ঘরে তখনও পানি। সকাল থেকে একটি দানাও মুখে পড়েনি পঞ্চাশোর্ধ জোলেখা বেগমের। প্রতিবেশী শিউলিকে (৪২) সঙ্গে নিয়ে ভর দুপুরে কড়া রোদের মাঝে ডিঙি নৌকায় ছাগলগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গাছের পাতা সংগ্রহ করার জন্য।
নানা লাঞ্ছনা সহ্য করেও গ্রামবাসীর বাড়ি থেকে পাতা সংগ্রহ করতে হয়। উপায় যে নেই। এমনিতে নিজেরাই চরম খাদ্য কষ্টে দিন কাটাচ্ছে তার ওপর তাদের গৃহপালিত পশুর খাবার সংগ্রহ। চারদিকের চারণভূমিতে পানি কমলেও বিপদ কাটেনি। বাঁশের পাতাসহ বিভিন্ন গাছের পাতাই একমাত্র খাদ্য এই গৃহপালিত প্রাণীগুলোর।
কুড়িগ্রামের ধরলাপাড়ের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চর সর্দারপাড়া গ্রামের মাঝ বয়সী দুই নারীসহ দেশের বন্যাকবলিত জেলাগুলোর গ্রামীণ চিত্র প্রায় একই রকম। কারণ তাদের বিপদে একমাত্র অবলম্বন গৃহ পালিত পশুগুলো।
এখনও কুড়িগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা, জামালপুর শেরপুরসহ দশের প্রায় ১১ জেলায় চলছে বন্যা পরবর্তী দুর্ভোগ। চরম দুঃসময় কাটাচ্ছে নারীরা। কারণ বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি মহিলারাই লালন পালন করে থাকেন। সংসারের একমাত্র সম্পদ বলতে এগুলো। জরুরী কোন প্রয়োজনে গরু-ছাগল বিক্রি করেই তাদের সংসারের প্রয়োজন মেটান।
বন্যা আমাদের দেশে নিত্যনৈমত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এবারের সিলেটের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
কেননা সুনামগঞ্জ এবং সিলেটের বন্যার পানির তোড়ে সবকিছু ডুবে যাওয়াতে শুকনা জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেখানে বন্যার্তরা একটু আশ্রয় নিতে পারবে সে জায়গাও ছিল না। মানুষের ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদিপশু, রাস্তাঘাট, পুকুরের মাছ, ঘরের ভেতরের শুকনা ধান, চাল ইত্যাদি পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তারা নিঃস্বই বলা যায়। এখানেও গ্রামাঞ্চলে নারীদের শেষ অবলম্বন গরু, ছাগল, আর হাঁস-মুরগি।
এই বিপদের দিনে এগুলো বিক্রি করে জীবনটাকে কোন রকম বাঁচিয়ে রাখছে তারা। বন্যাকবলিত মানুষদের কিছু পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করছে সরকারসহ সকলেই কিন্তু গৃহপালিত পশুদের কথা কেউ ভাবছে না। দেশের বন্যাকবলিত গ্রামীণ জনপদের নারীরা তাদের গরু-ছাগলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চরম কষ্ট করছে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত।
শুক্রবার দুপুরে ধরলাপাড়ের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সর্দারপাড়া, মাঠের পাড়, পাঙ্গারচর, সবুজপাড়া নামা সর্দারপাড়া, জয়সরস্বতী পাড়া ঘুরে বেড়িয়েছি।
গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে পানি। গ্রামের মহিলারা তাদের ছাগল ও ভেড়াগুলোকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ফ্রেন্ডশিপ স্কুল মাঠে। এই গ্রামের আসমা বেগম (৩৪) জানান ছয় বছর আগে স্বামী যৌতুকের কারণে তাকে তালাক দেয়। তার দুই বছরের সন্তান রাসেলকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সন্তানকে লালন পালন করার জন্য ছাগল পালন করে আসছে।
তার সন্তানের চেয়েও বেশি ভালবাসে এই ছাগলগুলোকে। কারণ প্রতিটি বিপদ আপদে এগুলো বিক্রি করে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বন্যার দিনগুলোতে ঘরে পানি থাকায় বাঁধের উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। এখনও সেখানেই আছে।
একই গ্রামের তালাকপ্রাপ্ত মরিয়ম বেগম (৫৫) বাবা মহির উদ্দিনের বাড়িতে থাকেন। কোন সন্তান নেই তার। নিজের জীবনটাকে বাঁচানোর জন্য দুটি ছাগল লালন পালন করেন। বন্যার আগে দুটি ছাগল ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। তাই দিয়ে বন্যার কঠিন সময় পার করছেন।
একই গ্রামের নুরনাহার (৩৫), সকিরন (৫২), আফরোজা (৩৫), মরিয়ম (২৯) জানান আমাদের চর-দ্বীপচরের গ্রামগুলোতে অধিকাংশ নারীই ছাগল, গরু, হাঁস-মুরগি লালন পালন করেন। স্বামীরা কাজে যান। তারা এগুলোর যত্ন করার সময় পান না।
বন্যার সময় চরম কষ্ট করতে হয় গবাদিপশুগুলোকে নিয়ে। বৃষ্টির রাতে শুধুমাত্র একটি পলিথিন টাঙিয়ে গরু-ছাগল নিয়ে বিনিদ্রায় রাত কাটাতে হচ্ছে চোরের ভয়ে। শুধু কুড়িগ্রামের ধরলাপাড়ের এ দৃশ্য নয়, এটি লালমনিরহাট, জামালপুর, শেরপুর, সিলেট ও সুনামগঞ্জের একই দৃশ্য। ঈদে এই গবাদিপশুগুলোকে হাট-বাজারে বিক্রি করে বন্যার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারেছে।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা জানান, কুড়িগ্রামসহ সারাদেশের নারীদের একমাত্র অবলম্বন তাদের গৃহপালিত গরু ও ছাগলগুলো। সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগের যেন একটু সতর্ক নজর থাকে।
পশুখাদ্য যেন বেশি পরিমাণে ত্রাণ দেয়। আর সময়মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করে। তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে বলে তারা মনে করেন।