা বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হন কিন্তু তার মন পরে থাকে পিরোজপুর। কী করছে বন্ধু-সহকর্মীরা, সে খবর পাওয়ার কোন উপায় নাই। এদিকে পিরোজপুরে বন্ধুরা কী করছে কত দূর এগলো তাদের কর্মকান্ড জানতে কিছু দিনের মধ্যেই মন ছটফট করতে থাকে।
এর মধ্যে একদিন তুষখালী বাজার এলাকায় একদল রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সদস্য মনে করে তাকে আটকে রেখে পিরোজপুর সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার ব্যাবস্থা করছিলো। সে জানে সেনা সদস্যরা তাকে পেলে সাথে সাথে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করবে। কোন ভাবেই তাদের কবজা থেকে মুক্তির পথ যখন খুঁজে পাচ্ছিলো না তখন তার মামাদের এক প্রতিবেশি তাদের বাড়িতে খবর দেয় যে তাদের ভাগনেকে কিছু মানুষ আটকে পুলিশে দেয়ার চেষ্টা করছে। এই কথা শুনে তার এক মামা তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে।
সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে আবার নতুন ভাবে জীবনটা উপহার পেলো সে। এর ফলে সেদিন একটা স্বপ্ন মৃত্যুর হাত থেকে বেচেঁ আসে।
যেহেতু গ্রামটাও তার জন অনিরাপদ হয়ে গিয়েছে সেহেতু কিছু দিন পরে পিরোজপুর ফিরে এসে দেখে তাদের কাজের ধারা পাল্টে গিয়েছে, অনেকে ইতি মধ্যেই যুদ্ধে চলে গিয়েছে, কেউকেউ যাবার পথে। এরই মধ্যে মানুষ বাচাঁনোর কর্ম কান্ডও চলতে থাকলো যা আস্তে আস্তে কঠিণ হতে থাকলো কারণ রাজাকাররা এরই মধ্যে সংগঠিত হয়ে গিয়েছে, তারা নানা ভাবে বাধা দিচ্ছিলো এমনকি মেরে ফেলারও হুমকি দিতে থাকলো।
এই সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষরা আত্মগোপনে গিয়ে তাদের কর্মকান্ড চালাতে থাকলো। একই সাথে একদল রাজাকর তাদের সবার বাড়িতে খোঁজ নিতে শুরু করেছে ফলে তারা বাসায় যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বাবার সরকারী চাকরি তাই সরকারের পক্ষ থেকেও চাপ ছিলো তার নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য, কিন্তু দামাল মন কি আর সে বাধা মানে?
শহরে বিভিন্ন জায়গায় রাজাকার ও সেনারা মানুষ মেরে ফেলে রাখছে, কারো পক্ষে তাদের খোঁজ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। পুরা শহর বদ্ধভূমি করে তুলেছে, পরে থাকা মানুষের গন্ধে এক অসহনিয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কার পরে মানুষ যেমন লোকালয় এড়িয়ে চলা শুরু করেছে তেমন সেনারাও আর যত্র তত্র মানুষ মেরে রাখছে না। যাদের নাগালে পাচ্ছে তাদের ধরে নিয়ে নদীর পারে চলে যাচ্ছে।
বাসার পাশেই বলেশ্বর নদী, পাকিস্তানী সেনারা রাজারদের সাথে নিয়ে প্রায় প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের ধরে এনে গুলি করে সেই নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। জলের স্রোতে তারা ভেসে যায় স্বাধীনতার মূল্য চুকাতে। পাঁচ ভাই বোনের বড় ভাই সামসুদ্দোহা মিলন কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ জানে না। চার ভাই-বোন জানে না তাদের বড় ভাইকে আর কোন দিন দেখতে পাবে কিনা। তাদের দিন-রাত কাটে ঘোরের মধ্যে, যেন তাদের সময় থমকে আছে। মহাকুমা প্রশাসকের দপ্তরে চাকুরীজিবী বাবা
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছেন। এই বিপদে তাদের পথ দেখিয়েছেন তাদের সাহসী ‘মা’ এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন।
এক দিকে সেনাবাহিনী, আর এক দিকে তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর দিন-রাত শহরময় পদচারণা। স্বদেশিদের জন্য এক বিন্দুও নিরাপদ ভূমি নাই, এরই মধ্যে তারা বারবার আস্থানা পরিবর্তণ করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপন চেষ্টা করে চলছে।
যখন স্বধীনতা বিরোধীরা ধরে নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে ফেরা বন্ধ করে দিয়েছে তখন মধ্য জুলাই কিশোর মিলন বাড়ি ফিরে আসে, কিন্তু এলাকার কেউ তা জানতে পারেনি। তবে মাঝে মাঝে সন্দেহজনক লোকজনের আনাগোনা দেখা গেলে সন্দেহ করা হয় তার ফিরে আসা ওরা জেনে গিয়েছে, তাই তার মা
দেখলো বাড়িতে থাকলেও যেহেতু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নাই তাই যুদ্ধে যাওয়াই ভালো। যেই ভাবনা সেই কাজ, তিনি ছেলেকে বললেন এই ভাবে পালিয়ে যেহেতু থাকতে পারবি না সেহেতু যা যুদ্ধেই যা, দেশটাকে স্বাধীন করে এই অশান্তির প্রতিশোধ নিয়ে ফিরে আসবি।
সাথের প্রায় সবাই ইতি মধ্যেই যুদ্ধে চলে গিয়েছে। বিচ্ছিন্নতার জন্য কেউ কারো খবর জানে না, সবাই নিজের মতো জোগাজোগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে।
মিলনও অনেকবার যুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, কারণ তাকে সারাক্ষণই যুদ্ধক্ষেত্র টেনেছে কিন্তু মা-বাবা ও ভাই-বোনদের বাধার জন্য পরিকল্পনা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন একই সাথে খোঁজ নিতে থাকেন রাজনৈতিক সহকর্মীরা কে কোথায় আছে, কারণ তিনি জানেন যুদ্ধে তাকে যেতেই হবে। মা যেহেতু অনুমতি দিয়েছে সেহেতু আর পিছু হটার কারণ নাই, এর পরে পাকিস্তানপন্থিদের দৃষ্টি এড়িয়ে এলাকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি।
এমন এক সময় সহযোদ্ধাদের অবস্থানের আনুমানিক সন্ধান পেয়ে তাদের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। সুযোগও চলে আসে। বাসার কাছেই এক মালবাহী নৌকা খুলনা যাবে ১৫ আগষ্ট শেষ রাতে, সবাই ঘুমালে মধ্যরাতে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মৃত্যুদন্ডের হুলিয়া কাধে নিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোনদের পিছনে রেখে সেই নৌকায় অনিশ্চিৎ জীবনে প্রবেশ করলেন তরুণ যোদ্ধা সামসুদ্দোহা মিলন।
পরিচিত এলাকার মধ্য থেকেই নৌকা চলছে, নদীর তীরে চোখ রেখে এগিয়ে যেতে যেতে কাঙ্খিত স্থানে নেমে গেলেন। স্থানীয়দের থেকে জানতে পারলেন কাছেই একটা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আছে, নদীর তীর ধরে সে দিকে হাটছেন তিনি, কিছু দূর যাওয়ার পরে পিরোজপুর থেকে আসা কয়েকজন যোদ্ধার সাথে দেখা, তাদের সাথে যুক্ত হয়ে সকল উৎকণ্ঠা কাটিয়ে কাঙ্ক্ষিত পথ খুঁজে পেয়ে এতোদিন মৃত্যুর সাথে লুকচুরি খেলে এবার অস্ত্র হাতে মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ জানাতে দাড়িয়ে গেলেন অকুতোভয় যোদ্ধা ‘সামসুদ্ধোহা মিলন’।