আল্লাহু আকবর…
…
হা ইয়া আলাছ ছালা
হা ইয়া আলাল ফালা
…
নামাজের দিকে এসো
কল্যাণের দিকে এসো
মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে, প্রতিটি মুসলমানকে আহ্বান জানাচ্ছে—
সে আহ্বান উপেক্ষা করে ঘাতকের দল এগিয়ে এলো ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটাবার জন্য।
গর্জে উঠল ওদের হাতের অস্ত্র। ঘাতকের দল হত্যা করল স্বাধীনতার প্রাণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই নরপিশাচরা হত্যা করল আমার মাতা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে।
হত্যা করল মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রনেতা শেখ কামালকে, শেখ জামালকে, তাদের নব পরিণীতা বধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। যাদের হাতের মেহেদীর রং বুকের তাজা রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেল।
খুনিরা হত্যা করল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরকে।
সামরিক বাহিনীর কর্নেল জামিলকে যিনি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা দানের জন্য ছুটে এসেছিলেন।
হত্যা করল কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার ও কর্মকর্তাদের।
আর সব শেষে হত্যা করল শেখ রাসেলকে, যার বয়স মাত্র দশ বছর। বারবার রাসেল কাঁদছিল ‘মায়ের কাছে যাব বলে’। তাকে বাবা ও ভাইয়ের লাশের পাশ কাটিয়ে মায়ের লাশের পাশে এনে নির্মমভাবে হত্যা করল।
ঐ ঘৃণ্য খুনিরা যে এখানেই হত্যাকাণ্ড শেষ করেছে তা নয়, একই সাথে একই সময়ে হত্যা করেছে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে।
হত্যা করেছে কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে, তার তেরো বছরের কন্যা বেবীকে।
রাসেলের খেলার সাথী তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছরের আরিফকে।
জ্যেষ্ঠপুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর জ্যেষ্ঠসন্তান চার বছরের সুকান্তকে। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত ও নান্টুসহ পরিচারিকা ও আশ্রিত জনকে।
আবারও একবার বাংলার মাটিতে রচিত হল বেঈমানীর ইতিহাস।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে বেঈমানী করেছিল তাঁরই সেনাপতি মীর জাফর ক্ষমতার লোভে, নবাব হবার আশায়।
১৯৭৫ সালে সেই একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল তাঁরই মন্ত্রিপরিষদ সদস্য খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হবার খায়েশে। ঘাতকের দলে ছিল কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক, মেজর ডালিম, হুদা, শাহরিয়ার, মহিউদ্দীন, খায়রুজ্জামান, মোসলেম গং। পলাশীর প্রান্তরে যেমন নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল নবাবের সৈন্যরা সেনাপতির গোপন ইশারায়—
১৯৭৫ এদিনও নীরব ছিল তারা, যারা বঙ্গবন্ধুর একান্ত কাছের, যাদেরকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন, বিশ্বাস করে ক্ষমতা দিয়েছিলেন—যাদের হাতে ক্ষমতা ছিল। তাদের এতটুকু সক্রিয়তা বা ইচ্ছা অথবা নির্দেশ বাঁচাতে পারত বঙ্গবন্ধুকে—খন্দকার মোশতাকের গোপন ইশারায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল তারা, এগিয়ে এল না সাহায্য করতে। মীর জাফরের নবাবী কতদিন ছিল? তিন মাসও পুরো করতে পারেনি—খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতি পদ (যা সংবিধানের স্ব নীতিমালা লঙ্ঘন করে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অর্জিত) তিন মাসও পুরো করতে পারেনি।
আসলে বেঈমানদের কেউই বিশ্বাস করে না। এমনকি যাদের প্ররোচনায় এরা ঘটনা ঘটায়, যাদের সুতোর টানে এরা নাচে তারাও শেষ অবধি বিশ্বাস করে না। ইতিহাস সেই শিক্ষাই দেয়। কিন্তু মানুষ কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়?
যুগে যুগে এ ধরনের বেঈমান জন্ম নেয় যাদের ক্ষমতা লিপ্সা এক একটা জাতিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়। ধ্বংস ডেকে আনে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হত্যা করে বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই খুনিরা হত্যা করেছে।
স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যকে হত্যা করেছে। বাঙালি জাতির চরম সর্বনাশ করেছে।
এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে খুনিদের আইনের শাসনের হাত থেকে রেহাই দিয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করে পুরস্কৃত করেছে।
আইনের শাসনকে আপন গতিতে চলতে দেয়নি। বরং অন্যায়-অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালিত করেছে। যার অশুভ ফল আজ দেশের প্রতিটি মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাচ্ছে।
এই খুনিদের বাংলার মানুষ ঘৃণা করে!
বঙ্গবন্ধুকে এরা কেন হত্যা করেছে?
কি অপরাধ ছিল তাঁর?
স্বাধীনতা—বড় প্রিয় একটি শব্দ। যা মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা। পরাধীনতার নাগপাশে জর্জরিত থেকে দম বন্ধ হয়ে কে মরতে চায়?
একদিন পাকিস্তান কায়েমের জন্য সকলে লড়েছিল। লড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুও। কিন্তু পাকিস্তান জন্মলাভের পর বাঙালি কি পেল? না রাজনৈতিক স্বাধীনতা, না অর্থনৈতিক মুক্তি। বাঙালির ভাগ্যে কিছুই জুটল না, জুটল শোষণ বঞ্চনা নির্যাতন এবং মায়ের ভাষা মুখের ভাষাও পাকিস্তানি শাসকরা কেড়ে নিতে চাইল। বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি তার মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করল। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবার ষড়যন্ত্র চলতে থাকল।
দেশের সম্পদ পাচার করে বাঙালিকে নিঃস্ব করে দিয়ে বাইশটি পরিবার সৃষ্টি করে শোষণ অব্যাহত রাখল।
আর বঙ্গবন্ধু মুজিব শোনালেন অমর বাণী স্বাধীনতা। দেখালেন মুক্তির পথ।
‘এবারের সংগ্রাম— আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম— স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’
জয় বাংলা—
ঘোষণা করলেন বাঙালির বিজয়!
জয় বাংলা—
সেই তো তাঁর অপরাধ।
যে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের লীলাক্ষেত্র, জানোয়ারের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নিলে যেমন সে হিংস্র হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি হিংস্র হয়ে উঠল পরাজিত শত্রুরা। কারণ ঐ অমর বাণী ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে বেজে উঠল সমগ্র বাঙালির শিরায় উপশিরায়—প্রচণ্ডরূপে আঘাত হানল বাঙালির চেতনায়।
১৯৭১ এর ৭ মার্চে বজ্রকণ্ঠের অমর সে বাণী যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল প্রতিটি বাঙালিকে। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুকে পরাজিত করে বাংলার দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে আনল লাল সূর্যকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঐ পরাজিত শত্রুদের দোসর নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করল যেন! পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করল।
মুজিববিহীন বাংলাদেশের আজ কি অবস্থা?
বঙ্গবন্ধু মুজিবের সারাজীবনের সাধনা ছিল শোষণহীন সমাজ গঠন। ধনী-দরিদ্রের কোনো ব্যবধান থাকবে না। প্রতিটি মানুষ জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ পাবে।
সারাবিশ্বে বাঙালি জাতির স্বাধীনসত্তাকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে তিনি চেয়েছিলেন। আর সেই লক্ষ্যে সারাজীবন ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন, আপসহীন সংগ্রাম করে গেছেন, জেল, জুলুম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন। ফাঁসির দড়িও তাকে তাঁর লক্ষ্য থেকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। তাঁর এই আপসহীন সংগ্রামী ভূমিকা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য আদর্শ স্থানীয়।
কিন্তু আমরা কি দেখি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি—আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পর্যন্ত বিকৃত করে ফেলছে। বঙ্গবন্ধুর অবদান খাটো করা হচ্ছে। ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ঘৃণ্য চক্রান্ত চলছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধ, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দেওয়া হলো।
যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশ স্বাধীন করে গণতন্ত্র কায়েম করেছিল বাঙালিরা, সেই গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সামরিক জান্তার শাসন কায়েম করল হত্যাকারীরা। সাধারণ মানুষ তার মৌলিক অধিকার হারাল। ভোট ও ভাতের অধিকার বন্দি হয় সেনা ছাউনিতে।
স্বাধীনতার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে শুধুমাত্র একটি মানুষের অভাবে। বাংলার মানুষের এই দুর্ভোগের জন্য দায়ী ঐ খুনিরা, দায়ী ষড়যন্ত্রকারীরা।