গত সপ্তাহ দু’য়েক ধরে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে যে বিষয়টি সয়লাব হয়ে আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের জোড় করে পদত্যাগ করানো, শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা। যা শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এবং এটা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনকও বটে। ইতিহাস বলে, যুগে যুগে অতিঅত্যাচারী শাসকও নত শিরে গুরুর সামনে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের দৃষ্টতা কেউ দেখাননি। শিক্ষক অবমাননা বন্ধ কর; বিচার বিভাগ স্বাধীন কর। শিক্ষকরা যদি কেউ অপরাধ করে থাকেন তবে তার জন্য আইন আছে, বিভাগীয় মামলা এবং শাস্তির বিধান আছে। তাই বলে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করাতে পারে না, শারীরিক এবং মানসিকভাবে হেনস্তা, অপমান, অপদস্ত ও নির্যাতন করতে পারে না। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, শিক্ষকতা হলো একটি ব্রত, একটি আদর্শ, একটি নৈতিক মানদন্ড। কোন ভাবেই একে কলঙ্কিত করা যাবে না। জন অ্যাডামস শিক্ষককে “Maker of Man” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানব জাতির ভবিষ্যৎ রূপকার।” শিক্ষকের সংকট থাকলে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ খুব বেশি লাভবান হয়। তাদের অন্ধকার রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার সার্বিক প্রসার এবং মানবিক গুণ বিকাশের গুরু দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত। শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধতার প্রকাশ বা বাস্তবায়ন।একজন শিক্ষক সমাজের বিবেক জাগিয়ে তোলেন। একজন ছাত্রের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করেন। তিনিই সমাজ বিনির্মাণের কারিগর। তিনিই সমাজ এবং জাতির প্রয়োজনে আলোর দিশারী হিসেবে পথ দেখান এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে সর্বদা প্রস্তুত ইতিহাস এমনটাই সাক্ষী দেয়। জাতি গঠন এবং উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো শিক্ষা। আর শিক্ষা সম্পর্কিতবিষয়গুলো হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি। তবে এ প্রসঙ্গে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। কেননা শিক্ষকই হচ্ছেন, শিক্ষা ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি। আর এখনকার দিনে শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, তাদের হুমকি প্রদান ও হত্যাকরা এবং লাঞ্ছনার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লজ্জা গোটা জাতির। এ দেশে অনেক শিক্ষক হত্যাসহ অনেকবার শিক্ষকদের ওপর হামলাচালানো এবং তাদের বারবার লাঞ্ছনার শিকার হতে হলেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগঘটনারই বিচার হয়নি। ফলে অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্য কর্মকা- ঘটাতে উৎসাহী হয়েউঠছে, যা জাতির জন্য চরম আশনিসংকেত।
সংকট যত গভীর হয় শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি শিক্ষদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে শতপ্রতিকুলতা,বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংকট যত গভীর হয় শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি শিক্ষদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে শত প্রতিকুলতা,বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শিক্ষক হলেন সমাজের বাতিঘর। এই বাতিঘর যখন অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে থখন আমরা নিজেরাও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলি। আর এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির প্রভাব পড়ে আমাদের সমাজে এবং এর ভোক্তভোগী আমরাই। শিক্ষক শিখাবেন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য, আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে,নিজের আত্মতৃপ্তি,সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য।শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ যদি নিজেরা নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে তবে সমাজে দৃশ্যমান অনেক বিশৃঙ্খলতার সমাধান হয়ে যাবে। পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দেন।কিন্তু তাকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। তাই বলা হয়, গুরুদক্ষিণা ছাড়া শিক্ষা সম্পন্ন হয় না। পৃথিবীর যে দেশ শিক্ষকদের যত বেশি মর্যাদা দিয়েছেন সেই দেশ সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তত বেশি উন্নত। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং একটিমহান পেশা। একজন শিক্ষক জানেন, তার চলার পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ এবংভবিষ্যৎ বিড়ম্বনাময়। তবু তিনি হৃদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এজন্য তাকে জীবনব্যাপী সংগ্রাম করতে হলেও তিনি আদর্শচ্যুত হন না। সর্বদান্যায়নীতির প্রশ্নে আপসহীন। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর এ নামেই আখ্যায়িত। শিক্ষা নিকেতন তার কর্মশালা। তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তিরবিকাশ পরিশীলন ও উন্নয়ন প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বলা যায়, একজন শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে অন্যতম।
“যিনি জানেন, তিনি করেন, যিনি বোঝেন, তিনি পড়ান” এ্যারিস্টোটল। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষকরা হলেন স্নায়ুতন্ত্র। যার ভিতর দিয়ে সব সময় প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা,নতুন সভ্যতা। সভ্যতার সুচারু কারিগড় হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক সর্বদাই মানবিক, নৈতিক। তিনি কখনোই ব্যবসায়িক চিন্তা করনে না। তিনি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধী। যিনি শিক্ষক তার পক্ষে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর কোন রকম ক্ষতি সাধান সম্ভব হয় না। তিনি সর্বদা সৃজনশীল, অধিকার চেতা। তিনি ছাত্রদের মাধ্যমে সমাজকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্নের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন,অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখান, ছাত্রের ভিতরকে জাগিয়ে তোলেন। শিক্ষক সেই যিনি সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমম্পর্ক এবং পরিবেশ সৃষ্টিতে বা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। যিনি প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য এবং সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে। যার কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য বলতে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শিখে, বলার সাহস সঞ্চয় করে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যিনি শিক্ষক তিনি ছাত্রদের শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। শুধুমাত্র পরিক্ষায় পাশের জন্যই শিখানো শিক্ষকের কাজ নয়, তিনি শিখান জীবনকে জানার জন্য, জীবনকে বোঝার জন্য এবং জীবনকে পাশ করার জন্য। শিক্ষকের শিক্ষতার জন্যই সমাজ-সভ্যতা ও জাতীয় জীবনে গতিশীলতা আসে। শিক্ষকের সীমাহীন ত্যাগ,শ্রম ও মেধার কারণেই আমরা আজ সভ্যতার উন্নত শিখরে উন্নীত হয়েছি। শিক্ষক শ্রমজীবী থেকে শুরু সকল শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন এবং তিনি নিজেও শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করেন তেমনি ছাত্রদেরকে শিখান শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে লড়তে ও তাদেরকে শ্রদ্ধা করতে।শিক্ষকের আসন শুধু শ্রেণি কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছড়িয়ে থাকেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শিক্ষক না থাকলে ব্যক্তি জীবন যেমন আলোকিত হয় না তেমনি সমাজ সভ্যতাও আলোকিত হয় না। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আজ তরুণ সমাজ, যুব সমাজ বিপথগামী। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আমাদের সমাজ-সভ্যতা অর্থনীতি সংকটের মুখে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদনে গতিশীলতা পাচ্ছে না।
শিক্ষক এবং শিক্ষার যে সংকট চলছে তা থেকে বরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ভালো কাজে হ্যাঁ বলুন ,খারাপ কাজকে না বলুন। আমরা যদি আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চাই তবে শিক্ষকের পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে কোনো শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করা যাবে না। শিক্ষকদের দক্ষতাকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও শিক্ষার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আশা করি আদর্শ শিক্ষকদের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবী সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে শিক্ষকদের বেতন সর্বনিন্ম, যেখানে শিক্ষকদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, যেখানে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, যেখানে শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আরও একটি দুঃখজনক বিষয় হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা এখনো তারা অনুদানের চেকের মাধ্যমে মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন। অনুদান কোনো সম্মানের বিষয় হতে পারে না। আামদের দেশের কোন সরকারই শিক্ষকদের মূল্যায়ন করেননি বরং সরকারগুলো নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষকদের ব্যবহার করেছেন। এবং তার এ ধারাবাহিকতায় সুযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আজকে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদেরকে জোর করে পদত্রাগ করাচ্ছে, অপমান, অপদস্ত করছে। অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর যদি সঠিক বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেত তবে আজকে এই ধরনের লজ্জাজনক কাজের পূর্ণাবৃত্তি নাও ঘটতে পারত। শিক্ষকদে এতোকিছুর পরও আমাদের শিক্ষকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের কিছু শিখাতে, কিছু জানাতে। শিক্ষকের চোখেই আমরা জগৎ দেখি। মানব সভ্যতা বিনির্মাণে শিক্ষক সমাজের রয়েছে বড় অবদান। আর এ জন্যই যুগে যুগে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা সবার ওপরে। তাকে সম্মান করো যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো। মহান সৃষ্টিকর্তাই তাদের মর্যাদার মুকুট পরিয়েছেন। দেশ ও জাতির স্বার্থেই শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত থাকলেও বাংলাদেশে এর লেশমাত্র নেই। আজকের বাজারমূল্যে শিক্ষকদের অবস্থা নুন আনতে পান্থা ফুরানোর মতো। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল নামক একটি মুলা ঝুলছে গত ১৫ বছর ধরে।হল মার্কের চার হাজার কোটি টাকা, ডেসটিনির প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাচার হওয়া অর্থ, ঋণখেলাপি এবং কালোটাকার পরিমাণ আমাদের বাজেটের তিন ভাগের একভাগ। গত দশ বছরে শুধু চালের বাজার থেকে দেশীয়লুটেরা হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচারহয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। এই টাকা উদ্ধার করতে পারলে গোটা দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে। সবশেষ আবারো আবেদনের সুরে বলি, শিক্ষক অবমননা বন্ধ কর; বিচার বিভাগ স্বাধীন কর। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই এর সঠিক সমাধান সম্ভব।
গত সপ্তাহ দু’য়েক ধরে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে যে বিষয়টি সয়লাব হয়ে আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের জোড় করে পদত্যাগ করানো, শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা। যা শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এবং এটা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনকও বটে। ইতিহাস বলে, যুগে যুগে অতিঅত্যাচারী শাসকও নত শিরে গুরুর সামনে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের দৃষ্টতা কেউ দেখাননি। শিক্ষক অবমাননা বন্ধ কর; বিচার বিভাগ স্বাধীন কর। শিক্ষকরা যদি কেউ অপরাধ করে থাকেন তবে তার জন্য আইন আছে, বিভাগীয় মামলা এবং শাস্তির বিধান আছে। তাই বলে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করাতে পারে না, শারীরিক এবং মানসিকভাবে হেনস্তা, অপমান, অপদস্ত ও নির্যাতন করতে পারে না। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, শিক্ষকতা হলো একটি ব্রত, একটি আদর্শ, একটি নৈতিক মানদন্ড। কোন ভাবেই একে কলঙ্কিত করা যাবে না। জন অ্যাডামস শিক্ষককে “Maker of Man” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানব জাতির ভবিষ্যৎ রূপকার।” শিক্ষকের সংকট থাকলে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ খুব বেশি লাভবান হয়। তাদের অন্ধকার রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার সার্বিক প্রসার এবং মানবিক গুণ বিকাশের গুরু দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত। শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধতার প্রকাশ বা বাস্তবায়ন।একজন শিক্ষক সমাজের বিবেক জাগিয়ে তোলেন। একজন ছাত্রের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করেন। তিনিই সমাজ বিনির্মাণের কারিগর। তিনিই সমাজ এবং জাতির প্রয়োজনে আলোর দিশারী হিসেবে পথ দেখান এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে সর্বদা প্রস্তুত ইতিহাস এমনটাই সাক্ষী দেয়। জাতি গঠন এবং উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো শিক্ষা। আর শিক্ষা সম্পর্কিতবিষয়গুলো হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি। তবে এ প্রসঙ্গে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। কেননা শিক্ষকই হচ্ছেন, শিক্ষা ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি। আর এখনকার দিনে শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, তাদের হুমকি প্রদান ও হত্যাকরা এবং লাঞ্ছনার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লজ্জা গোটা জাতির। এ দেশে অনেক শিক্ষক হত্যাসহ অনেকবার শিক্ষকদের ওপর হামলাচালানো এবং তাদের বারবার লাঞ্ছনার শিকার হতে হলেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগঘটনারই বিচার হয়নি। ফলে অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্য কর্মকা- ঘটাতে উৎসাহী হয়েউঠছে, যা জাতির জন্য চরম আশনিসংকেত।
সংকট যত গভীর হয় শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি শিক্ষদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে শতপ্রতিকুলতা,বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংকট যত গভীর হয় শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি শিক্ষদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে শত প্রতিকুলতা,বাঁধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শিক্ষক হলেন সমাজের বাতিঘর। এই বাতিঘর যখন অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে থখন আমরা নিজেরাও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলি। আর এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির প্রভাব পড়ে আমাদের সমাজে এবং এর ভোক্তভোগী আমরাই। শিক্ষক শিখাবেন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য, আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে,নিজের আত্মতৃপ্তি,সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য।শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ যদি নিজেরা নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে তবে সমাজে দৃশ্যমান অনেক বিশৃঙ্খলতার সমাধান হয়ে যাবে। পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দেন।কিন্তু তাকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। তাই বলা হয়, গুরুদক্ষিণা ছাড়া শিক্ষা সম্পন্ন হয় না। পৃথিবীর যে দেশ শিক্ষকদের যত বেশি মর্যাদা দিয়েছেন সেই দেশ সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তত বেশি উন্নত। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং একটিমহান পেশা। একজন শিক্ষক জানেন, তার চলার পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ এবংভবিষ্যৎ বিড়ম্বনাময়। তবু তিনি হৃদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এজন্য তাকে জীবনব্যাপী সংগ্রাম করতে হলেও তিনি আদর্শচ্যুত হন না। সর্বদান্যায়নীতির প্রশ্নে আপসহীন। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর এ নামেই আখ্যায়িত। শিক্ষা নিকেতন তার কর্মশালা। তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তিরবিকাশ পরিশীলন ও উন্নয়ন প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বলা যায়, একজন শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে অন্যতম।
“যিনি জানেন, তিনি করেন, যিনি বোঝেন, তিনি পড়ান” এ্যারিস্টোটল। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষকরা হলেন স্নায়ুতন্ত্র। যার ভিতর দিয়ে সব সময় প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা,নতুন সভ্যতা। সভ্যতার সুচারু কারিগড় হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক সর্বদাই মানবিক, নৈতিক। তিনি কখনোই ব্যবসায়িক চিন্তা করনে না। তিনি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধী। যিনি শিক্ষক তার পক্ষে শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর কোন রকম ক্ষতি সাধান সম্ভব হয় না। তিনি সর্বদা সৃজনশীল, অধিকার চেতা। তিনি ছাত্রদের মাধ্যমে সমাজকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্নের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন,অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখান, ছাত্রের ভিতরকে জাগিয়ে তোলেন। শিক্ষক সেই যিনি সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমম্পর্ক এবং পরিবেশ সৃষ্টিতে বা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। যিনি প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য এবং সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে। যার কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য বলতে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শিখে, বলার সাহস সঞ্চয় করে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যিনি শিক্ষক তিনি ছাত্রদের শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। শুধুমাত্র পরিক্ষায় পাশের জন্যই শিখানো শিক্ষকের কাজ নয়, তিনি শিখান জীবনকে জানার জন্য, জীবনকে বোঝার জন্য এবং জীবনকে পাশ করার জন্য। শিক্ষকের শিক্ষতার জন্যই সমাজ-সভ্যতা ও জাতীয় জীবনে গতিশীলতা আসে। শিক্ষকের সীমাহীন ত্যাগ,শ্রম ও মেধার কারণেই আমরা আজ সভ্যতার উন্নত শিখরে উন্নীত হয়েছি। শিক্ষক শ্রমজীবী থেকে শুরু সকল শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন এবং তিনি নিজেও শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করেন তেমনি ছাত্রদেরকে শিখান শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে লড়তে ও তাদেরকে শ্রদ্ধা করতে।শিক্ষকের আসন শুধু শ্রেণি কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছড়িয়ে থাকেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শিক্ষক না থাকলে ব্যক্তি জীবন যেমন আলোকিত হয় না তেমনি সমাজ সভ্যতাও আলোকিত হয় না। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আজ তরুণ সমাজ, যুব সমাজ বিপথগামী। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আমাদের সমাজ-সভ্যতা অর্থনীতি সংকটের মুখে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদনে গতিশীলতা পাচ্ছে না।
শিক্ষক এবং শিক্ষার যে সংকট চলছে তা থেকে বরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ভালো কাজে হ্যাঁ বলুন ,খারাপ কাজকে না বলুন। আমরা যদি আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চাই তবে শিক্ষকের পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে কোনো শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করা যাবে না। শিক্ষকদের দক্ষতাকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও শিক্ষার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আশা করি আদর্শ শিক্ষকদের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবী সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে শিক্ষকদের বেতন সর্বনিন্ম, যেখানে শিক্ষকদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, যেখানে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, যেখানে শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আরও একটি দুঃখজনক বিষয় হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা এখনো তারা অনুদানের চেকের মাধ্যমে মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন। অনুদান কোনো সম্মানের বিষয় হতে পারে না। আামদের দেশের কোন সরকারই শিক্ষকদের মূল্যায়ন করেননি বরং সরকারগুলো নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষকদের ব্যবহার করেছেন। এবং তার এ ধারাবাহিকতায় সুযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আজকে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদেরকে জোর করে পদত্রাগ করাচ্ছে, অপমান, অপদস্ত করছে। অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর যদি সঠিক বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেত তবে আজকে এই ধরনের লজ্জাজনক কাজের পূর্ণাবৃত্তি নাও ঘটতে পারত। শিক্ষকদে এতোকিছুর পরও আমাদের শিক্ষকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের কিছু শিখাতে, কিছু জানাতে। শিক্ষকের চোখেই আমরা জগৎ দেখি। মানব সভ্যতা বিনির্মাণে শিক্ষক সমাজের রয়েছে বড় অবদান। আর এ জন্যই যুগে যুগে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা সবার ওপরে। তাকে সম্মান করো যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো। মহান সৃষ্টিকর্তাই তাদের মর্যাদার মুকুট পরিয়েছেন। দেশ ও জাতির স্বার্থেই শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত থাকলেও বাংলাদেশে এর লেশমাত্র নেই। আজকের বাজারমূল্যে শিক্ষকদের অবস্থা নুন আনতে পান্থা ফুরানোর মতো। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল নামক একটি মুলা ঝুলছে গত ১৫ বছর ধরে।হল মার্কের চার হাজার কোটি টাকা, ডেসটিনির প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাচার হওয়া অর্থ, ঋণখেলাপি এবং কালোটাকার পরিমাণ আমাদের বাজেটের তিন ভাগের একভাগ। গত দশ বছরে শুধু চালের বাজার থেকে দেশীয়লুটেরা হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচারহয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। এই টাকা উদ্ধার করতে পারলে গোটা দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে। সবশেষ আবারো আবেদনের সুরে বলি, শিক্ষক অবমননা বন্ধ কর; বিচার বিভাগ স্বাধীন কর। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই এর সঠিক সমাধান সম্ভব।