সবকিছু গতিশীল থাকলেও আমরা স্থীর হয়ে আছি একই স্থানে। স্থীর কোন কিছ টিকে থাকেতে পারে না। তার ধ্বংস নিশ্চিৎ। আমাদের অবস্থা্ও অনেকটা সেই পথে। আমরা সৃষ্টি করতে চাই, আমরা সৃষ্টির সাথে থাকতে চাই। দিন যায় দিন আসে, মাস যায় মাস আসে, বছর যায় বছর আসে, এভাবে যুগের পর যুগ চলে যায়। কিন্তু অনিয়মের বেড়াজালে, চরম বৈষম্যের চাঁদরে আমরা একই স্থানে আটকে আছি। আমরা শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত। আমাদের পদবি শরীরচর্চা কিন্ত পদমর্যাদা অশিক্ষক। শিক্ষক পদে নিয়োগ, শিক্ষক পদে কর্মরত আবার শিক্ষক পদেই চাকরি থেকে অবসর, যা আমাদের প্রতি চরম অবহেলা এবং অবিচার। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনকও বটে। আমাদের পদোন্নতির কোন সুযোগ নেই। শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে একটি পদ থাকলে শিক্ষা ক্যাডাররা তা দখলে নিয়েছেন। একই যোগ্যতা নিয়ে যারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন তারা পদোন্নতির মাধ্যমে সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্য পদে পদোন্নতির সুযোগ পান কিন্তু আমরা যারা কলেজে শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাই, তাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। যত বিপত্তি আমাদের বেলায়।
শারীরিক শক্তি ও মানসিকচিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিমত্তা বিকাশে লেখাপড়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ভূমিকারাখে খেলাধুলা। খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক বিকাশসহ বিভিন্নউপায়ে শিখতে এবং বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। খেলাধুলা শিশুদের সৃজনশীলতা এবংকল্পনা বিকাশেও সহায়তা করে। সুস্থ জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষা আর খেলাধুলারভূমিকা অনস্বীকার্য।
খেলাধুলাশুধুমাত্রশারীরিককার্যকলাপইনয়খেলাধুলাএকউন্নতশিল্পও। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে। সুস্থ দেহ ওমন কাজের প্রতি আগ্রহ এবং কাজের গতি বাড়ায়। আর দেহ ও মনকে সুস্থ রাখার জন্যখেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। খেলাধুলার মাধ্যমে একজন মানুষ শারীরিক ওমানসিক সুস্থতা লাভের পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও নেতৃত্বের গুণ অর্জন করে। কিন্তু আমাদের দেশে খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকার ফলে বর্তমান প্রজন্ম হচ্ছে শারীরিকভাবে দুর্বল ও মানসিকভাবে বিষন্নতায় ভোগে, বিপথগামী হয়ে উঠে, মাদকাসক্ত হয়ে উঠে এবং নিজেদের কিশোর গ্যাং এর সাথে যুক্ত করছে আবার অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। অত্যন্ত কার্যকরএকটি শারীরিক শিক্ষা কর্মসূচির লক্ষ্য হলদক্ষতা, জ্ঞান, শারীরিক সুস্থতা এবং আত্মবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে শারীরিক সাক্ষরতা বিকাশ করা। শারীরিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম শিশুদের সুস্থ বিকাশে উৎসাহিত করে, শারীরিকক্রিয়াকলাপ এবং খেলাধুলায় আগ্রহকে উৎসাহিত করে, স্বাস্থ্য ও শারীরিকশিক্ষার ধারণাগুলি শেখার উন্নতি করে, এবং প্রতিটি শিশু স্বাস্থ্য সুবিধাপায় তা নিশ্চিত করার জন্য ছাত্র জনসংখ্যার মধ্যে পার্থক্যগুলিকে মিটমাটকরে।এই মূল নীতিগুলি খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, ক্রীড়া দক্ষতা উন্নয়ন, শারীরিকসুস্থতা ও স্বাস্থ্যের জ্ঞান, সেইসাথে মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক অভিযোজনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যে হারে আমাদের দেশের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মোবাইল আসক্ত হচ্ছে তাতে আমাদের সামনে একটি শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থ জাতি অপেক্ষা করছে। শিক্ষার্থীরা এখন মাঠে যেতে যায় না। তারা এখন স্ক্রীনে আসক্ত হয়ে উঠেছে। যা আমদের কোন ভাবেই কাম্য নয়। আমাদের দেশে একদিকে খেলাধুলা এবং শারীরিক শিক্ষা হ্রাস পাচ্ছে আর অন্যদিকে ডায়োববেটিকস, হৃদরোগসহ নানারকম শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় দক্ষ পরিকল্পনার অভাব স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি। খেলাধুলার ক্ষেত্রে আমরা স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতিকে পরিহার করতে পারলে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে আমরাও খেলাধুলায় এগিয়ে যাবে অনেক দূর।
এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই জিডিপির ২-৩% প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে ১০% পর্যন্ত অবদান রাখতে সম্ভব। স্কটল্যান্ডের জিডিপির ২.২৫% যুক্তরাজ্যে জিডিপির ২.২০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপির ২.৫০ % এবং কানাডা নিউজিল্যান্ডে জিডিপির ১.৫% খেলাধুলার প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে।যে কোনো কাঠামোগত এবং/অথবা পুনরাবৃত্তিমূলক শারীরিক কার্যকলাপ সম্পাদিত বা অনুশীলন করা হয় যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য হল উন্নত শারীরিক সুস্থতা অর্জন করা। খেলাধুলা ভিত্তিক পদ্ধতির সম্ভাব্যতা ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারে উন্নয়নের ফলাফল আন্তর্জাতিক নীতি জুড়ে স্বীকৃত হয়েছে ঘোষণা, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে টেকসই জন্য ২০৩০ এজেন্ডা উন্নয়ন। করতে টেকসই উন্নয়নে খেলাধুলা ভিত্তিক নীতির অবদান, শারীরিক কার্যকলাপ এবং শারীরিক শিক্ষা নীতি এসডিজিতে মুখ্য খেলাধুলার টেকসই উন্নয়ন, শারীরিক শিক্ষা এবং শারীরিক কার্যকলাপ নীতি এবং গঠনমূলকএবং সমষ্টিগত উভয় নীতির জন্য দক্ষ পরিকল্পনা এবং নকশা প্রয়োজন। শারীরিক শিক্ষা, শারীরিক কার্যকলাপ এবং খেলাধুলায় বিনিয়োগ।
শারীরিক ও মানসিক সুস্থ জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা এবং ক্রীড়া শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠানে একজন ক্রীড়া শিক্ষক অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমাদের শিশুদের এবং জাতির জন্য স্কুল, কলেজগুলোতে শারীরিক শিক্ষা অধিক প্রয়োজন। দীর্ঘস্থায়ী সুখী জীবনের মূল চাবিকাঠি হলো শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা। শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলা প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেণির সঙ্গে সমান অবস্থায় থাকা উচিত। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সবল যুবসমাজ প্রয়োজন। যেসব গুণ থাকলে দেশের প্রত্যেক নাগরিক সুবুদ্ধিসম্পন্ন হয় ও নিছক ভাবাবেগ পরিহার করতে পারে এবং সুস্থ-সবল ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে; শারীরিক শিক্ষা মানুষকে এ গুণগুলো অর্জনে সহায়তা করে। সময়ের দাবির সঙ্গে আমাদেরও দাবি শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলাকে পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে চালু করে এ বিষয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করুন। এতে শিক্ষকরা যেমন সম্মানিত হবেন; তেমনি জাতিও শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠবে। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিপিএড, সম্মান এবং মাস্টার্স কোর্স চালু থাকলেও স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা বিষয়টি এখনো অবহেলিত, উপেক্ষিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকার খেলাধুলার প্রতি বেশ যত্নবান। সরকারের শুরুতেই ক্রিকেট খেলার ঝুঁড়িতে একটি সাফল্য ধরা দেয়। আমারা পাকিস্তানকে ১০ উইকেট হারিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে জয় লাভ করি। আর ঠিক এই সময়েই শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে অবহেলিত থাকবে, উপেক্ষিত থাকবে এটা সত্যিই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।
আমরা দেখি, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সুস্থ জাতি গঠনের লক্ষ্যে শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে চালু রাখা হয়েছে। কলেজ পর্যায়ে একজন ক্রীড়া শিক্ষক কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম, শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। একজন শরীরচর্চার শিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীর কাছে তিনি অতিপরিচিত, সদালাপী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন বন্ধুরূপী শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত অনেক সুবিধা-অসুবিধার কথা নির্ভয়ে তুলে ধরতে পারে, যা অন্যান্য শিক্ষকের কাছে অকপটে বলতে দ্বিধাবোধ করে। আর আমরা সেই শরীরচর্চা শিক্ষকরা এতটাই হতভাগা যে, আমাদের হাহাকার, আমাদের আর্তনাদ কেউ শোনে না। কেউ বোঝে না আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। অন্যদের পদোন্নতির সুযোগ থাকলেও আমাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। আমরা পদবঞ্চিত থেকেই অবসরে যাই। বৈষম্যবিরোধী সরকারের ঊর্ধ্বতন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, আমাদের হাহাকার, আমাদের আর্তনাদ, আমাদের চিৎকার শুনুন, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অনুভব করে, লাঘবে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এতে দেশ, জাতি সবারই মঙ্গল হবে বলে বিশ্বাস করি। আমরা শিক্ষকরা সম্মানিত হলে, জাতিও সম্মানিত হবে।