শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং সমাদৃত এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে সময় এবং স্থানভেদে এর তারতম্যও চোখে পড়ে। একজন শিক্ষক তিনি সর্বদাই শিক্ষাবান্ধব এবং শিক্ষার্থীবান্ধব। তিনি শিক্ষার পাশে দাঁড়ান, শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ান, শিক্ষর্থীদের পথ দেখান সত্য এবং ন্যায়ের পথে পথ চলতে। সেই সঙ্গে চিন্তা ও বিবেচনাবোধ থাকবে সীমাহীন। যার কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য বলতে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শিখে, বলার সাহস সঞ্চয় করে। হউক সে যতই কঠিন। শিক্ষার্থীদের শিখান সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা গেলেও কোন কিছুর বিনিময়েই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। আর তাই তাঁরা স্থান ও কাল ভেদেও শ্রদ্ধেয় এবং সমাদৃত।
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষকরা হলেন স্নায়ুতন্ত্র। যার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা, নতুন সভ্যতা। শিক্ষক সর্বদাই মানবিক , নৈতিক ও আর্দশিক। যিনি শিক্ষার বাণিজ্যিকীরণের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার্। একজন শিক্ষক ছাত্রদের মাধ্যমে সমাজকে নতুন নতুন স্বপ্নের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন,গভীর সংকটেও আলোর পথ দেখান, সমাজ, পরিবার , ব্যক্তি জীবনের সম্প্রীতির বন্ধন, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য এবং সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যিনি শিক্ষক তিনি ছাত্রদের শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। শুধুমাত্র পরিক্ষায় পাশের জন্যই শিখানো শিক্ষকের কাজ নয়, তিনি শিখান জীবনকে জানার জন্য, জীবনকে বোঝার জন্য এবং জীবনকে পাশ করার জন্য। নুতুন নতুন সৃজনশীল চিন্তাকে জাগিয়ে তোলেন। শিক্ষকের সীমাহীন ত্যাগ,শ্রম ও মেধার কারণেই আমরা আজ সভ্যতার উন্নত শিখরে উন্নীত হয়েছি। শিক্ষক শ্রমজীবী থেকে শুরু সকল শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন। আবার তিনি নিজেও শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করেন তেমনি ছাত্রদেরকে শিখান শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে লড়তে ও তাদেরকে শ্রদ্ধা করতে। কাল মার্কস বলেছিলেন শ্রমিকের শ্রম ছাড়া সোনাও মাটি। শিক্ষকই তার শিক্ষার মাধ্যমে একজন ছাত্রকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। শিক্ষকের আসন শুধু শ্রেণি কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছড়িয়ে থাকেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শিক্ষক না থাকলে ব্যক্তি জীবন যেমন আলোকিত হয় না তেমনি সমাজ সভ্যতাও আলোকিত হয় না।
শিক্ষক হলেন সমাজের বাতিঘর। এই বাতিঘর যখন অযতœ আর অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে তখন আমরা নিজেরাও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলি। আর এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির প্রভাব পড়ে আমাদের সমাজে এবং এর ভোক্তভোগী আমরাই। শিক্ষক শুধু রুটিরুজির জন্যই শিখাবেন না। তিনি শিখাবেন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য,আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে,নিজের আত্মতৃপ্তি,সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ যদি নিজেরা নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে তবে সমাজে দৃশ্যমান অনেক বিশৃঙ্খলতার সমাধান হয়ে যাবে। তবে একথা সত্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্টপোষকতা ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না।শিক্ষকের রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠীত করা ছাড়া শিক্ষকের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় এবং শিক্ষকদেরও আন্তরিকতা, স্বদিচ্ছা ও আদর্শের প্রতিশ্রদ্ধা ভালোবাসা ছাড়া একজন শিক্ষক আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন না। যেকোন মূল্যে আমাদেরকে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের প্রয়োজনেই। সংকট যত গভীর হয় শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি শিক্ষদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে শতপ্রতিকুলতা,বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আবার কিছু কিছু শিক্ষকের আচরণ দেখে নিজের মধ্যেই প্রশ্ন জাগে তারা কিভাবে শিক্ষক, কি কারণে শিক্ষক ? তারা না শিক্ষাবান্ধব না শিক্ষার্থী বান্ধব। তারা প্রাইভেট পড়ানো বান্ধব, ব্যক্তি বান্ধব, কোচিং বান্ধব এবং শিক্ষার্থী শোষক। অনেক শিক্ষকদের দেখেছি এবং শুনেছি যারা শিক্ষার্থীদেরকে শোষণ করাটাকে নিজেদের কৃতৃর্ত্ব বলে মনে করেন। আর তাদের কারণেই শিক্ষার্থীরা অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে এই শিক্ষার্থীরা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠে। চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বিরাজ করে। শিক্ষকতা শুধু জীবন নির্বাহের জন্য অর্থ উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। এরকম কেউ ভাবলে তার শিক্ষকতা পেশায় না আসায় উত্তম। এতে সে ব্যাক্তিগতভাবে যেমন লাভবান হবে ঠিক তেমনি দেশ জাতিও উপকৃত হবে। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আজ তরুণ সমাজ, যুব সমাজ বিপথগামী। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আমাদের সমাজ-সভ্যতা অর্থনীতি সংকটের মুখে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদনে গতিশীলতা পাচ্ছে না। আজকের সমাজে নামধারী শিক্ষকের পরিমাণ অনেক থাকলেও শিক্ষকের পরিমাণ খুবই নগন্য। শিক্ষকের সংকট থাকলে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ খুব বেশি লাভবান হয়। তাদের অন্ধকার রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পায়। যে শিক্ষক নিজেকেই বিকশিত করতে পারেন না, তিনি অন্যকেও বিকশিত করতে পারে না। তার শিক্ষায় সমাজে বন্ধ্যাত্ব তৈরি হয়। তার জন্য শিক্ষকতা নয়, জীবিকার জন্য অন্যকোথাও চেষ্টা করা প্রয়োজন। আজকের সমাজে যে সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয় চলছে তার জন্য নামধারী শিক্ষকের শিক্ষকতা এবং শিক্ষাই দায়ী। শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষে পড়ানোই শিক্ষকের কাজ নয়। ছাত্ররা যখন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রাপ্য সময়টুকু এবং প্রত্যাশিত জ্ঞানটুকু না পান তখন শিক্ষকের তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেন,আস্থা হারিযে ফেলেন এবং তার প্রতি ছাত্রদের অবহেলা ও অবজ্ঞা বৃদ্ধি পায়। তবে আজকাল শিক্ষকদের মধ্যেও ফাঁকি দেওয়ার প্রবনতা লক্ষ করা যায়। আবার তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। একদল শিক্ষককে দেখা যাছে তার সমস্তকিছু বিকিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র টাকার পিছনে ছুটছেন। ফলে তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ও সুখ যেমন বিনিষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে পারিবারিক অশান্তি ও কলহও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এভাবেই শুরু হয় সামাজিক অধঃপতন ও অবক্ষয়।একজন শিক্ষকের স্বপ্ন তার ছাত্ররা তাকে একদিন অতিক্রম করবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে এ ধরনের শিক্ষকের বড়ই অভাব।বর্তমান সমাজে শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষমতা যেখানে মুখ্য হওয়ার কথা ছিল, সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষাকে একরকম পরিত্যাগ করে প্রশাসক হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাচর্চায় নিজেদের যুক্ত করছেন। শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ কমছে, ক্ষমতার চর্চা বাড়ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে।১৯৫২ সালে ইসরাইলের প্রথম প্রেসিডেন্ট ওয়াইজম্যানের মৃত্যুর পর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু যার মধ্যে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আনন্দ নেই, তার কাছে ক্ষমতা মূল্যহীন। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গবেষণাকেই জীবনের ব্রত হিসাবে বেছে নিয়েছেন। আমাদের শিক্ষকরাও যদি এমন ভাবতে পারতেন, তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান অন্বেষণ করা সম্ভব হতো।
শিক্ষক এবং শিক্ষার যে সংকট চলছে তা থেকে বরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ভালো কাজে হ্যাঁ বলুন ,খারাপ কাজকে না বলুন। আমরা যদি আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চাই তবে শিক্ষকের পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষকরে অবস্থান ফিরিয়ে আনতে দল-মত নির্বিশেষে শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে আর তা না হলে শিক্ষায় অন্ধকারটা আরো গভীর হবে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে কোনো শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করা যাবে না। শিক্ষকদের দক্ষতাকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও শিক্ষার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষকসমাজ যদি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে আন্তরিকতা, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা ও সততার মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করত, তাহলে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক দেশ হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হতো। সর্বোপরি, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব হতো। শিক্ষকদের অবহেলা করে, তাচ্ছিল্য করে, লাঞ্ছিত করে সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া আর সম্ভব হতো না। আমরা আশা করি আদর্শ শিক্ষকদের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। তবেই আমরা আগামীর একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠন করতে পারবো,আলোকিত মানুষ পাবো, সোনার বাংলাদেশ সোনায় সোনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।