২৫শে মার্চ ১৯৭১
ভয়াল কাল-রাত। সমগ্র বাংলাদেশের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী সশস্ত্র হানাদার বাহিনী, সেই রাতে দেশপ্রেমিক বাঙালী পুলিশ, ই পি আর (বি ডি আর) পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা করেছিলো। কিন্ত এই অসম যুদ্ধ কয়েক ঘন্টা মাত্র স্থায়ী হয়েছিল। সেদিন ঢাকাবাসীর (পুলিশ, ছাত্র, জনতা তথা আপামর মানুষ) এই লড়াই সমগ্র জাতিকে বাঙালী জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা দিয়েছিল। জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল। আর এই দীর্ঘ ৯মাসে ছাত্র, কৃষক, কামার, কুমার, কুলি, পুলিশ, ই পি আর ও সেনাবাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ মাতৃকাকে বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণে শহর, বন্দর, গ্রাম যখন জ্বলছে, মানুষকে পাখির মত গুলি করে মারছে তখন দলে দলে মানুষ বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে আবাল বৃদ্ধা বনিতা প্রাণ রক্ষার্থে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। এমতাবস্তায় এপ্রিলের ১০ তারিখে প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার ঘোষণায় সমগ্র বাঙালী জাতি প্রাণ ফিরে পেলো। আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো। বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্ধী করে নিয়ে গেছে, কিন্ত আওয়ামি লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমাদের নির্দেশে বাঙালী পেশাজিবীদের একত্রিত করে যার যার ফ্রন্টে দেশকে মুক্ত করতে অবদান রাখার আহ্বান জানানো হলো।
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) এর ক্রীড়ারাঙ্গনের কিছু ব্যাক্তিত্ব মিলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি গঠণ করে ফেল্লো, যার সভাপতি হয়েছিলেন সংসদ সদস্য শামসুল হক আর সদস্য সচিব ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের নেতা লুৎফর রহমান। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের খেলোয়ারদের অতি শীঘ্রই কলিকাতার থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী দপ্তরে যোগাযোগ করবে।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়ার প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, গোলকিপার নূরন্নবী (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) পিডাব্লুডি ক্লাবের প্যাটেল, আলী ইমাম সদ্য গঠিত ক্রীড়া সমিতির সাথে দেখা করেন। ক্রীড়া সমিতির সভাপতি জানালো বাংলাদেশ সরকার চায় বাংলাদেশ ফুটবল সারা ভারতে প্রদশর্নী ম্যাচ খেলবে যা মিডিয়া মারফত ভারতসহ সমগ্র বিশ্বে প্রচার হবে। সে জন্য তিনি উপস্থিত খেলোয়াডদের কাছে সাহায্য ও সহযোগিতা চাইলেন।
১৯৭১ সালের – ১৪ই জুন বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির প্রথম সভা হলো। এজেন্ডা ছিল ২ টি —
পরিচিতি পর্ব।
ফুটবল টীম গঠন করার ব্যাপারে প্রথামিক আলোচনা।
কিন্ত সেই সভায় খেলোয়াড বলতে একমাত্র প্রতাপ শঙ্কর হাজরা উপস্তিত ছিলেন। প্রায় সবাই ছিল রাজনীতিবিদ। খবর পাওয়া গেলো জাকারিয়া পিন্টু বালুরঘাটের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথামিক রিসেপশন ক্যাম্পের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড কাম ফিজিক্যাল ট্রেইনার।
সে সময় পিন্টু ও প্রতাপ হাজরাকে কার্যকারী কমিটিতে গ্রহণ করা হয় এবং পার্ক সার্কাস-র করণানী স্টিটে দুই রুমের একটি ফ্লাট ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। সেই সাথে ট্রেজারার মহসিন সাহেব ও প্রতাপ হাজরাকে আগরতলায় গিয়ে খেলোয়ার জোগার করতে বলা হলো। কারণ ইতোমধ্যে খবর পাওয়া গেলো ঢাকা লীগের প্রায় ৩০ জন খেলোয়ার সেখানে আছে এবং কেউ কেউ স্থানীয় লীগে খেলছে।
এদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খেলোয়ারদের প্রতি আহ্বানের ঘোষণায় বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্প থেকে বেশ ভালই সাঁড়া পাওয়া গেলো। অল্প দিনের মধ্যে প্রায় ১২ জন খেলোয়ার রিপোর্ট করলো। আর ৭ জন খেলোয়ার করণানী স্টিটের ফ্লাটে গিয়ে উঠলো।
৩০ জুন বিকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ডাকোটা প্লেনে ৩ সদস্য বিশিস্ট একটি দল কলিকাতা থেকে আগরতলার উদ্দ্যশে রওয়ানা দিল। রাত হয়ে যাওয়াতে হোটেলে রাত যাপন করে পরদিন সকালে উমাকান্ত স্কুলের মাঠের কাছে বীরেন্দ্র ক্লাবে তারা পৌছে। সর্বত্র খবর রটে গেছে যে ঢাকা লীগের খেলোয়ারদের সন্ধান করার জন্য পিন্টু ভাই, প্রতাপ দা ও মোহসিন সাহেব এই শহরে এসেছেন। বেশীরভাগ খেলোয়ার বিরেন্দ্র ক্লাবেই খেলতো। সে জন্য প্রথমে সে ক্লাবেই যাওয়া হয়। কিন্ত আগরতলার অন্য অন্য ক্লাব থেকে বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াররা এসে জমা হতে থাকে। সেখানে পাওয়া গেলো ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের আইনুল হক, মোহাম্মাদ কায়কোবাদ, ভিক্টোরিয়া ক্লাবের নওশেরুজ্জামান, এনায়েতুর রহমান, বিমল কর, বি জে প্রেসের (ইপিজে প্রেস) আয়ুব আলী, সুভাষ, নিহার রঞ্জন, তপন দাস, মাহমুদ ওয়ারী ক্লাবের অমল দত্ত, মন্টু দাস, ফায়ার বিগ্রেডের সিতাংশু, রঞ্জিত সাহা সহ ২৭ জন খেলোয়ার পাওয়া গেল। এদিকে সমগ্র ভারতে জয় বাংলার লোকদের সব রকমের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার ও জনগন। ত্রিপুরা ফুটবল এসোসিয়েশন ও আগরতলা ক্লাবগুলো বাংলাদেশের প্লেয়ারদের থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এরা স্থানীয় লীগে বাংলাদেশের সব খেলোয়ারই খেলছে। হঠাৎ করে লীগের মাঝখানে বাংলাদেশের খেলোয়ার নিয়ে গেলে আগরতলার ফুটবল লীগ অসুবিধার সম্মুখীন হবে বিধায় এর সমাধান বের করার জন্য ত্রিপুরা ফুটবল এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী তাপস বাবুর সাথে বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশনের সেক্রেটারী লুৎফর রহমান সাহেব দেখা করেন। সেই সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ফুটবল টীম নিয়ে পরিকল্পনার কথা ও জানাতে ভুললেন না। কিন্ত স্থানীয় ফুটবল টীমের প্রতিনিধিরা জোর আপত্তি জানালো। পরে রাজী হলো যখন শুনলো ৮ জন খেলোয়ার হলেই আপাততঃ চলবে। তবে তারা একটি শর্ত দিলো, খেলোয়ার নিয়ে যাবার আগে একটি প্রদশর্নী ম্যাচ খেলে যেতে হবে।
৪ ঠা জুলাই, ১৯৭১। প্রথম প্রদর্শনী ম্যাচ হলো ত্রিপুরা একাদশ বনাম জয় বাংলা একাদশ। সেদিন যেসব খেলোয়ার জয় বাংলা একাদশে খেলেছিল তারা হলো গোলকিপার – সিতাংশু।
মিডফিল্ডে – বিমল, আইনুল, অমল দত্ত, অধিনায়ক- কায়কোবাদ, নিহার রঞ্জন, প্রতাপ হাজরা।
ফরোয়ার্ড – তপন, এনায়েত, মন্টু দাস, সুভাষ, নওসের ।
ফলাফল হলো ২-১ গোলের ব্যাবধানে ত্রিপুরা একাদশ জয়ী।
আগরতলা থেকে একটি কার্গো প্লেনে কলিকাতায় পৌছে পার্ক সার্কাসের ফ্লাটে যখন প্রতাপ হাজরাদের দলটি এলো তখন তার লক্ষ্য করলো প্রায় ৪৫ জন খেলোয়ার নাম লিখিয়েছে। সেইদিন দুপুরেই ক্রীড়া সমিতির মিটিং হলো। সেই সভায় নতুন দলের নতুন ক্যাপ্টেন করা হলো মোহামেডান ক্লাবের জাকারিয়া পিন্টুকে, আর ভাইস কাপ্টেন হলো ঐ একই দলের প্রতাপ হাজরা। প্রায় ৪৫ জন খেলোয়ার থেকে ২৫ জন খেলোয়ার বাছাই করার জন্য জুলাই মাসের ৭ এবং ৮ তারিখে ট্রায়ালের সিদ্ধান্ত নিলো। পার্ক সার্কাস মাঠে ট্রায়েল হবে। সেই ট্রায়েলে ২৪ জন খেলোয়ার বেছে নেওয়া হলো। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রাথমিক দলে ঠাঁই হলো ২৫ জন খেলোয়ারের। ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারে ফুটবল টীমের খবর শুনে ঢাকা থেকে কাজী সালাউদ্দিন ও সাজাহান এসে টীমে যোগ দেয়।
শেষ পর্যন্ত ৩২ জন খেলোয়ার স্বাধীন বাংলা ফুটবল টীমে তালিকাভুক্ত হলো। নিয়মিত প্র্যাকটিস চলতে থাকে পার্ক সার্কাস মাঠে ও মাঝে মধ্যে টালিগঞ্জের রবীন্দ্র সরোবর মাঠে। ফুটবল রেফারী ননী বসাক ফুটবল টীমে যোগ দিলে তাকে টীমের কোচ করে কমিটির সদস্য করে নেওয়া হলো, সেই সাথে তানভীর মাজহার তান্নাকে টীমের ম্যানেজার করা হলো।
২৪ শে জুলাই- ১৯৭১। নদিয়া জেলা একাদশের সাথে কৃষ্ণণগর স্টেডিয়ামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলার খবর প্রচারিত হলো। সেদিন সেই মাঠে তিল ধরণের স্থান ছিল না। অতীত ইতিহাসেই শুধু নয় বর্তমান ও ভবিষ্যতেও এত দর্শক উক্ত মাঠে আর হবে বলে মনে হয় না। স্বাধীন বাংলা দলের জার্সি ছিল সবুজ। তারা মাঠে প্রবেশ করে লক্ষ করলো ভারতীয় পতাকা উড়ছে। কিন্ত স্বাধীন বাংলা একাদশের কোন পতাকা নেই, তাই খেলোয়ার আর কর্মকর্তারা বেকে বসলো। এবং দাবী জানালো, মাঠে বল গড়াবে তখনই যখন নিজ দেশের পতাকা ঠাঁই পাবে ভারতীয় জাতীয় পতাকার পাশাপাশি । কিন্ত যে দেশের এখনো বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায়নি, কেউ স্বীকৃতি দেয়নি, সেই দেশের কি ভাবে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হবে? এই নিয়ে দু পক্ষের চল্ল বহু কথা, শেষ পর্যন্ত বাংলার দামাল খেলোয়ারদের কাছে নদিয়া জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা নতি স্বীকার করলেন।
কানায় কানায় পুর্ন স্টেডিয়াম সময় মত মাঠে বল না গড়ানোতে দর্শকরা অস্থির হয়ে হৈ চৈ শুরু করেছে । শেষ পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের সাথে ভারতীয় পতাকা উঠানো হলো। তারপর যেই শুরু হলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে সমস্ত স্টেডিয়াম এর দর্শকরা উঠে দাঁড়ালো, খেলোয়ার কন্ঠ মিলাচ্ছে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে আর আবেগে তাদের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। সেই সময়কার অনুভূতি কি রকম ছিল তা প্রতাপ শস্কর হাজরা বর্ননা করেছিলেন ঠিক এই ভাবে “সেই সময়ের পরিস্থিতি পরিবেশ এবং আমাদের সাথে দর্শকদের ও মানসিক অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করা কোন রকমই সম্ভাব নয়। পতাকা উত্তোলন পর্বের পর শুরু হলো মাঠ প্রদক্ষিন। আমাদের জাতীয় পতাকা সবুজ রংয়ের মাঝখানে লাল সূর্য আর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রংয়ের বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে আমরা সব প্লেয়াররা মাঠের চারদিক দিয়ে ঘুরছিলাম আর দর্শকরা উঠে দাড়িয়ে আমাদের পতাকাকে সম্মান জানাচ্ছিল, সেই দৃশ্য অভূতপূর্ব, ব্যাখ্যাতীত।”
প্রথম খেলায় বাংলাদেশের জাতীয় টিমে ছিল গোলকিপার- নূরন্নবী, ব্যাকে- বিমল, জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক) আইনুল, হাকিম। লিঙ্কম্যানে- কায়কোবাদ ও আলী ইমাম। ফরোয়ার্ড- প্রতাপ হাজরা (সহ অধিনায়ক) এনায়েত, সালাউদ্দিন ও নওসের। দ্বিতীয়ার্ধে প্রতাপের স্থানে শাহাজাহান ও নূরন্নবীর জায়গায় মোমেন খেলেন। শুরু হলো খেলা চরম উত্তেজনায়। দু পক্ষের মুহুর্মুহু আক্রমন ও প্রতি আক্রমন করে মাঠের চতুর্দিকে বল নিয়ে দাপাদাপি আর ছোটাছুটি শুরু করে ও শেষ ২-২ গোলে ড্রয়ে খেলে শেষ হয় ।
দ্বিতীয় ম্যাচে এবার খোদ কলকাতার মোহনবাগান ক্লাবের কিছু সিনিয়র ও বর্তমানে ফর্মে থাকা প্লেয়ার নিয়ে গঠিত গোস্টাপাল একাদশের সঙ্গে তাদের দলে ছিল চুনি গোস্বামী, পরিমল দে, কাজল মুখার্জী, শান্ত মিত্র, সুভাষ ভৌমিকরা আর খেলাটি হয়েছিল সি এফ সি মাঠে। এবার স্বাধীন বাংলা দলের শুধু দুজন খেলোয়ার বদলী হলো কারণ গোলকিপার নূরন্নবী ট্রেনিং-এ চলে যাওয়ায় তার স্থানে খেলতে আসে অনিরুদ্ধ আর রাইট উইংব্যাকে বিমলের পরিবর্তে স্থান বদল করে প্রতাপ।
চরম উত্তেজনায় খেলা হলো। কে হারে কে জিতে বোঝা যাচ্ছিলো না। সমান তালে উভয় দলই নিজের আয়ত্তে নিয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল ঢুকাতে চাচ্ছে, সে এক ছবির মত খেলা। এই আকর্ষণীয় খেলায় শেষ পর্যন্ত গোস্টপাল ৪-২ গোলে জয়ী হয়।
তৃতীয় ম্যাচ, স্থান দক্ষিন কলিকাতার রবীন্দ্র সরোবর, স্টেডিয়ামে বিপক্ষ দল সাউথ কলকাতা একাদশ। স্বাধীন বাংলাদেশ দলের একজন খেলোয়ার পরিবর্তন হলো। সেন্টার ফরোয়ার্ড নওশের এর বদলী খেলতে নামলো তসলিম। সেই ম্যাচটি বলতে গেলে হয়েছিল একতরফা। প্রতিপক্ষের গোলকিপার দারুন খেলেছিল তারপরও খেলার ফলাফল হলো ৩-১ গোলে স্বাধীন বাংলা দলের জয়।
চতু্র্থ ম্যাচ হলো নরেন্দ্রপুর।রামকৃষ্ণ ইনিস্টিটিউটের মাঠে। রামকৃষ্ণ মিশনের ও নরেন্দ্রপুর ক্লাবের খেলোয়াররা খেলেছিলো। সব সুযোগের ব্যাবহার করে স্বাধীন বাংলা দল ৪-০ গোলের ব্যাবধানে জয়ী হলো।
পঞ্চম ম্যাচ। খেলা হলো দুর্গাপুরে। দুর্দান্তদল সেই দলে ভারতীয় জাতীয় দলের কয়েকজন খেলোয়ার ছিল। তারমধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো গোলকিপার তরুন বোস, সেন্টার ব্যাক অরুন ঘোষ। সেই খেলায় জীবন বাজি রেখে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল লড়েছিল। তাদের খেলা দেখে উপস্থিত দর্শক করতালিতে শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছিল।তারা চাইছিল সেয়ানে – সেয়ানে লড়াইতে উপভোগ্য খেলা দেখতে। সত্যি সত্যিই চোখ জুরানো খেলা দেখে দর্শকরা আনন্দে আত্মহারা হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা দল ২-৩ গোলের ব্যাবধানে হেরে যায়।
ষষ্ঠ, সপ্তম এবং অষ্টম ম্যাচ হলো যথাক্রমে বর্ধমান, চিত্তরঞ্জন ও মুজাফফর পুরে। ষষ্ট ও সপ্তম খেলায় বর্ধমানে চিত্তরঞ্জনে খুব ভাল খেলা খেলে স্বাধীন বাংলা দল জয় ছিনিয়ে নেয় তবে অষ্টম ম্যাচে কঠিন পরীক্ষার পর মোজাফফর পুরে ১-০ গোলে হেরে যায়। সেই খেলায় প্রতাপ হাজরা খোলেনি। নবম ম্যাচ স্থান ব্যানারস। মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র ভারতীয় সরকার ও জনগন সমর্থন করছিল বাংলাদেশকে, তারা শরনার্থীদের জন্য সব রকমের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। এমন কি প্রতিমাসের বেতন থেকে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য দেওয়ার জন্য চাঁদাও দিতো তাদের সরকার জনগনের উপর করও আরোপ করেছিল। যা দিয়ে তারা লক্ষ লক্ষ শরনার্থী সেবা করতো কিন্ত ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের ক্ষুদ্র একটি ভারতীয় সরকারকে সমর্থন জানাচ্ছিল না, কারণ তাদের কাছে মনে হচ্ছিল পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে অর্থ্যাৎ তারা পুরোপুরি পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রকেই বিশ্বাস করতো। যা হোক স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বেনারসে পৌঁছানোর পর যখন দেখলো এই দলে বেশীর ভাগই মুসলমান খেলোয়ার তখন তারা আশ্বাস্ত হলো এবং খেলার সময় অনেক মুসলমান দর্শক ও দেখা গেলো। সেই খেলায় ২—১ গোলে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ দল মাঠ ত্যাগ করে।
দশম ম্যাচ, বিহারের সবচেয়ে বেশী মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশের সিওয়ান। তারা রিতীমত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তানের রেডিও শুনে পুরো মুসলিম কমিউনিটি ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে, স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় সরকার উক্ত স্থানে স্বাধীন বাংলা দলকে কড়া নিরাপত্তা দিয়েছিল ও সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছিল। একদিন বিরতি ছিলো, তাই অনেক খেলোয়ার হোটেলের বাইরে হাঁটা হাঁটি করছিল এবং স্থানীয় লোকদের সাথে আলাপ করছিলো। সন্ধ্যার মধ্যেই হোটেলের আশেপাশে মহল্লায় প্রচার হয়ে গেলো যে, দলের সবাই মুসলমান খেলোয়ার। এক কান দু কান করে সমগ্র সিওয়ানে প্রচার হয়ে গেলো পূর্ব পাকিস্তানের সব খেলোয়ারই মুসলমান, পরিবেশ পরিস্থিতি মূর্হুতের মধ্যে বদলে গেলো, দলে দলে মুসলমান দর্শকরা ভিড় জমাতে লাগলো স্টেডিয়ামে। শেষ পর্যন্ত উপচে পড়া ভিড়ে অনেকে বাইরে থেকে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটালো খেলা না দেখেই শুধু চিৎকার শুনেই শুনেই। পরে সেই উত্তেজনা পুর্ণ খেলায় ৩-০ গোলের ব্যাবধানে স্বাধীন বাংলা দল জয়ী হয়ে বীরদর্পে মাঠ ত্যাগ করলো। আর মুসলমান দর্শকরা করতালি দিয়ে সাবাস দিতে থাকে। সেদিন বাংলার দামাল খেলোয়াররা তাদের খেলা দিয়ে মন জয় করে নিয়েছিলো এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিরূপ মনোভাবাপন্ন মানুষদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
এগারোতম ও বারোতম ম্যাচ খেলা বিহার রাজ্যের পুর্নিয়ায়, সেখানে ৪ দিন অবস্থান করে ২ টি খেলা হয়।
এবার হলো শেষ ম্যাচ, খেলা হয় বোম্বে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির তত্ববধানে। সেদিন দর্শক গ্যালারিতে মহারাষ্ট্রের গভর্নর ও বোম্বের প্রখ্যাত নায়িকা শার্মিলা ঠাকুর আর মাঠের ভিতর ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ার মনসুর আলী খান পাতাদৌ, তিনি হাফ টাইম পর্যন্ত খেলেছিলেন। সেই খেলায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ৩- ১ গোলে বিজয়ের বেশে হাসতে হাসতে মাঠ ছাড়ে।
টীম ফিরে এলো কলিকাতায় শেষ পর্যন্ত ক্রীড়া সমিতি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ক্লোজ করে দেয়। তবে খেলোয়ারদের জন্য যে বাড়ি নেওয়া হয়েছিল সেখানে খেলোয়ারদের থাকার ব্যাবস্থা ও হাত খরচের জন্য ব্যাবস্থা করা হয়। কারণ যুদ্ধে বাংলাদেশ তখন অনেক অংশ হানাদার মুক্ত করেছে, এবং চরম আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তাই সবার তখন রনাঙ্গানে দৃষ্টি।
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ফুটবলাররা ঝাপিয়ে পরেছিলো তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না কিন্ত ফুটবল শৈলী দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন আদায় করেছিলেন বিশ্ববাসীর এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। এত কিছুর পরও সেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অনেকেই স্বীকৃতি পাননি। বাংলাদেশ ২০০৩ সালে সরকারী যে গেজেট বের করেন সেখানে ৩১ জন খেলোয়ারের নাম স্থান পেয়েছে অথচ ৩৫ জন সেই টীমে ছিল । ঐ গেজেট দেখে খুলনা থেকে গোলপিকার বিরেন দাস বিরু তার নাম না দেখে তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাকারিয়া পিন্টুকে জানিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি এ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্নাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, “বীরু আমাদের দলের খেলোয়ার ছিলেন এটি দিবালোকের মত সত্য। ২০০৩ সালে জোট সরকারের আমলে প্রকাশিত গেজেটে তো আমার ও কোচ ননী বসাকের ও নাম নেই। তাই বলে কি আমি স্বাধীন বাংলা জাতীয় দলের ম্যানেজার ছিলাম না?”