
দ্বিতীয় দফা আমাদের গ্রামে পাক বাহিনীর হানাঃ
বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ হবে তারিখটা সঠিক মনে নেই, ওই দিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে, বৈশাখ-জৈষ্ট মাসে প্রচুর বৃষ্টি নামলে সাথে বর্জপাত হলে উজাই উঠে। উজাই উঠে মানে খাল-বিল ও নদী থেকে মাছ ডাঙ্গায় উঠে আসে। আমাদের এলাকায় এটিকে বলা হয় উজাই। আমি এবং আমাদের গ্রামের ঈকবাল আমার বাল্যবন্ধু উজাই মাছ ধরতে গেছি গ্রামের উত্তর দিকে নন্দগুরি বিলে তরিকুচা নিয়ে মাছ শিকারে। আমরা মাছ শিকারের নেশায় মত্ত, আমরা কুচা দিয়ে বেশ মাগুর মাছও ধরেছি। হঠাৎ গ্রামের দিকে চেয়ে দেখি মানুষজন দৌড়াচ্ছে, পূর্ব দিকে থাকাতেই দেখলাম তিনজন পাকিস্তানী সেনা শ্রীধরপুর থেকে বের হয়ে পশ্চিম দিকে জমির আল দিয়ে হেটে পুরাদিয়া গ্রামে ঢুকছে। ভয়ে আমরা কুকরার ভেতর পানিতে শুয়ে পড়লাম। জুকে খেয়ে আমাদের সব রক্ত চুয়ে ফেলেছে। এরা গ্রামে ঢুকতেই আমারা উঠে পুর্ব দিকে দৌড়ালাম। আমাদের বাড়ী আমরা বর্তমানে যে বাড়ীতে আছি ওই বাড়ীতে থাকতেন বোন দিদি, মানে বাবু নবীনচন্দ্র দেবের কন্যা পুষ্পরাণী ধর, সবাই গ্রাম ছেড়ে গেলেও তিনি যাননি। পাকিস্তানীরা বাড়িতে প্রবেশ করতেই তিনি আশ্রয় নিলেন ঝোপের ভেতর, এবাড়ী খালি দেখে এরা সোজা চলে যায় দক্ষিনের বাড়ী মোর্তজা আহমদ চৌধুরীর বাড়ীতে, সেখানে এই পাক সেনারা তাদের বাড়ী লুট করে, মোর্তজা আহমদ চৌধুরী ও তার ভাই মখলিছুর রহমান চৌধুরীকে বেদম প্রহার করে। তখন ঘরে লুকিয়ে ছিলেন তাদের স্ত্রীরা, মেয়ে লোক দেখে এদের কাছে যাইতে চাইলে ওই দুই মহিলা ( মর্তুজা আহমদ চৌধুরীর ও মখলিছুর রহমান চৌধুরীর স্ত্রী) দৌড়ে এর দক্ষিনের বাড়ী সমসির আহমদ চৌধুরীর ঘরে আশ্রয় নেন। সমসির আহমদ এই দুই মহিলাকে ধানের উগারে লুকিয়ে কুলা দিয়ে আড়াল করে রাখেন। অসভ্য পাকিস্তানীরা পিছু নেয় মহিলাদের সমসির চৌধুরীর ঘর তল্লাসি করে এদের নাপেয়ে সোজা চলে যায় পশ্চিমের বাড়ীতে। ওই বাড়ীতে তখন ২০/২৫ জন পুরুষ আর সাত আটজন মহিলা। একজন সিপাহি সকল পুরুষদের লাইনে দাড় করিয়ে রাখে বাকী দুজন ঘরে প্রবেশ করে মেয়েদের ধর্ষণ করে। মান সম্মানের ভয়ে কেউ আর তা প্রকাশ করেননি। ওই বাড়ীতে মা-মেয়েকে একসাথে ধর্ষণ করেছে পাক সৈন্যরা। এই বাড়ীতে এখন আর মানুষ নেই বাড়ীটি পরিত্যক্ত বাড়ীর মানুষ অন্য বাড়ী চলে গেছে। এর পর পাক সৈন্যরা প্রবেশ করে ওই বাড়ীর পশ্চিমের বাড়িতে। এবাড়িতে তারা মৌলানা খালিদ হোসেনের ঘর লুট করে। ওই বাড়েী থেকে বের হয়ে উত্তর দিকে দৌলতপুরের দিকে যাত্রা করে।
এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয়, ওসমানীনগরের সাদিপুরের সরফ উদ্দিন চৌধুরীর ভাগিনা তারাও পাক বাহিনীর ভয়ে গ্রাম ছেড়ে মামার বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিল, বাড়ির পাশ থেকে সরফ উদ্দিন চৌধুরীর ভাগিনা মসুদকে ধরে নিয়ে যায়। তখন খেজুয়ার খালে হাটু পানি, পাক সেনারা তার পিঠে চরে খাল পাড় হয়। দৌলতপুর গিয়ে মসুদের হাতে বারআনা পয়সা দিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেয়। তখন সকলেই মনে করছেন মসুদকে মেরে ফেলবে। আল্লার কৃপায় তাঁকে মারেনি ছেড়ে দেয়। সে ফিরে এসে বর্ননা দিচ্ছিল কিভাবে পাক হানাদাররা তার পিঠে করে খাল পার হয়েছিল।
তৃতীয় দফা আমাদের গ্রামে পাক বাহিনীর হানাঃ
এই ঘটনার ঠিক দুদিন পর আবার পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের গ্রামে আসে। ওই দিন ছিল সোমবার তারিখটা মনে নেই। শেরপুর ক্যাম্প থেকে বের হয়ে তিন জন সিপাহী প্রবেশ করে বনকাদিরপুর গ্রামে। গ্রামের মানুষজন ভয়ে পালিয়ে যায়। ওই সময় বনকাদিপুরেরর লেবু মিয়া মেম্বারের বাড়ীত থাকত নোয়াখালির কবির, পাকিস্তানী সৈন্যরা কবিরকে ধরে নিয়ে আসল। কয়েকটি বাড়ীতে লুটপাটকরে। বনকাদিপুর প্রবেশের পূর্বে ওই পাকসেনারা প্রথমে হোসেনপুর গ্রামে হানা দেয়। নদীপার করে দেওয়ার জন্যে ধরে আনে হোসেন পুরের আরমান হাজীকে। আরমান হাজি একটি ছোট নৌকায় এদের শেরখাই নদী পার করে দেন। তখন শ্রীধরপুরের আব্দুল জব্বার ভাই মাঠে কাজ করছিলেন তাকে দেখে কাছে আসতে বললে তিনি আসলে তাকে চড় থাপ্পর মারে। তার কাছে ছিল ক্যারসিনের মেস লাইট আর বিড়ি। সৈন্যরা তার লাইট এবং বিড়ি কেড়ে নেয়। তাকে চড় থাপ্পর দিয়ে ছেড়ে দিলে তিনি আরমান হাজিকে অনুরোধ করেন বলে দেখুন আমার লাইটা ফেরত দেবে কি। আরমান হাজি বললেন এই বেটা বোকা আমাদের প্রাণে মারে নাই এটাই আল্লার রহমত। আবার লাইট ফেরত চাইছ। জান নিয়ে পালা আমি ও পালাই। আমি পাঞ্জাবী আসছে শুনে দিলাম দৌড়, বাড়ীর সকলকে ফেলে ছফির আর আমি আশ্রয় নিলাম কামারগাঁয়ে আমাদের মামার বাড়ীতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকজন জড় হয়েছেন নদীর দক্ষিন পাড়ে। কার বাড়িতে পাঞ্জাবী প্রবেশ করেছে জানতে। এর মধ্যে বাড়ী গাউয়ের আব্দুর রাজ্জাক, কামারগাঁয়ের ফিরোজ মিয়া আরো কয়েকজন বললেন চল সামনে নূরগাঁও এর দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি কার বাড়ীতে প্রবেশ করেছে। তখন কেউ কেউ বললেন যদি আমাদের উপর গুলি করে। তখন বাড়িগাউয়ের আব্দুর রাজ্জাক বললেন আমরা বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে দেখব। কয়েকজন আসতে চাইলে উঠলেন বাশের হাখমে (সাকুতে) তখনই সাকু ভেঙ্গে সকলে নদীতে পড়ে গেলেন। বাধা পরল তখন পুর্ব দিক থেকে একজন এসে জানাল পাঞ্জাবীরা চলে গেছে।
জ্ঞান হারায় একব্যাক্তি আমাদের গ্রামেঃ
দিনটি ছিল শনিবার সময় ১২টা হবে তারিখটা সঠিক মনে নেই, তবে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিকে। একদিন এক মধ্য বয়সী একব্যক্তি দৌড়ে চিৎকার করে এসে আমাদের উত্তরের বাড়ীর সামনে এসে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে গেল। সবাই ধরাধরি করে তাঁকে বসালেন কেউ দিলেন মাথায় পানি। শেষে জানা গেল এই ব্যক্তির নাম সমাই উল্লাহ বাড়ী ওসমানী নগরের গজিয়া গ্রামে। তিনি জানালেন তার বাড়ী গজিয়া গ্রামে। তিনি ভয়ে গ্রাম থেকে বের হয়ে তাজপুরের দিকে ছোট নৌকায় কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে পাহাড়পুর গ্রামে ঢুকছিলেন। তখন ওই গ্রামে পাঞ্জাবীরা মহিলাদের ধর্ষণ করছিল সংখ্যায় ৪/৫জন। তাঁকে পাঞ্জাবীরা দেখে ফেলে তখন ভয়ে তিনি দেন দৌড়, তিনি মনে করছিলেন তাঁকে গুলি হত্যা করবে। পেছন দিক থেকে পাঞ্জাবীরা তাকে টের…. টের….. বলে থামতে চাইলে তিনি দৌড়াতে থাকেন, পাহাড়পুর থেকে মাইল দুয়েক দৌড়ে আমাদের গ্রামে এসে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। তাঁর জ্ঞান ফিরেলে সকলে জিজ্ঞেশ করলেন কি হয়েছে। তিনি বলনে জানিনা, আমাকে শে..রে শে..র বলেছে, তাই দৌড়ে এসেছি। তখন আমাদের উত্তরের বাড়ির তোয়াহিদ মিয়া বললেন শের… নয় তুমাকে টের বলেছে মানে থামতে বলেছে।
আহমদপুর বাজারে হামলা আলফু মিয়াকে গুলিঃ
এভাবে প্রতিদিনই বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা নারী ধর্ষণ ও লুট পাটের জন্যে প্রতিদিন শেরপেুরের আশপাশের গ্রমগুলোতে হানা দিত। এই ঘটনার মাত্র কয়েক দিন পর চারজন পাকসেনা শেরপুর ক্যাম্প থেকে বের হয়ে পাককুল পাহাড়পুর কুমারখাদা গ্রামে লুটপাট ও কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে প্রবেশ করে আহমদপুর বাজারে। এই আহমদপুর বাজারটির অস্থিত্ব এখন নেই। নদীভাঙ্গনে বিলিন হয়ে গেছে। এমনকি পঞ্চাশ বছরে মানচিত্রও বদলে গেছে দেখলে চেনার কোন উপায় নেই। এই আহমদপুর বাজারে ব্যবসা করতেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য দুর্গাপুর গ্রামের আলফু মিয়া। বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেলে আলফুমিয়া দোকান থেকে বেরিয়ে অসলে পাক সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তিনি প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনা সদস্য। কৌশলে ঝাপদেন কুশিয়ারা নদীতে। তিনি যখন নদীতে ঝাপ দেন তখন সৈন্যরা তার উপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছড়ে। তিনি ডুবদিয়ে নদী সাতেরে নদীর উত্তর পারে ওসমানীনগরের সাদিপুর ইউনিয়নের (ফরিকোনা) সুরিকোনা গ্রামে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানীরা মনে করছিল তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নদীর উত্তর পারে আশ্রয় নিয়েছেন।
সুরিকোনার গণহত্যাঃ
এর পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তানী সৈন্যরা সুরিকোনা গ্রামে ঘেরাও করে ঘুম থেকে তুলে এনে এই গ্রামের প্রায় দুইশতাধিক লোককে নদীর পারে এনে দাড় করিয়ে হত্যা করে। সকলে এই গ্রামের বাসিন্দা নয় যুদ্ধের কারনে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে সুরিকোনা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন কেউ কেউ। ভোর বেলা আমাদের বাড়ী থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে খবর আসল পাকিস্তানী সৈন্যরা সুরিকোনা গ্রামের সকল মানুষকে মেরে ফেলেছে। কয়েকদিন পর জানা গেল বিস্তারিত। শুধু সুরিকোনা নয় প্রদিদিনই পাকিস্তানীরা দেশব্যাপী এভাবে গণহত্যা চালিয়েছে। এই বদ্ধ ভূমিটিরও এখন আর অস্তিত্ব নেই, নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।
শ্রীরামসীর গণহত্যাঃ
শ্রীরামসী জগন্নাথপুর উপজেলার মীরপুর ইউনিয়নের প্রবাসী অধ্যুসিত একটি গ্রাম। ১৯৭১ সালের শ্রীরামসী গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরনীয় ঘটনা। যোগাযোগ বিচ্ছিহ্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়াতে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এই গ্রামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আশ্রয় নিয়েছিলেন শত শত মানুষ। এসব মানুষের থাকা খাওয়ার সুবিদার্থে এলাকাবাসী শ্রীরামসী হাইস্কুল সহ গ্রামের বিভিন্ন বাড়ীতে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আমিও ছিলাম এই শ্রীরামসী হাইস্কুলের ছাত্র। ১৯৭১ সালে স্কুলে ক্লাস হতো না, কেননা স্কুলে আশ্রয় দেয়া হয়েছে মানুষদের। এছাড়া এই স্কুলের দুজন শিক্ষক ও একজন ছাত্র সহ এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এসব কারণে রাজাকার স্বাধীনতা বিরোধীরা শ্রীরামসীর ব্যাপারে খবর দেয় পাকবাহিনীর কাছে। চাঁদ বোয়ালিয়া গ্রামের ময়না মিয়ার বাড়ীতে থাকতো জকিগঞ্জের এক কউমী মোল্লা। সে তার গুরু সিলেট অঞ্চলের প্রতিটি হত্যাকান্ডের নায়ক বালাগঞ্জের গরহর পুরের নূরউদ্দিনকে শ্রীরামসী অভিযানের অনুরোধ জানায়। শ্রীরামসিীতে যে অভিযান হবে অনেকেই আগে থেকে জানতে পারছিলেন। তখন আমার ভগ্নিপতি কমর উদ্দিন ও তাদের পরিবারে লন্ডন প্রবাসী সকলেই দেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন। এই ঘটনার ৬/৭ দিন আগে দুলাভাই আমাদের বাড়ীতে চলে আসেন, উনার বড় ভাই সামসুর রহমান আশ্রয় নেন তার শ্বশুরবাড়ী ওসমানীনগরের হলিমপুরে, তাদের ছোট ভাই আব্দুস সামাদ তিনি তার স্ত্রীসন্তানদের শ্বশুর বাড়ী চান্দভরাং পাঠিয়ে বাড়িতে থেকে যান। নূরুদ্দিনের গহরপুর মাদ্রসার সকল ছাত্রই তাদের ওস্তাদ নূরুদ্দিনের নির্দেশে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। ঘটনার কয়েকদিন আগ থেকেই গহরপুর মাদ্রসার রাজাকাররা নৌকা করে জগন্নাথপুরে আসে। শ্রীরামসী গণহত্যার মূল নায়কেরা হলো গহরপুরের নূরুদ্দিন, হবিবপুরের আহমদ, সৈয়দপুরে হাফিজ এবং খাদিমপুরের এক রাজাকার। ঘটনার দিন সকাল থেকে পাকিস্তানী সৈন্য এবং কয়েতশত দেশীয় রাজাকার নূরুদ্দিনের নেতৃত্বে শ্রীরামসী এসে অবস্থান নেন স্কুলে, হেড মাষ্টার সাদ উদ্দিন স্যারকে ডেকে নিয়ে বলে আমি শান্তিকমিটি করতে পাকবাহিনী নিয়ে এসেছি আপনি গ্রামের লোকদের ডেকে নিয়ে আসুন। এ-ও জানিয়ে দেয় কেউ না আসলে খারাপ হবে সবাইকে নির্ভয়ে আসতে বলুন। বর্ষামাস নৌকা ছাড়া কোন উপায় নেই একে একে গ্রামের মানুষ আসতে থাকেন। তখন অনেকেই কুচা নিয়ে মাছ শিকারে ছিলেন তাদেরও রাজাকারা ধরে নিয়ে আসে। একটা কথা অছে রাখে আল্লাহ মারে কে। বাজারের ব্যবসায়ী এবং গ্রাম থেকে লোকজন আসলে সকলকে স্কুলের একটি কক্ষে নিয়ে যায় রাজাকাররা। তখন নূর উদ্দিন বলে যাদের বন্ধুক আছে তাদের বন্দুক জমা দিতে হবে। আমার তালই হাজী আব্দুল ওয়াহাব বন্দুক নিয়ে গেলেন সেখানে। তখন আমার তালই সহ বয়স্ক চারজান লোককে অন্যত্র একটি রুমে নিয়ে আটকে রাখে। যদি আরো ঘণ্টাখানেক পরে আক্রমন করতো আরো কয়েকশ মানুষকে হত্যা করতো। সবে মাত্র লোকজন জড়ো হতে শুরু করেছেন। রাজাকাররা ক্রমান্বয়ে সকলকে নিয়ে যায় বাজারের পার্শবর্তি রইছ উল্লার বাড়ির পুকুর পারে। সেখানে নিয়ে সকলকে লাইনে দাড় করিয়ে গুলি চালায়। ইতিমধ্য আমার তালতো ভাই আব্দুস সামাদ সাহেবে যেতে শুরু করছেন গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে বাড়ীতে আসেন। তিনি মাঠ সাতরে আশ্রয় নেন তার শ্বশুর বাড়ী চান্দভরাং গ্রামে। বাড়ীতে আটকা পড়েছেন আমার মাওই মা, তিনি এবং গ্রামের কয়েকজন মেয়ে মানুষ ছোট একটি নৌকায় করে নিজেরা নৌকা বেয়ে আশ্রয় নেয় চান্দভরাং গ্রামে। শ্রীরামসী থেকে চান্দভরাং দূরত্ব মাইলের চেয়ে কম, মাঠে কাতারি ধান (আমন ধান) ধানের উপর নৌকা করে তারা চান্দ ভরাং পৌছান। তখন তিনবার তাদের নৌকা ডুবে যায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ এলাকার প্রায় দুইশতাধিক লোককে হত্যা করে রাজাকার ও পাকিস্তানীরা। হত্যার পর বাজার এবং গ্রামে চালায় লুটপাট। এর পর গ্রামের প্রতিটি বড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান গদাভাট গ্রামের জোয়াহির চৌধুরী (জফির ভাইসাব) চান্দবোয়ালিয়া গ্রামের আলকাছ মামা ও কুমিল্লার কালা ডাক্তার। আলকাছ মামার হাতে গুলি লেগেছিল। আমি পরে এই তিনজন সহ জীবিতদের মুখ থেকে বিস্তারিত শুনেছি পরবর্তিতে বাংলাপোষ্ট পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখেছি। পরদিন আকাশবানি কলিকাতা রেডিও থেকে এই গণহত্যার খবর প্রচার করা হয়। এদিকে দুলাভাই পাগলপ্রায় তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন বাড়ী যেতে। ঘটনার দুইদিন পর দুলাভাইকে নিয়ে একটি নৌকা করে আমরা যাই শ্রীরামসীতে তখনও দেখছি লাশ গুলো পানিতে ভাসছে। আমাদের নৌকা দেখে রাজাকারদের একটি নৌকা এসে হাজির রাজাকারের নৌকার ছইয়ের উপরে বসা নূর উদ্দিন। আমাদের বলল কেউ এখান থেকে লাশ নিতে পারবেনা। আমরা ফিরে আসলাম। শ্রীরামসীর হত্যাকান্ড সংগঠিত হয় ৩১ আগষ্ট। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিন স্যার, শেরপুরের মৌলানা স্যারসহ, তহলিদার, বাজারের ব্যবসায়ী ও গ্রামবাসী মিলিয়ে দেড়শতাধিক লোককে হত্যা করে পাকিস্তানীরা। এই হত্যাকান্ডের শিকার আমার আরেক তালত ভাই আব্দুল্লা পুরের কবির মিয়া, তিনি যখন মারা যান তার একমাত্র সন্তান পারভেজ মাত্র ছয়মাস বয়সের। পারভেজ এখন লন্ডনে আছে। রাজাকার নূরুদ্দিনের বাধার মুখে আমরা ফিরে আসলাম, আমাদের লাশ আনতে দেয়নি ।
রাণীগঞ্জের গণহত্যা ও ইসলাম উদ্দিনের ফিরে আসাঃ
শ্রীরামসীর গণহত্যার ঠিক একদিন পর ১লা সেপ্টেম্বর জগন্নাথপুরের রাণীগঞ্জে চালানো হয় হত্যাযগ্য। ১৯৭১ সালে রাণীগঞ্জবাজারে আমাদের গ্রামের ইসলাম উদ্দিন চৌধুরী কাজ করতেন তার চাচা মহিউদ্দিন চৌধুরীর দোকানে। দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। রাণীগঞ্জ বাজারে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত যতায়াত ছিল। বাজারের ব্যবসায়ীরা মুক্তিবাহিনীকে সহযোগীতা করতেন। বিষয়টি স্থানীয় দালালরা পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেয়। পাকিস্তানীরা রাণীগঞ্জ বাজারে অপারেশন চালনোর প্রস্তুতি নেয়। ইসলাম উদ্দিন চৌধুরীর ভাস্যমতে ১৯৭১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বুধবার সময় সকাল সাড়ে দশটা। একটি লঞ্চে করে ৩০/৩৫ জনের পাকসেনাদের একটি দল রাণীগঞ্জ বাজোরে এসে নোঙ্গর করে। অন্যদিকে কয়েকটি ছোট নৌকায় জগন্নাথপুর থেকে রাজাকারদের একটি দল এসে পৌঁছায় রানীগঞ্জে। যেসব রাজাকার রানীগঞ্জ বাজারে গণহত্যায় অংশ নেন এর বেশীর ভাগই ছিল গহরপুর মাদ্রাসার বাকীরা স্থানীয়। এই রাজাকারেরা শ্রীমামসী গণহত্যায়ও অংশ নেয়।
পাকিস্তানী সৈন্যরা দোকানে দোকানে গিয়ে বাজারের ব্যবসায়ীদেরে এনে একত্রিত করে সবার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে বাজারের পাশে একটি খালের পাড়ে নিয়ে যায়। এসময় পাক সেনারা কয়েক জন রাজাকারকে পাহারায় রেখে পাকিস্তানীরা আরো ব্যবসায়ীদের আনতে যায়। তখন ইসলাম উদ্দিন চৌধুরী তার চাচা মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হাত বেঁধে এক লাইনে দাড় করিয়ে রাখে। ঠিক পাশের লাইনে একই ভাবে আমাদের গ্রামের মকবুল হোসেন, ফরিদ মিয়া ও তার পুত্র তফজ্জুল মিয়াকে হাত বেঁধে দাড় করিয়ে রাখে। তখন ইসলাম উদ্দিন চেষ্টা করে বাধন খুলে ফেলেন এবং চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলেন আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে আমাদেরও মেরে ফেলবে। একথা বলেই খালের পানিতে ঝাপ দেন, ইসলাম উদ্দিনের ভাষ্য মতে তাঁর ঝাঁপ দেয়াকে দেখে ফেলে একজন রাজাকার ঐ রাজাকারটি তাঁকে পলাতে সাহায্য করে রাজাকারটি নাকি তাঁকে বলেছিল পানিতে ডুব দিয়ে চলে যাও। এভাবে ইসলাম উদ্দিন পানি সাঁতরে ৮/১০ মাইল গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিয়ে রাতে বাড়ী পৌঁছান। ইসলাম উদ্দিনের কাছ থেকে জানা যায় যে পাকিস্তানী সৈন্যটি সবার উপর গুলি চালিয়েছিল, সে নাকি অন্যদের থেকে দূরে একটি গাছের নীচে বসে তার কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। ইসলাম উদ্দিন তখন সাতার কেটে মাইল খানেক চলে এসেছেন পাক কমান্ডারের বাঁশির হুইসেলের সাথে সাথেই গাছের নীচে বসা সৈন্যটি হাতে থাকা রাইফেলদিয়ে লাইনে দাড় করানো লোকদের উপর গুলি চালায়। রাণীগঞ্জের এই গণহত্যায় শহীদ হন আমাদের পশ্চিমের বাড়ীর মকবুল হোসেন, ইসলাম উদ্দিনের চাচা মহিউদ্দিন চৌধুরীর গুলি লাগে ডান হাতে তিনিও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমাদের উত্তরের বাড়ীর বর্তমানে রাণীগঞ্জের গন্দব পুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়ার গায়ে গুলি লাগে নি তিনি মৃতের ভান করে মাটিতে পড়ে থাকেন, তার পুত্র তফজ্জুল মিয়ার ডান পায়ে গুলি লাগে। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাজারের ব্যবসায়ীদের হত্যা করার পর দোকান পাঠ লুট করে এর পর বাজারে আগুণ ধরিয়ে দেয়। হানাদাররা চলে যাবার পর নারিকেল তলা থেকে নৌকা নিয়ে রাণীগঞ্জ বাজারের আসেন রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (অবঃ) সুবেদার বশির উদ্দিন। তিনি আহতদের উদ্ধার করে তার বাড়ীতে নিয়ে যান। পরদিন আত্মীয় স্বজনরা আহত মহিউদ্দিন চৌধুরী, ফরিদ মিয়া, তফজ্জুল মিয়া এবং মকবুল হোসেনেরে লাশ নিয়ে আসেন বাড়ীতে। এখানে আরেকটি কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি ১৯৭১ সালের নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় প্রতিদিনই অসভ্য পাকিস্তানী সৈন্যরা কোন না কোন জনপদে হামলা চালিয়েছে হত্যা করেছে অসংখ্য মানুষ, গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। দিনটি ছিল রোদ্রজ্জ্বল আমাদের উত্তরের বাড়ীর তোয়াহিদ মিয়া দুপুরের দিকে আমাদের গ্রামের সকলকে ডেকে বলেন ওই দেখুন উত্তর দিকে প্রচুর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, মনে হয় পাকিস্তানীরা কোন এলাকায় আগুন দিয়েছে। আমাদের বাড়ী থেকে রাণীগঞ্জ কয়েক মাইল দূরে হলেও দিনটি পরিস্কার থাকায় আগুনের ধোয়া দেখা যাচ্ছিল পরিস্কার ভাবে। তার কথা প্রমান পাওয়া গেলে রাতে ইসলাম উদ্দিন ফিরে আসাতে। মহিউদ্দিন চৌধুরী ও অন্যান্য গুলিবিদ্ধরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত নিয়ে বেঁচেছিলেন। আহত তফজ্জুল মিয়ার ভাষ্য মতে মকবুল হোসেনের বাঁধন খুলে গিয়েছিল তিনি নাকি তাঁকে বলে ছিলেন ভাই সাহেব দেখুন পালাতে পারেন কি না। তখন মকবুল হোসেন তাঁকে বলেছিলেন চেষ্টা করলেও আর পালানো যাবেনা…..আল্লাহ দেখবেন। আমি শহীদ মকবুল হোসেনের মৃতদেহ দেখেছি উনার নাভীর নীচ দিয়ে গুলি ঢুকেছিল ছোট্র হয়ে ঢুকেছে আর বের হয়েছে বুকের ডান পাশ দিয়ে বড় হয়ে। উনার লাশের মুখ এবং গুলির ক্ষতস্থানটি আজও আমার চোঁখের সামনে ভেসে উঠে। ১৯৮০ সালে ইসলাম উদ্দিনের সাক্ষাৎ করার সুযোগ করে দিয়েছিলাম আমার বন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক তাজুল মোহাম্মদের সাথে তাজুল মোহাম্মদ তার তার কাছ থেকে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেছেন। রাণিগঞ্জ এবং শ্রীরামসীতে গণহত্যায় অংশ নেয় গহরপুর মাদ্রসার শতাধিক রাজাকার, রাণীগঞ্জে এবং শ্রীরামসীতে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে কয়েকদিন আগ থেকেই গহরপুরের রাজাকাররা জগন্নাথপুরে অবস্থান নেয় উভয় হত্যাকান্ডে এরা সক্রিয় অংশ নেয়। স্থানীয় দালালারা আগ থেকে এর পরিকল্পনা করে রেখেছিল।
নবীগঞ্জের গণহত্যাঃ
আগষ্ট মাসের শেষ দিকে বা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে হবে চালানো হয় নবীগঞ্জ বাজারে গণহত্যা তারিখটা আমার সঠিক মনে নেই তবে শ্রাবনীপূজার আগের দিন। এই হত্যাকান্ডের নায়ক হলো রাইয়াপুরের ইসমাইল মৌলানা আব্দুর রহমান সহ আরো কয়েকজন। এই ইসমাইল মৌলানা ৭০ এর নির্বাচনে নবীঞ্জ থেকে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জামাতে ইসলামের প্রার্থী ছিল। তার প্রতিক ছিল দাড়িপাল্লা সে নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিল। তার নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই এই হত্যাযগ্য। এই ইসমাইল মৌলনার আরেকটি পরিচয় আছে, সে লন্ডনের দাওয়াতুল ইসলাম নেতা কেএম আবু তাহের সিংকাপনী পরবর্তিতে নাম বদল করে কেএম আবু তাহের চৌধুরীর ভগ্নিপতি। এই ইসমাইল মৌলানা হবিগঞ্জ থেকে পাকবাহিনীকে নৌকায় করে নিয়ে আসে নবীগঞ্জে। ওই দিন ছিল হাঠবার সকল ব্যস্ত ইসমাইল মৌলানা নৌকার ছইরে উপর বসা মাঝিদের তাগদা দিচ্ছে জোরে দার টানতে। নৌকার ভেতর পাকিস্তানী সৈন্যরা। পাকিস্তানীরা বাজারে প্রবেশ করে দোকান এবং ঘর থেকে লোকদের ধরে আনে। সকলকে পূরাতন থানা ভবেনের কাছে শাখাবরাক নদীর পাড়ে দার করিয়ে হত্যা করে। এর বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। এসময় নবীগঞ্জ বাজাবে কদুপরের ছত্তার মিয়া দর্জির বাসায় পরিবার পরিজন নিয়ে ভাড়া থাকতো নাসির নগরের আবুদ্যার বাপা, এর আগে এই আবুদ্যিার বাপ আমাদের বাড়ীতে থাকত। ওই রাতেই সে তার পরিবার পরিজনদের আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। তার কাছ থেকে আমরা প্রথমে এই গণহত্যার খবর পাই। নবীগঞ্জে যাদের হত্যা করা হয় অধিকাংশেই হিন্দু, কেননা এই ইসমাইল মৌলানা ছিল হিন্দু বিদ্ধেষী। তার উদ্দেশ্য ছিল এলাকাকে হিন্দু শূন্যকরা।
(চলবে)