বাংলার মানুষের সমাজজীবনে সর্বাপেক্ষা বিষাদ ও ‘বিপর্যয়ের’ দিন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। মানুষের জগৎ-দর্শন কেবল হানাহানি এবং স্বার্থপরতার জন্য নয়, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে মাটির পৃথিবীকে সুবর্ণ সাজে সজ্জিত করা। এই ১৫ই আগস্ট সেই পথের প্রধান অন্তরায়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, সব বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে, ধর্মীয় ‘বিদ্বেষ বিষ নাশ’ করে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাইকে এক সুশীতল ছায়ায় অবস্থানের ব্যবস্থা করতে।
এই দিনে তাঁকে প্রায় সপরিবারে নৃশংস উপায়ে হত্যা করে গোটা জাতির আনন্দময় বাঁচার অধিকার রুদ্ধ করা হয়। তাই ১৫ই আগস্ট বাংলার মানুষের মানবধর্ম রক্ষার সর্বাপেক্ষা বিপর্যয়ের দিন। জাতীয় বিপদের দিন। তাই বলে এই দিনে আমাদের কেবল শোক প্রকাশ করলেই চলবে কেন! মানবধর্মের প্রতি বঙ্গবন্ধুর সুদৃঢ় অঙ্গীকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রতিস্থাপনের বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। আড়ম্বরের সঙ্গে লোক-দেখানো স্মরণসভা করে আখের গোছানোর চেয়ে বঙ্গবন্ধু যে মানবমুক্তির আদর্শ প্রতিষ্ঠার ভার নিয়েছিলেন, তা কিভাবে কার্যকর করা যায়, তা করতে পারলে ঘাতকদের মানববিদ্বেষের সমুচিত জবাব দেওয়া যাবে।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৫ই আগস্টের কতিপয় নট-নটীর বিচার হয়েছে। যারা সুবিধাভোগী, মানুষে মানুষে বিভেদের দেয়াল তুলে, মতবাদের ধজা ধরে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত ভোগের পসরা সাজাতে, তাদের দুষ্টচক্র ভাঙতে পারলে মানুষ কাঙ্ক্ষিত পথে অগ্রসর হতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার বরাভয় প্রতিষ্ঠার বীজ উপ্ত করেছিলেন রাষ্ট্রীয়ভাবে। অবশ্য এর শিকড় সুদীর্ঘকালের। ওই যে জীবনকে আনন্দময় করে তোলার লক্ষ্যে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস গেয়েছিলেন—‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’, তারই যেন রাষ্ট্রীয় রূপায়ণ। ক্ষমতাধর আর ক্ষমতাহীনের দ্বন্দ্ব চিরকালের ধর্মীয় চেতনার দ্বন্দ্ব একই সঙ্গে চলে এসেছে। সভ্যতার সূচনা থেকে মানুষকে ভয় ও ভোগের কথা বলে বশে রাখার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। এতে যে কাজ হয়েছে তা মানতেই হয়, নতুবা এতকালের ধ্যান-ধারণা কি থাকত! তবে মানবিক লোভ-লালসা সব অর্জনের বিনাশ ঘটিয়েছে। তাই মধুসূদনের ভাষায়—‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’র পথ অনুসরণ করা হয়েছে সর্বত্র। বঙ্গবন্ধু সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন বেশি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই দুর্বহ বোঝা তাঁকে একা বহন করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সেই, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ অভিপ্রায় তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
কথিত আছে, ওই যে ঘাতক শিরোমণি খন্দকার মোশতাক আহমদ নাকি বঙ্গবন্ধুর পিতাকে সমাধিস্থ করার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ে আর্তনাদ করেছিলেন। সেই কপট বাহ্যিক ধর্মাচারী মানুষটি যে ঘাতকদের ষড়যন্ত্র চরিতার্থের জন্য নেতৃত্ব দেবে, তা কি কেউ বুঝে উঠেছিল!
আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, পাকিস্তানিদের আক্রোশ, আর স্বদেশি কিছু মতলবাজের অভিসন্ধির কারণে কতিপয় কুলাঙ্গার ১৫ই আগস্টের ঘৃণ্য দিনটি সংঘটিত করে। দুঃখ হয়, এই বাংলার মাটির কৃতঘ্ন কিছু মানুষ একে ‘নাজাত দিবস’, কেউ আবার বানানো জন্মদিবস করে অস্ত্রের বলে পৈশাচিক উল্লাস করেছে।
কিছু সত্য নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রত্যেকেই নিজেকে কেউকেটা (সেরা অর্থে) ভাবতে ভালোবাসেন। সেখানে পৌঁছুতে অনেক সময় ন্যায়নীতি বিসর্জন দিতে হয় অনেককে। বেশির ভাগ বিত্তবানের ইতিহাস খুঁজলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসবে। বৃহত্তর মানবস্বার্থে বঙ্গবন্ধু তাই সম্পদের একটা সীমা নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ঋষি তলস্তয়ের ‘মানুষের জীবনে ভূমির প্রয়োজন কতটুকু’ রচনাটি পড়েছিলেন হয়তো। সেই সঙ্গে ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন, এক জীবনে ভোগের অভিজ্ঞতা কতটুকু! এর পক্ষে আইনও করেছিলেন। এটা কায়েমি স্বার্থবাদীরা গ্রহণ করতে পারেনি। অবশ্য জমিদারি প্রথা পূর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালে রহিত হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তান আজও টিকিয়ে রেখেছে। এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। যাই হোক, জমিদারি গেলেও, জোতদার কম ছিল না। এদের অমানবিক দাপট খর্ব করার জন্য এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে তিনি ভূমি আইনটি বলবৎ করেছিলেন, করেছিলেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমির কর মওকুফ।
ধর্মের বিষয়টিকে কিছু ধর্মব্যবসায়ী ব্যক্তি প্রতিবন্ধকতার দেয়াল হিসেবে খাড়া করতে সমর্থ হয়েছে চিরকাল। বঙ্গবন্ধু ধর্ম নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের অপচেষ্টা খর্ব করতে চেয়েছিলেন। ‘ধর্ম যার যার, আচরণ তার তার’ স্বতঃসিদ্ধতাকে বানচাল করতে পারলে মানবধর্ম চরিতার্থ করা কঠিন। এটা কপট ধর্মাচারীদের অস্ত্র। বঙ্গবন্ধু তাদের অপকৌশল রুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ১৫ই আগস্ট কপটধর্মাচারী উল্লসিত ছিল, আজও তারা নানা ফেরেবে সেই অপকৌশলরত। আইন করে বাইরের আচরণের একটা সমীকরণ হয়; কিন্তু মনের জগৎ যে ভিন্ন। তাই তাঁকে প্রাণ দিতে হলো। ফলে ইতিহাসে যাদের কোনো ঠাঁই ছিল না, তারাই নায়ক হয়ে গেল। এখনো কপটরাই দাপটে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আধিপত্য।
আপাত মুখরোচক কাজ করে তেলেসমাতি সৃষ্টি করা যায়; কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করতে হলে একটা চিহ্নিত সিদ্ধান্ত থাকা দরকার। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল সেটাই। তা করতে দেওয়া হয়নি। অথচ তাদেরই আধিপত্য! আমাদের এত সব অপকীর্তি দেখে শিক্ষা নেওয়ার পথ হবে কি!