কথায় বলে আসমান-জমিন ফারাক। এই কথার মানে কি? হানিফ বেশ মজা করে বল্লো, এই সোজা কথার মানে বোঝনা? এটি হচ্ছে কারো সাথে কারো তুলনা করাই হলো আসমান-জমিন ফারাক, আমাদের মধ্যেই এর প্রমান আছে যেমন ধরো রফিক কলেজে ভদ্র নম্র এবং পড়াশুনায় ও বেশ। অপর দিকে মজিদকে দেখো সে একজন “ল্যাবেনডিশ মার্কা” ছাত্র, না পারে পড়াশুনা ঠিক ভাবে করতে বা কথা বলতে। এখন তোমরাই বলো এই দু’জনের মধ্যে অনেক ফারাক, তাই এটাই হলো আসমান-জমিন ফারাক।
সেদিনের মতো মজলিশ ভেঙে যার যার মতো বাড়ি ফিরে যায় সবাই। রাস্তায় নেমে প্রায় সবাই গেলো বাদিকের গলিতে অপর দিকে নিতীশ গেলো ডান দিকের গলিতে। সে জানে একটু পরেই বন্ধুরা তাকে খুঁজবে কারণ সব বন্ধুরা একই গলিতে থাকে। সেই গলির পুরানো বাসিন্দাদের মধ্যে নিতীশরাই হলো বনেদী ঘরের সন্তান ও স্থানীয়।
কেন নিতীশ ডান দিকের গলিতে প্রবেশ করলো? কারণ ঐ গুলিতেই তার প্রেমিকা থাকে। রাত কম হয়নি। মজলিস যখন ভেঙে ছিল তখনই প্রায় দশটার কাছাকাছি। অত রাতে সেও জানে এখন আর শিউলির সাথে দেখাও হবে না আর কথাও হবে না, তারপরও সে ঐ পথেই গেলো, যেতে যেতে কয়েকবার মনে মনে আওরালে, “লাইলীর প্রেমে মজনু পাগল” ঠিক সে রকমই যেনো, শিউলির প্রেমে নিতীশ পাগল।
সত্যি সত্যিই সেদিন আর দেখা হয়নি। তারপরও শিউলিদের বাড়ীর আশ-পাস দিয়ে ঘুরেছে সেটাই তার সান্তনা। এবার সে গলির মোড়ের কাছে ছোট্ট চা বিস্কুটের দোকান আছে সেখানে বেঞ্চে বসে এক কাপ লেবু চা চাইলো গোবড়ধনের দোকানে। এই ছাপড়া দোকানে চাও বেচা কিনা হতো তাই এক কাঁচের গ্লাসে চা পান করে মিস্টি পান খেতে খেতে বাড়ীর দিকে পা বাড়ালো।
পরের দিন ভোরে প্রাতঃভ্রমনে এক নিতীশ বাদে আর সবাই পার্কের চতুর দিকে কয়েক পাক দিয়ে হালকা বিয়াম সেরে চলে যাবার জন্য পা বাড়ানোর উপক্রম করতেই দেখে একটা মেয়ে দৌডে তাদের দিকে আসছে চিৎকার দিতে দিতে। কাছে আসতেই সে বল্লো, রোজকার মতো সে মর্নিংওয়াক করতে এই পার্কে এসেছিল যদিও তার সাথে তার এক বন্ধুও থাকতো কিন্তু আজ সে আসবে না বলে একাই চলে এল, প্রতিদিনের অভ্যাস মতো। সে বল্ল “ঐ পুকুর ধারে আসতেই দেখি চাদর মুড়ী দেওয়া একটি লোক বেঞ্চে বসা। আমি তার কাছ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম ঠিক তখন সে আমাকে জাপটে ধরার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াতেই আমি খুব ভয় পেয়ে যাই, আর ঐ লোকটি নিজের চাদরে পা আটকে পডে যায়, আর এই সুযোগে চিৎকার দিয়ে আপনাদের কাছে ছুটে এলাম”। আমরা মেয়েটিকে আশ্বাস দিলাম ভয়ের কিছু নাই, চলেন দেখি কোথায় সেই লোকটি? সম্পূর্ন পার্কটির চক্কর মেরেই দুষ্টু লোকটিকে আর পাওয়া গেলো না।
মেয়েটি চলে যাবার সময় আমাদের লক্ষ্য করে বল্লে, আপনারা যেনো আজ আসমানের উজ্বল তারা (স্টার) হয়ে আমাকে বাঁচালেন। আমরা হেসে উত্তর দিলাম, আসমানের তারা (স্টার) আমরা নই তবে জমিনের কতিপয় যুবক মাত্র। বেশ কিছুদিন পরে দেখি আমাদেরই এক বন্ধু আশেক সেই মেয়েটির সাথে পার্কে ঘুরছে হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে। বুঝলাম প্রেমের চক্করে সে বাধা পড়েছে।
দিন যেতে না যেতে রকিবুল কান্না জরিত কন্ঠে জানালো আগামীতে মনে হয় তোদের সাথে আর হাসি তামাসা করা হয়ে উঠবে না কারণ আমি কয়েকদিনের মধ্যেই গ্রামের বাডীতে মা-বাবার কাছে ফিরে যাচ্ছি। এতদিন তো মামার বাড়িতে কাটালাম, আর কত? এবার আর নানান বাহানা কাজ দিল না, আগে মামা মামীকে চাকরী কিংবা টিউশনির কথা বলে বলে দিন পার করেছি কিন্তু এখন আর নয়, তারা আমার ছল চাতুরী বুঝে ফেলেছে।
কিছুদিন পর আমজাদ খুশী মনে আমাদের ক্লাব ঘরে এসে জানান দিলো আগামী মাসে সে পড়তে বিলেত যাচ্ছে। আমরা দেখলাম আমাদের দুই বন্ধু হঠাৎ করেই বিয়োগ হয়ে গেলো। সপ্তাহ না ঘুরতেই নিতীশ মুখ বেজাড করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘোষণা দিলো সে প্রেমে ব্যার্থ হয়েছে তাই এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, সে কারণেই বাবা মায়ের দোয়া নিয়েই শিউলীর পিছে পিছে কলকাতায় যাচ্ছে। নিতীশদের আগেই পাটের ব্যাবসা ছিল তাই তার অভিভাবকরা এক মূহুর্ত চিন্তা না করে নিতীশ কে ব্যাবসা বানিজ্য দেখার জন্য অনুমতি দিয়ে দিল।
বন্ধুদের বিভিন্ন স্থানে চলে যাওয়ায় উপস্থিত বাকী বন্ধুদের মনে হতাশা নেমে এলো, তাই বলে হাসি-ঠাট্টা, খেলা-ধূলা সমান তালে অব্যাহত রইলো। এক বিকালে মনির একটি ছড়া কাটতে কাটতে সামনে এসে দাঁড়ালো আর বলতে লাগলো-“হারাধনের দশটি ছেলে ঘোরে পাড়াময় তার একটি গেলো বাঘের পেটে রইল বাকী নয়”
এই ভাবেই সে বলে গেলো, মনির শুরু করছিল দশটি ছেলেকে দিয়ে আর যখন শেষ করলো তখন একটি ছেলেও নাই। অর্থ্যাৎ সে বোঝাতে চাইছে, আমাদের ক্লাবটি সব সময় ছিল জম জমাট অথচ এক একজন আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে “ভরা হাট ভেঙে পড়ছে”।
মন খারাপ হয়ে যাওয়াতে না ক্যারাম না লুডু না ব্যাগাডোলি অথবা তাস কোনটাই আর জমলো না। মাস না ঘুরতেই আর একটি খবরে ক্লাবের বাকী সবাই ভেঙে পড়ল, কারণ ক্লাবের মধ্যমনি আজাদ এবার সবাইকে রেখে আকাশ পথে উড়াল দিয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় আজাদ প্রবেশ করেই হাসতে হাসতে তার খুশীর খবরটি দিলো যদিও আমরা যে আগেই জেনেছি তা আর না বলে জানতে চাইলাম কি ভাবে সাত সাগর পাড়ি দেবার ব্যাবস্থা করলি? সে একগাল হেসে বল্লো, আমাদের বাড়ীর উপর তলার মাহমুদ ভাই তার এক বন্ধুকে দিয়ে ভিসার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। আমরা আর জানতে চাইলাম না এ জন্য কত টাকা তাকে গচ্চা দিতে হয়েছে। রহিম আজাদকে একটা ধাঁধা দিয়ে বল্লো, যাবার আগে এটার উত্তর দিয়ে যা? সবাই অমরা জিজ্ঞাস্য দৃস্টিতে তাকালাম। এবার রহিম আসমানের দিকে চেয়ে বল্লো, আকাশে যখন “রামধনু” উঠে তখন কয়টা রং থাকে?
হাসতে হাসতে আজাদ উত্তর দিলো এ তো খুব সোজা উত্তর, তুমি শুধু এই লাইন মনে রাখলেই চলবে। সেটা হলো এই “বেনীআসহকলা” তার মানে দাঁড়ালো, বেনী অর্থাৎ – বেগুনি নীল। আসাহ মানে হলো- আসমানী, সাদা, হলুদ।
কলা মানে হলো— কমলা ও লাল। মোট ৭ টা রং নিয়েই হলো “রামধনু”।