ঘাটের মাঝিরা জানান, যাত্রীর চাপ থাকলে দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আয় কম। ২০০-৪০০ টাকা আসে কোনোমতে। যাত্রীর সংখ্যাও দিনে দিনে কমছে। এরমধ্যে ডিজেলের দাম বাড়ায় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ৫-১০ টাকায় নদী পার করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। যারা বৈঠাচালিত নৌকা চালান, পাঁচ টাকা ভাড়ায় নদী পার করে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারাও। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়াজঘাটে নদী পারাপারে ২০০-২৫০টি নৌকা চলাচল করে। এরমধ্যে ৪০-৫০টি ইঞ্জিনচালিত। বাকিগুলো বৈঠা বেয়ে চলে। তবে নিয়মিত চলে দেড়শোর মতো নৌকা। অধিকাংশ মাঝিই এসব নৌকা ভাড়া নিয়ে চালান।
ওয়াজঘাট থেকে বৈঠাচালিত নৌকায় খাজা মার্কেট, নাগর মহল, ইস্পাহানীঘাট পর্যন্ত জনপ্রতি পাঁচ টাকা ভাড়া। এছাড়া আলম মার্কেট, ব্রিজঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাত্রীদের ভাড়া ১০ টাকা।
ইঞ্জিনচালিত নৌকায় একই রুটে ভাড়া নেওয়া হয় যথাক্রমে ১০ ও ২০ টাকা। প্রতিবার যাতায়াতে একটি নৌকায় সর্বোচ্চ পাঁচজন যাত্রী নেন মাঝিরা। কখনো কখনো একজন যাত্রী নিয়েও নদী পারাপার করতে হয় তাদের। অনেকে আবার রিজার্ভও নেন।
ইঞ্জিনে চলা নৌকায় দিনে দুই থেকে চার লিটার তেল খরচ হয়। যাত্রীর ভালো মিললে তেলসহ সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০০-৬০০ টাকা থাকে, যা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলছিল ওয়াজঘাটের মাঝিদের। তবে জ্বালানির দাম বাড়ার পর তেল খরচ বাদ দিয়ে পকেটে কিছুই থাকছে না তাদের। ফলে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে মাঝিদের।
তেল খরচেই ফুরিয়ে যাচ্ছে আয়
বর্তমানে ডিজেলের লিটার ১১৪ টাকা। এতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় দিনে তেল খরচই হচ্ছে ৩৫০-৪০০ টাকা। ফলে আগের চেয়ে বেশি ভাড়া হলেও তেলের খরচে চলে যাচ্ছে আয়ের সিকিভাগ।
২৫ বছর ধরে ওয়াজঘাটে নৌকা চালান বরিশালের মো. ইব্রাহিম হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘আগে কম টাকা ভাড়া ছিল। তবুও ভালোভাবে চলতে পারতাম। এখন ভাড়া ৫-১০ টাকা হলেও চলতে পারছি না। ঘাটে অনেক নৌকা হয়েছে, মাঝিও বেশি। দিনে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালানোও দায়। সবকিছুর দামই বাড়তি।’
আব্দুর রহিম নামের আরেক মাঝি বলেন, ‘ইঞ্জিন লাগাইয়া এখন বেশি আসা-যাওয়া করতে পারি। কিন্তু তেল খরচাই সব চইলা যায়।’
যাত্রীরা বলছেন, ওয়াজঘাটে নৌকাভাড়া বাড়ানো হয়নি। তবে এখন প্রায়ই বকশিশ চান মাঝিরা। জ্বালানির দাম বাড়ায় তাদের খরচ বেড়েছে বলে জানান। যাত্রীরা সাধ্যমতো দেনও অনেক সময়।
ইকবাল নামের একজন যাত্রী বলেন, ‘প্রতিদিনই কাজের জন্য সদরঘাটে আসতে হয়। যখন তাড়া থাকে, তখন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আসি। যখন হাতে সময় থাকে, বৈঠাচালিত নৌকায় চড়ি। ভাড়া আগের মতোই আছে।’
পরিবার নিয়ে নিউমার্কেটে আসা জাফর বলেন, ‘মাথাপিছু ১০ টাকা ভাড়া নেন মাঝিরা। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বের হয়েছি। তাই নৌকায় অন্যদের তুলতে দিইনি, রিজার্ভ নিয়ে পার হয়েছি। ভাড়া যা হয়, তার থেকে ১০ টাকা বেশি দিয়েছি।’
বেশি বিপাকে ভাড়ার নৌকা চালানো মাঝিরা
ঘাটে চলাচল করা নৌকার অধিকাংশই ভাড়ায় চালিত। বৈঠাচালিত নৌকার ভাড়া দিনে ১০০ টাকা করে। আর ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভাড়া ১৫০ টাকা। এছাড়া লাইনম্যানকে ১০ টাকা ও পাহারাদারকে দিনে ১০ টাকা করে দিতে হয়।
বুড়িগঙ্গায় নৌকা চালানোকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের অনেকের পরিবার থাকে গ্রামে। কোনো কাজ না পেয়ে নৌকা চালিয়ে জীবন চলে তাদের।
৫০ বছর ধরে ঘাটে নৌকা চালান শাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘১০ পয়সা, এক টাকা করে মানুষ পার করছি। এখন ভাড়া পাঁচ টাকা হয়েছে। অন্য কোনো কাজ করার মতো নেই। বাধ্য হয়ে নৌকা চালিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে।’
৬০ বছর বয়সী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওপার থেকে দেড় ঘণ্টা লাগছে একটা ভাড়া নিয়ে আসতে। আগে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকতো। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতো না।’
জামাল হাওলাদার নামের আরেক মাঝি বলেন, ‘নৌকা চালিয়ে আমরা এখন ভালো নেই। পদ্মা সেতু হওয়ার পর লঞ্চঘাটে যাত্রী কমে গেছে। এখন নদীর দুই পাড়ের মার্কেট ও স্থানীয় লোকজনই শুধু পারাপার করি।’
ঘাটে ওঠা-নামায় ভোগান্তি
ওয়াজঘাটে ওঠা-নামায় নেই তেমন ভালো সিঁড়ি। নদীর পানি কমে গেলে অনেক নিচে নেমে নৌকায় চড়তে হয়। নদীর পাড়ও তখন ভালো থাকে না। এতে বৃদ্ধ ও শিশুরা ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় ওঠা-নামা করেন।
মাঝিরা জানান, নৌকায় ওঠার জন্য ভালো সিঁড়ি ও নদীর পাড় আরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা খুব জরুরি।
ঘাটের ইজারা নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন ২০ -৩০ হাজার মানুষ ওয়াজঘাটে নদী পারাপার হয়। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে ৩০-৪০ হাজার মানুষের ঘাটে আনাগোনা ছিল। ঘাটে যাত্রীদেরকে মাথাপিছু দুই টাকা করে পারাপারের জন্য চার্জ দিতে হয়। এতে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার টাকা তোলেন ইজারাদার।