প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে বাসার পিছনের বারান্দায় মোটা কাঁথার ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে সবাই মিলে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম। নানা জায়গার যুদ্ধের খবর, নাটিকা, গান, এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র এবং বজ্রকন্ঠ। বজ্রকন্ঠে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” জয় বাংলা, কানে আসলেই শরীর গরম হয়ে উঠতো।
নদীতে লাশ, ক্যাম্পের নির্মম নির্যাতন, মেঝ ভাইয়ের মুখে শুনতাম। সারাদিন এক রকম কাটলেও রাতে কুকুরের ডাক, এই বুঝি আবার গুলির শব্দ শুনবো, ভয়ে ঘুমাতে পারতাম না। নদীর পাড়ের বাসা থেকে আতংকিত রঞ্জন স্যার ও কাঁকন দিদি রাতে আমাদের বাসায় ভাইয়ার রুমে ঘুমাতে আসেতেন।
এর মধ্যে একদিন দেখি আমার বন্ধু বিমল দাস টুপি পড়ে বাসায় এসেছে, আমিতো অবাক! ও বলে, এখন থেকে ওর নাম নাকি বাবুল, ওরা মুসলমান হয়ে গেছে। নিতাইদা, ওর বাবা আমাদের স্কুলের দপ্তরি, মাথায় টুপি পড়ে ঘুরছে, ওর মায়ের মাথায় সিঁদুর নাই। আমার মাথা ঠিক ছিল না, পরের দিন স্কুল থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দেখি একটা আর্মি বন্দুক হাতে টহল দিচ্ছে, দেখার সাথে সাথে তার পিছন থেকে দুইবার, জয় বাংলা, জয় বাংলা বলে বসলাম। আর্মিটা ঘুরে তাকাল, আমিও নির্বিকার, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কি মনে করেছিল বুঝি নাই, হয়তো খেলার অংশ মনে করে নদীর পাড়ের দিকে চলে গেল।
ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি জানলা দিয়ে আম্মা সব দেখছেন। চুপচাপ ঘরে গেলাম, ঘরে যেতেই আম্মা বললেন, এরকম আর করিস না ওদের বিশ্বাস নাই, যদি তোকে গুলি করে দিত! একজন যুদ্ধে গেছে, তোর আব্বা অফিসের অবস্থা ভালো না, আশরাফ চাপরাশি তোর আব্বার নাম ধরে বলেছে ‘লিস্ট করা হচ্ছে, কার কার ছেলে বাসায় নাই, যুদ্ধে গেছে। হয় ছেলেকে হাজির করবে, নাহলে নিজেই হাজির হবে নদীর পাড়ে।’ আব্বা জানতেন আন্দোলন সংগ্রামের জন্য পিরোজপুরের তৎকালীন এমএনএ এনায়েত হোসেন সহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা দিয়ে সাজা দিয়েছিল পাকিস্তানিরা, ভাইয়ার নাম ওই তালিকায় আছে।
আমরা খেলার ছলে একটা গ্যাং হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের অঘোষিত ক্যাম্প ছিল কুঞ্জু বাবুর বাগান।একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নির্বিচারে অত্যাচার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর, তাদের প্রায় প্রত্যেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এই বাড়িটিও রেহাই পায়নি। পানের বরজ ও নানান রকমের গাছ ছিল ওখানে। একটা যুদ্ধের ভাব নিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় ওই বাগানের মধ্যে কাটাতাম এবং নানারকম পরিকল্পনা করতাম।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্রে শুনতাম “ঢাকার শহরে বিচ্চু বাহিনি ঢুইকা পড়ছে, তারা নাকি টিকাটুলি, পল্টন, আজিমপুরের রাস্তার মোড়ে বাক্সের মধ্যে লুকাইয়া থাকে আর মচুয়াদের গাড়ি দেখলে বাইর হইয়া গ্রেনেড মাইরা পালায়া যায়।” হিসাব করে দেখলাম এই বিচ্চু বাহিনী আর আমাদের বয়স প্রায় সমান, গ্রেনেট পেলে আমরা ওই বাহিনী হয়ে যাব। আম্মাকে জানাতে চেয়েছিলাম, কারন আম্মাই সেদিন রাতে ভাইয়াকে নৌকায় তুলে দিয়েছিলেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আব্বার অফিসের কথা শুনে আমার পরিকল্পনার কথা চেপে গেলাম।
একদিন সকালে বাসার সামনের বারান্দায় একটা ভাঁজ করা ছোট কাগজ পেলাম, ভয়ে ভয়ে একটু খুলে আম্মার হাতে দিলাম, সবাই বিস্মিত, আম্মা কাগজটা খুলেই ভাইয়ার রুমে গিয়ে ভাইয়ার খাতা বের করে হাতের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে বল্লেন তোর ভাইয়ার হাতের লেখা! “আম্মা আমি ভালো আছি” শুধু এই টুকুই। বুঝলাম জীবিত আছে, কিন্তু কোথায আছে? কে দিল এই কাগজ জানা দরকার। কেউ একজন রাতের বেলা এই চিঠি ফেলে গেছে। আম্মার উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে গেল। ঠিক হলো পাহারায় বসতে হবে।
এই চিঠি কে দেয় তাকে দেখতে হবে, ভাইয়েরা কোথায় আছে তা জানতে হবে। অনেকদিন আমরা তার কোন খবর জানি না। সন্ধ্যার পরে সবাই বারান্দায় খেয়াল রাখে। কিন্তু আমার আগ্রহ ছিলো বেশি। একটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব নিয়ে প্রতিরাত আটটা নয়টার পরে ঘরের আলো নিভিয়ে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের বাসার সামনে নিচের দিকে একটা জানালা ছিল ওইটা সামান্য খুলে রেখে বসে থাকতাম। অন্ধকারে বাইরে একটু ছায়ার মত দেখলেই মনে হতো কেউ যেন আসছে, কিন্ত না অনেকদিন হয়ে যায় কাউকে পাই না।
আর এক দিনের কথা, তখন রোজার মাস, পনের রোজা হবে, দুপুর বেলা, দিনটা রবিবার ছিল কারণ আব্বা বাসায় ছিলেন। বেশ কয়েকটা আর্মি আমাদের রাস্তায় আসতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাসার সবাই বিভিন্ন জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম নদীর দিকে। রিক্সার পাদানিতে বসা দুইজন মানুষ, সাদা ও গিয়া রঙের পাঞ্জাবী পরা। কি ঘোটবে বুঝতে পারছি না, এর আগে কখনো আমাদের রাস্তায় এভাবে কাউকে নিয়ে আসতে দেখি নাই।
আমাদের বাসা থেকে নদী প্রায় ২৫- ৩০ গজ দূরে, আর এর মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না, জানলা দিয়ে নদী দেখা যেত। আর্মিরা আমাদের বাসার সামনে সহ নদীর পারে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। নদীর পাড়ের একটু ঢালে নামিয়ে দুইজনকেই পর পর বেওনেট চার্জ করতে থাকে। প্রথম জনকে যখন মারছে তখন দ্বিতীয়জন পালাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ওই মৃত্যুর দৃশ্য দেখেছে, তারপর নিজেও লুটিয়ে পরল। কোন চিৎকারের শব্দ ছিল না, হয়তো চিৎকার করার কোনো শক্তিই ছিল না তাদের। আমরা শুধু দূর থেকে হাত-পাগুলো কিছুক্ষণ ছোড়া ছুড়ি করতে দেখলাম, তারপরে নিথর হয়ে গেলে দেহ গুলোকে পা দিয়ে ঠেলে নদীতে ফেলে দিল। এর মধ্যে আমার বড় বোন ডুকরে কেঁদে ওঠে, আব্বা সাথে সাথে আপার মুখ চেপে ধরে। এই কান্নার শব্দ আর্মিরা শুনলে আমাদের আর নিস্তার থাকতো না। এখনো ওই দৃশ্যের কথা মনে হলে শরীর কেঁপে ওঠে, লিখতে গিয়ে এখনো হাত কাঁপছে আমার। আমরা পুরো পরিবার একসাথে ওই নিষ্ঠুরতা যুদ্ধের ময়দানের মত দেখলাম।