ক্রান্তিকাল ও টানাপোড়েন শেষে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে নতুন এক সকালে। এই নতুন সূর্যোদয় পেতে মূল্য দিতে হয়েছে অঢেল। রক্তরঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সাধারণ মানুষের মনে পুষে রাখা দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ-কষ্টের বহিঃপ্রকাশের মধ্যদিয়ে সরকার পতনের মাধ্যমে গঠিত বহুদিনের কাঙ্খিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সু-স্বাগতম। দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের তাৎক্ষণিক কিছু প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে। তাদের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। ঘুষমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, সিন্ডিকেটমুক্ত, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজমুক্ত, উগ্রবাদমুক্ত সমাজ এখন সবার প্রত্যাশা। ঘুষ, দুর্নীতি, বাজার সিন্ডিকেট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী উগ্রবাদ সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। খেলাপি ঋণ বিদেশে টাকা পাচার দেশের অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে নিরলস কাজ করবে সেটিই এখন সবার প্রত্যাশা।
জাতীয় অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনতে হলে সর্বাগ্রে চাই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, যা জনজীবন সচল ও স্বাভাবিক রাখার জন্য অপরিহার্য। দলমত নির্বিশেষে জনগণ ও সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে সরকারকে কাজ করে যেতে হবে। নবগঠিত সরকারের কাছে মানুষের যেসব প্রত্যাশা দিনে দিনে তৈরি হবে, তার প্রতিটি পূরণে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সক্রিয় থাকবে, এমনটাই চাওয়া। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী রাষ্ট্রগঠনে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে ফিরিয়ে আনতে তারা বড় ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। জনগণের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনগণ এমনটাই প্রত্যাশা করে। বিগত সরকারের সময়ে জননিরাপত্তার বিষয়টি ছিল উপেক্ষিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ছিল সরকারি বাহিনীর আধিক্য। ফলে সাধারণ মানুষ এবং ভিন্নমতের মানুষকে সর্বদা তটস্থ থাকতে হয়েছে। হত্যা, খুন, গুম, ক্রসফায়ার, নির্যাতন সবই হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এ পরিস্থিতির উন্নতি চায় সাধারণ মানুষ। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে, নিরপেক্ষভাবে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সবার জন্য সমান সুযোগ ও সুবিচার নিশ্চিত করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান অব্যাহত রাখবে। যেমন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি। সব ধরনের দুর্নীতি রোধ করতে পারে এবং সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় নিশ্চিত করতে হবে। দেশব্যাপী নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা একটি অন্তর্বতীকালীণ সরকারের প্রধান দায়িত্ব। জনগণ আশা করে তারা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং জনগণের জীবনের সুরক্ষা দেবে। বিশেষ কোনো সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। পুলিশ বাহিনীকে স্বাভাবিক কাজে ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। জনগণের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা কমিয়ে আনা এবং ধীরে ধীরে তা দূর করা। প্রশাসনের জঞ্জাল সাফ করতে বিশেষ করে দায়িত্বের বাইরে দলীয় আনুগত্যের বিষয়গুলো দূর করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে প্রশাসনে স্থবিরতা তৈরি হবে। যেটা আগামী বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। খেলাপী ঋণ উদ্ধার, পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার পাশপাশি নতুন করে যেন খেলাপী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি না পায়, টাকা পাচার না হয় সেই দিকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সুশাসনের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরী।
ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার মনোভাব, মজুদদারি এবং সিন্ডিকেটের কারণে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি এখন ১০-এর ওপর। যদিও দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরকারের প্রতি আহ্বান ছিল সর্বস্তরের। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীদের পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে সাফাই গাইতে শোনা গেছে। সমাজ এবং মানুষের মধ্যে যে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করছে তা নিরসন করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। সুশাসনের অবর্তমানে জবাবদিহিবিহীন পরিবেশে, আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতার অবয়বের অন্যতম প্রতিফল হলো দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বের কারণে সমাজে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। নেতৃত্বের এই অধোগতির প্রেক্ষাপটই প্রত্যক্ষভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবজনিত পরিবেশ নির্মাণ করে। নেতৃত্বের কার্যকলাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে সমাজ সংসারে সে নেতৃত্বের অধীনে আস্থার সংকট তৈরি হয়। যেমন স্বেচ্ছাচারিতায়, নানান অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষায়তনে শিক্ষক, সুশীল সেবক, হাসপাতালে চিকিৎসক কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মীবাহিনী নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার সবই প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থ বিনিময় ও নানান অনিয়মের কারণে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে ভালো ও যোগ্য সুশীল সেবক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইন রক্ষক নিয়োজিত হতে পারে না। এই ধরনের সরকারের কাছে সাধারণ জনগণ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিছু বিশেষ প্রত্যাশা থাকে, যেমন:বিভেদের বদলে ঐক্য এবং সংঘাতের বদলে সমঝোতাই পারে আমাদেরকে একটি সুন্দর আগামী উপহার দিতে। সকলের কল্যাণে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
সহিংসতা কখনোই কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে না, বরং তা আরো বেশি ক্ষতি ডেকে আনে।নেতৃত্বের উচিত জনগণের কথা শুনে, তাদের সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান বের করা। দেশপ্রেম ও মানবিকতার পরিচয় দিয়ে আমরা একটি উন্নত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে পারি। সকলের কল্যাণে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে, শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর্দশের পরিবর্তে শুধুমাত্র সুবিধা দিয়ে কোন মানুষকে বেশি সময় ধরে পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে তার সুফলও স্থায়ী হবে। শান্তি এবং ক্ষমতার জন্য নয় দেশের জন্য ভাবতে হবে। এই সময়েই দুর্নীতিবাজ এবং সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে একটা সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আরো কার্যকর এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঘটনাগুলো দ্রুত সমাধান সম্ভব। অতি উৎসাহীদেরকেও খুঁজে বের করতে এবং তাদেরকেও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে, সে যে হউক। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আরো কার্যকর এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঘটনাগুলো দ্রুত সমাধান সম্ভব। অতি উৎসাহীদেরকেও খুঁজে বের করতে এবং তাদেরকেও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে, সে যে হউক। নেতৃত্ব যদি ভুল করে তবে তার খেসারত দিতে হয় সাধারণ জনগণকে। একটি দেশ তখনই উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে, যখন তার জনগণ নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে পারে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নেতৃত্বের দায়িত্ব হলো সমস্যার সমাধান করা এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কেবলমাত্র তখনই আমরা একটি উন্নত, সুরক্ষিত এবং সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে পারব। তাই, নেতৃত্বকে সতর্ক হতে হবে এবং সংবেদনশীলতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শান্তি এবং স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। আমাদের অবস্থা যেন এমন না হয় একবার জলন্ত উনুনে পোড়া আরেকবার জলন্ত কড়াইয়ে ভাজা। জনগণের নৈতিক প্রত্যাশা পূরণের মধ্যেই দেশের সমৃদ্ধি নিহিত তাই সেই পথেই আমাদের অগ্রসর হওয়াটাই শ্রেয়।মানবিকতার আলোকে, আসুন আমরা এক নতুনের সূচনা করি, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিরাপদ, সম্মানিত এবং সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হবে।