একাত্তরের রনাঙ্গনের বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট রাজনীতিক বীরপ্রতিক সৈয়দ আতাউর রহমান আর নেই।
গতকাল ১২ এপ্রিল ২০২৫ সকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ঢাকা ইবনে সিনা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭৯ বছর (ইন্নালিল্লাহ ই ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধুসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। শনিবার স্থানীয় সময় বাদ এশা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর ঈশানকোনা হালিছাড়া মাটে মরহুমের নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে পিতা মাতার কবরের পাশে চীরনিদ্রায় শায়িত করা হয় জাতির এই শ্রেষ্ট্র সন্তানকে।
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলাধীন সৈয়দপুর গ্রামের সন্তান সৈয়দ আতাউর রহমান ষাটের দশকে ছাত্রলীগে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেন। এই দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আদর্শ ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী হিসেবে রাজনীতির মাঠে কর্মরত ছিলেন তিনি। অত্যন্ত অমায়িক ও বন্ধুবৎসল সৈয়দ আতাউর রহমান সৈয়দ আতাউর নামেই বন্ধু মহলে পরিচিত ছিলেন।
সিলেটের এম সি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে প্রথম ছাত্রলীগ গঠন করলে সৈয়দ আতাউর এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কমিটির সভাপতি ছিলেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান। অতঃপর জেলা পর্যায় পেরিয়ে সৈয়দ আতাউর যাথাক্রমে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। জনাব সৈয়দ আতাউরের মৃত্যুতে তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও এলাকাবাসীকে সকলের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তরুন বয়সে দেশমাতৃকার জন্য অস্ত্র হাতেঝাপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর আবারও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ছিলেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান।
তাৎক্ষনিক ভাবে তার মুত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে আত্মীয় স্বজন ও শুভাকাঙ্খিদের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া।
তাঁর মৃত্যুতে শোক এক বার্তায় কবি গবেষক ও আশারকান্দি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান দীনুল ইসলাম বাবুল ফেসবুকে লিখেছেন ১৯৬৮ সনে যাঁদের সাথে ছয়দফা থেকে ৬৯এর গণআন্দোলন করেছিলাম তাঁদেরই একজন এমসী কলেজ ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ আতাউর রহমানের ইন্তেকালে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েন লন্ডনের সভাপতি বিশিষ্ট রাজনীতিক জগন্নাথপুরের কৃতিসন্তান হরমুজ আলী তাঁর ফেসবুক আইডিতে সৈয়দ আতাউর রহমানের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে লিখেছেন। ১৯৭২ সাল, বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ আসবেন জগন্নাথপুরে, জনসভা হবে, চারিদিকে প্রস্তুতির টানটান উত্তেজনা। আমাদের জন্য বাড়তি উত্তেজনার আরেক কারণ হলো সেই জনসভায় যে মানপত্র পাঠ করা হবে তা লেখার দায়িত্ব পড়েছে আমাদের বাংলার শিক্ষক শ্রী জগদীশ চন্দ্র দাসের উপর, তিনি-ই সম্ভবত তখনকার দিনে আমাদের অঞ্চলে সব থেকে ভালো বাংলা জানা ব্যক্তি; কিংবা এমনও হতে পারে, সেই জনসভার উদ্যোক্তাদের অন্যতম মীরপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ডেপুটি হেডমাস্টার সালাম স্যার (আব্দুস সালাম বি,কম যিনি আমাদের অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক), তিনি হয়তো নিজে থেকে এই দায়িত্ব নিয়েও আসতে পারেন। সে যাক, সে সময়টাতে নলজুর গাঙের পুব পাড়ে স্বরূপ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় আর দু’একটা সরকারি বিল্ডিং ছাড়া কিছুই ছিলোনা; অর্থাৎ, এই পুরো হাওর জুড়েই ছিলো জনসভার মাঠ। আমার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে জনসভায় উপস্থিত সেদিনের সেই জনসমুদ্রের ঢেউ। আজকের প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাস করবেনা কিন্তু সেই সময়টাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরই এখনকার মতো পোশাক-আশাকের তেমন বাহুল্য ছিলোনা, তাই এ’ধরণের একটা সমাবেশে (জগন্নাথপুরের ইতিহাসে প্রথম, তার নিজের সন্তান দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জনসভা) যোগদানের উপযুক্ত কাপড়চোপড় যোগাড় করাও ছিলো আরেক ঝামেলা! এখানে মনে রাখা জরুরি যে পুরো উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো মানুষ আসছেন, সকলের পরনেই তার নিজের কিংবা ধার করা শ্রেষ্ঠ পোশাকটি, রঙের মধ্যে সাদা’র প্রাবল্য থাকায় আমার কিশোর-মনে এটাকে হাওরভর্তি মানুষের ঈদের জামাতের মতো মনে হচ্ছিলো। যথাসময়ে হেলিকপ্টারটি এলো, জীবনে প্রথম কাছে থেকে হেলিকপ্টার দেখা, উত্তেজনার সীমাপরিসীমা নেই। হেলিকপ্টার থেকে নেমে নেতা সস্ত্রীক মঞ্চে এলেন, সাথে তাঁর দুই ছেলে। মঞ্চ কাঁপিয়ে লাল-টকটকা কিছুটা খাটো মতো এক যুবক মুখে ফেনা তুলছেন সামাদ সাহেবকে বিভিন্ন অভিধায় অভিষিক্ত করে, মাথায় ঝাকড়া চুল, চোখে তাঁর পুরো চশমা। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতেও আমার চোখ বারবার তাঁর দিকেই ফিরে যাচ্ছিলো। চিনিনা, কাছাকাছি যাদেরকে জিজ্ঞেস করি তারাও চিনেনা, সভার শেষের দিকে জানতে পারলাম – তাঁর নাম সৈয়দ আতাউর।
পরিণত বয়সে আতাউর ভাই’র সাথে যখনই দেখা হয়েছে, আলাপ একটাই – রাজনীতি। ‘আতাউর ভাইদের’ কথা যখনই মনে হবে তখনই চোখের কোণ ঝাপসা হবে, কারণ এঁরা সেই প্রজন্মের সোনার ছেলে যাঁরা স্বাধীকার আর স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে স্বাধীনতায় নিয়ে গেছেন কোনো ধরনের স্বীকৃতির আকুতি ছাড়াই, অনেকটা liability ‘র মতো দলের নেতৃত্বের ঘাড়ে যেনো চেপে বসেছিলেন; তাঁদেরকে ফেলাও যাচ্ছেনা আবার তাঁরা ছেড়েও যাচ্ছেননা! কথাগুলো harsh শোনালেও সত্যি কিন্তু। যখনই দেখা হতো – রাজনীতি-ই তাঁর আলোচনার বিষয় বস্তু, কখনো বিষন্ন, কখনো ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন প্রচলিত রাজনীতির উপর। অনেক সময় ‘সময়’ দিতাম, আবার দিতামও না। কারণ, আতাউর ভাইদের তো আর আমাদেরকে দেবার কিছু নাই – যেখানে পাওয়া যাবে সেই ঠিকানার সন্ধানে আমাদের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত! হায়রে রাজনীতি! একটি বারের জন্যও ভাবিনি – এই মানুষগুলো একটি আদর্শে বিশ্বাস করে, স্বজাতিকে রাহুমুক্ত করার প্রতিজ্ঞায় নিজের স্বপ্নীল ভবিষ্যতকে তোয়াক্কা না করে এক-কাপড়ে বেরিয়ে গেছেন, অনিশ্চিত পথে। একসময় তাঁদেরকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে যারা তাদের পিছনে শ্লোগান দেবারও হিম্মত রাখেনি, সেই তারাই তরতরিয়ে উঠে গেছে প্রতিষ্ঠার লাডারের শেষ ধাপে! সুতরাং, তাদের বুকভাঙা আর্তনাদ আমাদের কাছে boring মনে হয়েছে! আপনাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো মুখও নাই আতাউর ভাই! ভালো থাকুন ওপারে, সেখানে নিশ্চয়ই প্রতিষ্টার পিছনে দৌড়ঝাঁপ নেই।
লন্ডন, ১২ এপ্রিল ২০২৫
জগন্নাথপুরের সন্তান শেখ ইয়াওর মিয়া লিখেছেন ” ইন্না-লিল্লাহ অওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন” বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আতাউর রহমান ভাই আর নেই। যুক্তরাজ্য লীডস আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে গভীর শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। উনাদের মতো নেতারা ছিলেন আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের আদর্শের আইডল। তার সাথে শেষ দেখা ২০১৯ সালে। না ফেরার দেশে চলে গেলেন জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী পরিবারের একজন অভিভাবক, আমার মতো অনেকেরই আওয়ামী রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি একজন। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের প্রতিষ্টাতা আহবায়ক, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য। সৈয়দ আতাউর রহমান ভাই। একে একে আমাদের কাছে থেকে চলে যাচ্ছেন আমাদের রাজনৈতিক প্রতিভানরা। যদিও অসংখ্য বার একান্ত সাক্ষাৎ হয়েছে, তবে প্রথম একান্ত সাক্ষাৎ ছিল ১৯৮৮ সালে জননেতা জননেতা জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেবের ঢাকার বাসায়।
অন্যদিকে সৈয়দ আতাউর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন লন্ডনে অবস্থানরত সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এক শোক বার্তায় তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।