(লন্ডন) – অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী সততা ও সাহসিকতায় ছিলেন মহান রাজনীতিক। এ মন্তব্য করেছেন বেগম মতিয়া চৌধুরীর প্রয়াণে লন্ডনে আয়োজিত শোকসভার সুধীজন। গেল ২রা নভেম্বর লন্ডনে আয়োজন করা হয় সদ্য প্রয়াত বেগম মতিয়া চৌধুরীর এই শোকসভা। আয়োজন করেন প্রাক্তণ ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী, নেতা ও সুহৃদজন।
উনসত্তরের গণআন্দোলনের ছাত্র নেতা হাবিব রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা পরিচালনা করেন নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা সৈয়দ এনামুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন উনসত্তরের ছাত্র নেতা ডা. আশফাক আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মুস্তফা, ন্যাপনেতা আব্দুল মান্নান ও আব্দুল আজিজ। আরো বক্তব্য রাখেন প্রাক্তণ ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী লুসি রহমান, সত্যব্রত দাস স্বপন, হামিদ মোহাম্মদ, নীলুফা ইয়াসমীন হাসান, সাহাব আহমদ বাচ্চু, রবিউল হক লেনিন, ফেরদৌসী লিপি, পুস্পিতা গুপ্তা, দৈনিক সংবাদের প্রাক্তণ সাংবাদিক মান্না রায় ও লেখক চৌধুরী শামসুদ্দিন রুমি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বেগম মতিয়া চৌধুরীর প্রয়াণের পর রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান না-করা ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কবরের স্থান না-দেয়ায় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বক্তারা আত্মসমলোচনা করে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্রমাগত মৌলবাদীদের উত্থানে ছাড় দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সকলেই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার জন্য দায়ী। রাষ্ট্রক্ষমতায় জামায়াত না-এলেও বর্তমান ইউনুস সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে জামায়াতে ইসলাম। বক্তারা অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, সুতরাং মতিয়া চৌধুরীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না-পাওয়ার জন্য আফসোস না-করে দেশকে মৌলবাদী জামায়াত মুক্ত করার লড়াই নতুন করে শুরু করতে হবে।
শোকসভায় বাংলাদেশ থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভগের প্রফেসর ড. জোবাইদা নাসরীন কণা। তিনি ব্যক্তিজীবনে বেগম মতিয়া চৌধুরীর মাতৃস্নেহ প্রাপ্তি নিয়ে হৃদনিঙড়ানো কথায় প্রয়াতের সাধারণ জীবনযাপন, তেজদীপ্ত রাজনীতিক কর্মপন্থা ও দেশপ্রেমে স্নিগ্ধতা সম্পর্কে আবেগঘন কথা বলেন।
বক্তারা স্মৃতিচারণ করে বলেন, মতিয়া চৌধুরী ছিলেন যুগের অগ্রসর চিন্তাচেতনার অধিকারি বাঙালি ও বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি আন্দোলনের সাহসিকা অগ্নিকন্যা।বক্তারা বলেন, তাঁর বীরত্বপূর্ণ রাজনীতি অনুপ্রাণিত করেছিল ছাত্রইউনিয়নের পতাকাতলে তরুণ সমাজকে সমবেত হতে। আলোচনায় উঠে আসে বেগম মতিয়া চৌধুরী বর্ণাঢ্য জীবন। বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে বক্তরা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বর্ণাক্ষরে যাদের নাম লেখা থাকবে তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী অন্যতম। শোকসভায় আগত মতিয়া চৌধুরীর ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর অকুতোভয়, আপসহীন ও লড়াকু ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। কোনো লোভ, প্রলোভন বা গণবিরোধী কাজ কখনোই অগ্নিকন্যাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও আইয়ূব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তিনি ‘অগ্নিকন্যা’ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মতিয়া চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ছাত্র ইউনিয়ন থেকে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া প্রবীণ এই রাজনীতিক সততার রাজনীতি করেছেন সারা জীবন। রাজপথে তাঁর সোচ্চার বিচরণ ছিল। বাম ধারার রাজনীতি দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করা মতিয়া চৌধুরী ১৯৪২ সালের ত্রিশে জুন পিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি শেরপুর-২ আসন থেকে ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং সর্বশেষ সংসদের উপনেতা ছিলেন। ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
১৯৬১-৬২ মেয়াদে তিনি ছিলেন ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের ভিপি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠনে তিনি অন্যতম সংগঠকের ভুমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।পাকিস্তান বিরোধী সংগ্রামকালে ও পরে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনামলে অনেকবার গ্রেফতার হন ও মোট পনেরবার কারাবরণ করেন মতিয়া চৌধুরী। মতিয়া চৌধুরী তিনবার কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে সারাজীবনই সাধারণ বেশভূষা আর সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য পরিচিত ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। ষাটের দশকে জেল জীবন নিয়ে তাঁর লেখা ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা‘ বইটি একটি অসাধারণ রাজনৈতিক সাহিত্য।
উল্লেখ্য, গত ১৬ অক্টোবর ৮২ বছর বয়সে বাংলাদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চির বিদায় নেন মতিয়া চৌধুরী। তাঁর স্বামী প্রয়াত সাংবাদিক বজলুর রহমানের কবরে মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তিনি শায়িত হন। শোকসভার শুরুতে প্রয়াত মতিয়া চৌধুরীর সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া বেগম মতিয়া চৌধুরীর বর্ণাঢ্য জীবনভিত্তিক প্রামান্যচিত্র প্রদর্শন করার মধ্য দিয়ে সভা শুরু হয়।