জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে রাজধানীর কাঁচাবাজারে প্রায় সব ধরনের সবজি, চালসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে এসব প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ৩ টন ও ৫ টন ট্রাকের ভাড়া দূরত্ব অনুযায়ী বেড়েছে। পরিবহন ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এ কারণে পাইকারি বাজারেই সবজির দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। একই অজুহাতে ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছে মুরগি ব্যবসায়ীরা। এদিকে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে ক্রেতা, বিক্রেতা এবং আড়তদারদের মাঝে বাকবিতণ্ডাও দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, করোনার ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন এমনিতেই সংকটে পড়েছে। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আগে থেকেই অস্থির দেশের বাজার। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি আরও উস্কে দিয়েছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে কাঁকরোল ৫৫-৬০, করলা ৭০-৮০, বরবটি ৬০-৬৫, কাঁচকলা ৩০-৩৫, আকার ভেদে মিষ্টি কুমড়া ৫০-৬০, গাজর ১২০-১৪০, বড়-ছোট হিসেবে লাউ ৬০-৭০, বরবটি ৭০-৭৫, পটোল ৬০-৬৫, টমেটো ১২০ এবং শসা ৭০ টাকা কেজিতে কিনছেন ক্রেতারা। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা দাবি করেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সবজির দামও বেড়েছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে দাম আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক ব্যবসায়ী।
আড়তগুলোতে বেড়েছে আলু, পিয়াজ, রসুন, আদাসহ সকল পণ্যের দাম, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। আড়তগুলোতে পিয়াজের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২ টাকা। রসুন এবং আদার দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে প্রায় ৩ থেকে ৫ টাকা। আলুর দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা প্রতি কেজিতে। সাদিক নামের এক আড়তদার বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গাড়ি ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আগে যেখানে ১৫ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া লাগতো সেখানে এখন ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাগছে। কাওরান বাজারের পাইকারি সবজি বিক্রেতা মো. রফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আজ সবজির দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। আমরা আরও ১০ টাকা বেশি দিয়ে বিক্রি করবো। তা না হলে আমাদের পোষাবে না। সবজির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকার ডিজেল-পেট্রোল-অকটেনের দাম বাড়িয়েছে। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবজি নিয়ে আসা ট্রাকগুলোতে খরচ বেড়েছে। এ জন্য সবজির কেজিপ্রতি খরচ বেশি পড়ায় দামটা বেড়েছে। খুচরা বিক্রিতা সবজি বিক্রেতা রেজাউল হক বলেন, পাইকারিতে হঠাৎ করে সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরাও বেশি দামে বিক্রি করছি। আলু, পিয়াজ, আদার দাম বেড়েছে। কাঁচামরিচের দাম ১৫ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে। তেলের দাম বাড়ার কারণে জিনিসের দাম বেড়েছে বলে জানান তিনি। কাওরান বাজারে সবজি নিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে আসা ট্রাক ড্রাইভার আতিকুল ইসলাম বলেন, আমার ট্রাক ৩ টনের। এতে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার সবজি আনতে পারি। আগে ঢাকায় পণ্য আনতে ভাড়া ছিল ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।
এখন সেই ভাড়া ৭ থেকে ৮ হাজার হয়েছে। এখন বলেন- যারা পণ্য আনছেন তারা কতো দামে বিক্রি করবে? আরেক ট্রাকচালক আমির আলী বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকার বেশি। তেলের বাড়তি দামসহ অন্য খরচ ধরলে এখন সেই ভাড়া হয়েছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এ কারণে আমাদের ট্রিপও কমে গেছে। অনেকেই বেশি দামে ভাড়া নিতে চাচ্ছে না। ব্যবসায়ী ফিরোজ আহমেদ বলেন, এখন যতটা না বেড়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তা আরও বেড়ে যাবে। আজকে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কিনতে পারলেও কাল থেকে হয়তো কাঁচকলার হালি কিনতে হবে ৫০ টাকায়। বেড়েছে মুরগির দামও। ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি ব্রয়লারে ৫ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা বিক্রি করছেন। গত শুক্রবারও বিক্রি হয়েছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়। কাওরান বাজারে আসা ক্রেতা রিফাত বলেন, জ্বালানি তেলের দোহাই দিয়ে আজ বিভিন্ন সবজির দাম অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য জিনিসের দামও অনেক বেড়েছে। সামনে মনে হচ্ছে আরও বাড়বে। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এটা অনেক কষ্টের। জিনিসের দাম যে হারে বাড়ছে সেই অনুযায়ী আমাদের বেতন যদি বাড়তো তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে মাছের বাজারেও। কাওরান বাজারের মাছের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব ধরনের মাছের দামও বাড়তি। সবজি বিক্রেতাদের মতো মাছ ব্যবসায়ীদেরও একই যুক্তি। ট্রাকের ভাড়া বাড়ায় সব ধরনের মাছের কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বাড়িয়েছেন তারা। তাদের ভাষ্যমতে, ঢাকার ভেতরে এক বাজার থেকে আরেক বাজারের ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তবে পণ্য পরিবহন খরচ আগের মতোই রয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ কার্ভাডভ্যান ট্রাক প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিক এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জাফর আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। আমরা শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবো। তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। কিন্তু পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ানো হয় না। গত নভেম্বর মাসে যখন ১৫ টাকা বাড়ানো হলো, তখনো আমরা পরিবহন খরচ বাড়াতে পারিনি। এখন আবার লিটার প্রতি ৩৫ টাকা বেড়েছে। এখন যদি পরিবহন ভাড়া না বাড়ানো যায় তাহলে কার্ভাডভ্যান ট্রাক প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিকরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়বে। দু’ সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে কেজিতে অন্তত ৪ টাকা বেড়েছে চালের দাম।
বর্তমানে মোটা জাতের ইরি-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৫৪-৫৫ টাকায়। ইরি-২৯ চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, মিনিকেট ৬৮ থেকে ৭০ আর নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়। দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, পাইকারি বাজার থেকেই বেশি মূল্যে কিনে আনতে হচ্ছে চাল। মেমো অনুযায়ীই দাম নিচ্ছেন তারা। লোডশেডিংয়ের কারণে মিল পর্যায় থেকে ট্রাক প্রতি চালের ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে মিল থেকে আসা নতুন চাল বস্তা প্রতি দাম বাড়তে পারে ১০০-২০০ টাকা। রাজধানীর মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ইকবাল বলেন, সহজ কথা হলো- জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে ট্রাক ভাড়া বাড়বে। ফলে চালের দামেও এর প্রভাব পড়বে। কুষ্টিয়া থেকে ২৫০ বস্তার এক গাড়ি চাল আসতে খরচ লাগে ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু আমাকে বলে দেয়া হলো পরিবহন খরচ আরও ৪ হাজার টাকা বৃদ্ধি পাবে। এখন পরিবহন খরচ বাড়লে চালের দামও বাড়বে, বৃদ্ধি পাবে ধানের দাম। এভাবেই চলতে থাকবে।