এদিকে আমার অন্বেষণ শেষ হয়না, গোয়েন্দাগিরি চলতেই থাকে। অনেকদিন হয়ে যায়, তারপর একদিন দেখি আমাদের বেড়া ডিঙিয়ে কে যেন একজন বাসার দিকে আসছে ছোটখাটো, জানালার শিক ধরে উপরে উঠে চিঠিটা ফেলার সাথে সাথে আমি তার হাত চেপে ধরে বলি একটু দাঁড়ান, সে প্রথমে ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু দাঁড়ালো, কি? আম্মা আপনার সঙ্গে কথা বলবে। আমি আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসি। মিলন কোথায় আছে? কেমন আছে? আসবে? নিমিষেই অনেক প্রশ্ন। সে মুখটা একটু আড়াল করে বলে, খালাম্মা, কোথায় আছে বলা যাবে না, তবে ভালো আছে, চিন্তা করবেন না এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলা যাবে না, নিষেধ আছে। আবার শহরে আসলে চিঠি দিয়ে যাবো, বলেই আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। স্বাধীনতার পরে জেনেছি ওনার নাম কালাম ছোটখাটো বলে ভাইয়েরা পুইট্টা কালাম নামে ডাকত। কি অসীম সাহস, ক্যাম্পে সবার থেকে বয়সে ছোট কিন্তু ক্যাম্প থেকে একা একা শহরে আসত, আর্মিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শহরে নানা জায়গায় খবর দিয়ে আবার চলে যেত এই অকুতোভয় মুক্তিসংগ্রামী।
বর্ষা মোটামুটি শেষ শীতের আগমন ঘটছে কিন্তু শহর উত্তপ্ত। টুকটাক কথাবার্তা কানে আসছে, গাবখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একটা যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে পাকিস্তানি সেনা আহত হয়েছে, কদম তলার দিকে আর্মিরা এক ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিল, যেখানে গোলাগুলি হয়েছে। রাতে আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে মাধ্যমে খবর ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছিল। সারা বাংলায় প্রতিরোধের খবর ছড়িয়ে পড়ছে, একটা চাপা উত্তেজনা সবখানে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরকম এক দুপুরের কেউ একজন খবর দেয় গাড়ির পিছনে বেঁধে কাকে যেন শহরের রাস্তায় টানছে। পাকিস্তানিরা তাদের পৈশাচিক পরিচয় আর ঘরের মধ্যে বা রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে রাখতে পারল না। দিনের বেলা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মারছে, এবার গাড়ির পিছনে মানুষ টেনে নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ করেছে। আমাদের নজর খেয়া ঘাটের দিকে শেষ পর্যন্ত এখানেই দেখা যাবে। আর্মিরা চলে গেলে আমি খেয়াঘাটে গেলাম দেখি অসংখ্য মানুষ নদীর দিকে ঝুঁকে আছে আমি তাকাতেই দেখি মাথাটা তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে আর চুলগুলো চারিদিকে ভাসছে।
নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে আছে যেমন সূর্যাস্তের সময় সমস্ত নদীর পানি সূ্র্যের আভায় লাল হয়ে উঠেছে। দোকানদারদের মুখে শুনলাম ওনার নাম ভাগিরথি।
ভাগিরথি মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা ছিল কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিল। সেই দিন গোধূলির লাল আভা বাকি বলেশ্বরকে রক্তবর্ণ করে দিয়েছিল এই শহীদের সম্মানে।
সেই সময় প্রতিদিন মৃত্যুর দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে অনির্বাণ হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন বলেশ্বরে নির্বিচারে যে মৃত্যু দেখেছি তা নিষ্ঠুরতার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। সকাল-দুপুর-বিকেল অসংখ্য মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে, আবার জল-জ্যান্ত মানুষ হাঁটিয়ে নিয়ে এসে নদীর পাড়ে বসিয়ে গুলি করেছে। এই গুলো এতদিন ছিল রাতের অন্ধকারে, এখন দিনের আলোয়। আমি নির্বোধের মত ঐ দৃশ্য দেখেছি, হয়তো আজীবন মনের অতলে এই স্মৃতি বহন করে যাব।
অফিস থেকে ফেরার পর আব্বার মলিন মুখ, রাতে স্বাধীন বাংলায় ছোট ছোট যুদ্ধ জয়ের খবর, আবার পাড়ায় কিছু লোকের হুমকি, কেন নদীর পাড়ে আম্মাকে নিয়ে লাশ দেখতে যাই? ‘তোর ভাই কোথায় গেছে আমরা সব জানি!’ বলে ভয় দেখাতো। এক অশনিসংকেত যেন আমাকে ঘিরে ফেলেছে।
ডিসেম্বর মাস, তখন দিন তারিখ জানিনা, একদিন সকাল বেলা আব্বার সঙ্গে বাজারে যাচ্ছিলাম, বড় মসজিদের সামনে দাঁড়াতেই দেখি সারি সারি রিকশা় করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হুলারহাটের দিকে যাচ্ছে। ওর মধ্যে একটি রিকশায় দেখলাম একজন হানাদার এতোই মোটা যে একারই এক রিকশা লেগেছিল। আমরা ভাবলাম হয়তো টহল দিতে নেমেছে, কিন্তু দৃশ্যটা স্বাভাবিক লাগছিল না, আবার পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছিল না, হয়তো কোথাও অপারেশন আছে! কাঁচাবাজার এবং মাছের বাজারের মধ্যে যখন আমরা তখন হঠাৎ শুনি শহরে কারফিউ দিয়েছে, লোকজন প্রাণের ভয়ে হতভম্ব হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে যে যার মত পালানোর চেষ্টা করছে। যাদের বাড়ি রাজারহাটের দিকে তারা অনেকেই খালে নেমে ছিল ওপার যাওয়ার জন্য, তাদের সাথে আমিও দামুদার খালে নামার চেষ্টা করলাম কিন্তু আব্বা ডেকে তুললেন, আমি ওইদিকে কোথায় যাচ্ছি? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এক আতঙ্ক নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। দুই একদিন আগে খবরে শুনেছি ঢাকা শহরে কারফিউ দিয়ে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে যারা যুদ্ধে যায়নি তাদের। বাসায় এসে দেখি আমার মেজো ভাই এবং এক চাচাতো ভাইয়ের চিন্তিত মুখ, এখন কোথাও যাওয়ার সুযোগও নেই, আমাদের ভাগ্যেওকি এই নির্মমতা জুটবে!
পরদিন সকালে খেয়াল করলাম আদর্শ স্কুলের মধ্যে যে রাজাকার ক্যাম্প ছিল সেটা শুন্য, সবাই পালিয়েছে। তারমানে আগের দিন ওভাবেই আর্মিরা শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, আমরা হানাদারমুক্ত হয়ে ছিলাম।
সকালে শহরের দিকে যাচ্ছি, পাড়ায় ইউনুস ডাক্তারের বাসার সামনে যেতেই শুনতে পাই জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে মানুষ ছুটছে এস ডি ও বাড়ি ঘেরাও করতে, যেখানে আর্মির ক্যাম্প ছিল। ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখি একটা কবর খুঁড়ে একটা কফিন তোলা হচ্ছে, সেখানে এক আর্মি অফিসারকে কবর দেওয়া হয়েছিল। মুহূর্তেই মানুষ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত হয়ে উঠল, নয় মাস যুদ্ধে অকাতরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে মানুষের মধ্যে যে অগ্নি স্পৃহা তৈরি হয়েছিল তা যেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফেটে পড়ল এই লাশের উপর। চার পাঁচ দিন আগে গাবখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল এই হানাদার। আর্মির পোশাক পরা মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা ওই লাশটা সেদিন কুকুরের খাদ্য হয়েছিল।
তারপর আস্তে আস্তে শহরে ছড়িয়ে পড়লাম। শহরের চারিপাশ থেকে একজন দুইজন করে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসছে, এক সময় বাসায় ফিরে এসে ভাবতে থাকলাম ভাইয়ার তো অনেক দিন কোনো খবর নাই, কবে ফিরবে, ফিরবে কি আদৌ? সত্যিই তো কত জনইতো ফিরে আসে নাই, ফারুক ভাই, ফজলু ভাই, মন্টু দা, দেবু দা, সেলিম ভাই আর কত নাম না জানা শহীদ।
বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পেড়িয়ে এসেছে, আর কত কি ঘটেছে দেশে। কিন্তু যে মা তার সন্তানের লাশ ফিরে পায়নি, যে সন্তান তার পিতার কবর কোথায় জানেনা, সমগ্র বাংলার মাটি সেই শহীদের লাশ বুকে ধারণ করে আছে। স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছে তাদেরকে কতটুকু মনে রেখেছি আমরা? স্বাধীন দেশ, পতাকা, বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ পরিচয় পেয়েছি আমরা। ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মদানের কতটুকু মূল্যায়ন করেছি ভেবে দেখেছ বাংলাদেশ!
এদিকে আমার অন্বেষণ শেষ হয়না, গোয়েন্দাগিরি চলতেই থাকে। অনেকদিন হয়ে যায়, তারপর একদিন দেখি আমাদের বেড়া ডিঙিয়ে কে যেন একজন বাসার দিকে আসছে ছোটখাটো, জানালার শিক ধরে উপরে উঠে চিঠিটা ফেলার সাথে সাথে আমি তার হাত চেপে ধরে বলি একটু দাঁড়ান, সে প্রথমে ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু দাঁড়ালো, কি? আম্মা আপনার সঙ্গে কথা বলবে। আমি আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসি। মিলন কোথায় আছে? কেমন আছে? আসবে? নিমিষেই অনেক প্রশ্ন। সে মুখটা একটু আড়াল করে বলে, খালাম্মা, কোথায় আছে বলা যাবে না, তবে ভালো আছে, চিন্তা করবেন না এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলা যাবে না, নিষেধ আছে। আবার শহরে আসলে চিঠি দিয়ে যাবো, বলেই আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। স্বাধীনতার পরে জেনেছি ওনার নাম কালাম ছোটখাটো বলে ভাইয়েরা পুইট্টা কালাম নামে ডাকত। কি অসীম সাহস, ক্যাম্পে সবার থেকে বয়সে ছোট কিন্তু ক্যাম্প থেকে একা একা শহরে আসত, আর্মিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শহরে নানা জায়গায় খবর দিয়ে আবার চলে যেত এই অকুতোভয় মুক্তিসংগ্রামী।
বর্ষা মোটামুটি শেষ শীতের আগমন ঘটছে কিন্তু শহর উত্তপ্ত। টুকটাক কথাবার্তা কানে আসছে, গাবখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একটা যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে পাকিস্তানি সেনা আহত হয়েছে, কদম তলার দিকে আর্মিরা এক ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিল, যেখানে গোলাগুলি হয়েছে। রাতে আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে মাধ্যমে খবর ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছিল। সারা বাংলায় প্রতিরোধের খবর ছড়িয়ে পড়ছে, একটা চাপা উত্তেজনা সবখানে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরকম এক দুপুরের কেউ একজন খবর দেয় গাড়ির পিছনে বেঁধে কাকে যেন শহরের রাস্তায় টানছে। পাকিস্তানিরা তাদের পৈশাচিক পরিচয় আর ঘরের মধ্যে বা রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে রাখতে পারল না। দিনের বেলা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মারছে, এবার গাড়ির পিছনে মানুষ টেনে নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ করেছে। আমাদের নজর খেয়া ঘাটের দিকে শেষ পর্যন্ত এখানেই দেখা যাবে। আর্মিরা চলে গেলে আমি খেয়াঘাটে গেলাম দেখি অসংখ্য মানুষ নদীর দিকে ঝুঁকে আছে আমি তাকাতেই দেখি মাথাটা তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে আর চুলগুলো চারিদিকে ভাসছে।
নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে আছে যেমন সূর্যাস্তের সময় সমস্ত নদীর পানি সূ্র্যের আভায় লাল হয়ে উঠেছে। দোকানদারদের মুখে শুনলাম ওনার নাম ভাগিরথি।
ভাগিরথি মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা ছিল কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিল। সেই দিন গোধূলির লাল আভা বাকি বলেশ্বরকে রক্তবর্ণ করে দিয়েছিল এই শহীদের সম্মানে।
সেই সময় প্রতিদিন মৃত্যুর দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে অনির্বাণ হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন বলেশ্বরে নির্বিচারে যে মৃত্যু দেখেছি তা নিষ্ঠুরতার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। সকাল-দুপুর-বিকেল অসংখ্য মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে, আবার জল-জ্যান্ত মানুষ হাঁটিয়ে নিয়ে এসে নদীর পাড়ে বসিয়ে গুলি করেছে। এই গুলো এতদিন ছিল রাতের অন্ধকারে, এখন দিনের আলোয়। আমি নির্বোধের মত ঐ দৃশ্য দেখেছি, হয়তো আজীবন মনের অতলে এই স্মৃতি বহন করে যাব।
অফিস থেকে ফেরার পর আব্বার মলিন মুখ, রাতে স্বাধীন বাংলায় ছোট ছোট যুদ্ধ জয়ের খবর, আবার পাড়ায় কিছু লোকের হুমকি, কেন নদীর পাড়ে আম্মাকে নিয়ে লাশ দেখতে যাই? ‘তোর ভাই কোথায় গেছে আমরা সব জানি!’ বলে ভয় দেখাতো। এক অশনিসংকেত যেন আমাকে ঘিরে ফেলেছে।
ডিসেম্বর মাস, তখন দিন তারিখ জানিনা, একদিন সকাল বেলা আব্বার সঙ্গে বাজারে যাচ্ছিলাম, বড় মসজিদের সামনে দাঁড়াতেই দেখি সারি সারি রিকশা় করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হুলারহাটের দিকে যাচ্ছে। ওর মধ্যে একটি রিকশায় দেখলাম একজন হানাদার এতোই মোটা যে একারই এক রিকশা লেগেছিল। আমরা ভাবলাম হয়তো টহল দিতে নেমেছে, কিন্তু দৃশ্যটা স্বাভাবিক লাগছিল না, আবার পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছিল না, হয়তো কোথাও অপারেশন আছে! কাঁচাবাজার এবং মাছের বাজারের মধ্যে যখন আমরা তখন হঠাৎ শুনি শহরে কারফিউ দিয়েছে, লোকজন প্রাণের ভয়ে হতভম্ব হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে যে যার মত পালানোর চেষ্টা করছে। যাদের বাড়ি রাজারহাটের দিকে তারা অনেকেই খালে নেমে ছিল ওপার যাওয়ার জন্য, তাদের সাথে আমিও দামুদার খালে নামার চেষ্টা করলাম কিন্তু আব্বা ডেকে তুললেন, আমি ওইদিকে কোথায় যাচ্ছি? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এক আতঙ্ক নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। দুই একদিন আগে খবরে শুনেছি ঢাকা শহরে কারফিউ দিয়ে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে যারা যুদ্ধে যায়নি তাদের। বাসায় এসে দেখি আমার মেজো ভাই এবং এক চাচাতো ভাইয়ের চিন্তিত মুখ, এখন কোথাও যাওয়ার সুযোগও নেই, আমাদের ভাগ্যেওকি এই নির্মমতা জুটবে!
পরদিন সকালে খেয়াল করলাম আদর্শ স্কুলের মধ্যে যে রাজাকার ক্যাম্প ছিল সেটা শুন্য, সবাই পালিয়েছে। তারমানে আগের দিন ওভাবেই আর্মিরা শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, আমরা হানাদারমুক্ত হয়ে ছিলাম।
সকালে শহরের দিকে যাচ্ছি, পাড়ায় ইউনুস ডাক্তারের বাসার সামনে যেতেই শুনতে পাই জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে মানুষ ছুটছে এস ডি ও বাড়ি ঘেরাও করতে, যেখানে আর্মির ক্যাম্প ছিল। ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখি একটা কবর খুঁড়ে একটা কফিন তোলা হচ্ছে, সেখানে এক আর্মি অফিসারকে কবর দেওয়া হয়েছিল। মুহূর্তেই মানুষ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত হয়ে উঠল, নয় মাস যুদ্ধে অকাতরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে মানুষের মধ্যে যে অগ্নি স্পৃহা তৈরি হয়েছিল তা যেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফেটে পড়ল এই লাশের উপর। চার পাঁচ দিন আগে গাবখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল এই হানাদার। আর্মির পোশাক পরা মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা ওই লাশটা সেদিন কুকুরের খাদ্য হয়েছিল।
তারপর আস্তে আস্তে শহরে ছড়িয়ে পড়লাম। শহরের চারিপাশ থেকে একজন দুইজন করে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসছে, এক সময় বাসায় ফিরে এসে ভাবতে থাকলাম ভাইয়ার তো অনেক দিন কোনো খবর নাই, কবে ফিরবে, ফিরবে কি আদৌ? সত্যিই তো কত জনইতো ফিরে আসে নাই, ফারুক ভাই, ফজলু ভাই, মন্টু দা, দেবু দা, সেলিম ভাই আর কত নাম না জানা শহীদ।
বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পেড়িয়ে এসেছে, আর কত কি ঘটেছে দেশে। কিন্তু যে মা তার সন্তানের লাশ ফিরে পায়নি, যে সন্তান তার পিতার কবর কোথায় জানেনা, সমগ্র বাংলার মাটি সেই শহীদের লাশ বুকে ধারণ করে আছে। স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছে তাদেরকে কতটুকু মনে রেখেছি আমরা? স্বাধীন দেশ, পতাকা, বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ পরিচয় পেয়েছি আমরা। ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মদানের কতটুকু মূল্যায়ন করেছি ভেবে দেখেছ বাংলাদেশ!