উন্নয়ন আর আশার বাণী শুনতে শুনতে আমরা, মানে পুরো জাতি ক্লান্ত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এ দিকে বিশ্ব-অর্থনীতির চিত্র বর্তমানে খানিকটা মন্দাক্রান্ত হলেও আমাদের অর্থনীতি এখন কোন পথে ধাবিত হচ্ছে, এর উত্তর দেয়া খুব সহজ নয়। সবাই একমত হবেন যে, সামনে দৃষ্টির আয়নাতে ভেসে ওঠা সম্ভাব্য প্রতিটি পদক্ষেপ দুর্বল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিশয় নাজুক বলে মনে হয়। পথ তিনটি হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বদ্ধ স্ফীতি বা স্ট্যাগফ্লেশন এবং রিসেশন বা মন্দা। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস গত মাসে বলেছেন, বেশির ভাগ দেশে মন্দা অবস্থা ধেয়ে আসছে। এমনকি বিশ্বে ১৯৭০ দশকের সেই স্ট্যাগফ্লেশনও ফিরে আসতে পারে বলেও মত প্রকাশ করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা সম্প্রতি বলেছেন, বিশ্ব-অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও আরো অনিশ্চিত। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতি কি মন্দার পথে, নাকি ফিরে আসছে স্ট্যাগফ্লেশন। আর মন্দা ধেয়ে আসলে সেটি কবে থেকে হতে পারে। নাকি শুরু হয়ে গেছে।
দেশের সচেতন মহল এবং সুশীলসমাজের অনেকে সরকারের বর্তমান অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। সরকার নিজ দলের লোকজনের অতিকথন আর লাগামহীন কথাবার্তা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, অর্থপাচার, রিজার্ভ সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্য প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি, লোডশেডিং ও পুনরায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা. মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার সর্বাধিক অবমূল্যায়ন, আইএমএফ ঋণের জন্য তৎপরতা, সারা দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাসহ জনঅসন্তোষে নাজেহাল অবস্থায়। অবকাঠামো উন্নয়ন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে, আর ঋণ বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। অর্থাৎ সুদে+আসলে = আসল হয়ে দাঁড়ায়। আর এ উন্নয়ন করতে গিয়ে কাজের ধীরগতি, সময়ের অপচয়, বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি, অর্থের অপচয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রামানের সাথে দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, অর্থপাচারসহ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের জনগণের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিবর্তে অনৈতিক অবস্থান একটা উন্নয়নমুখী রাষ্ট্রকে দুর্বল অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চাওয়া সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ‘বেইল আউট’ নিয়ে আইএমএফের সাথে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। ৯ দিন ধরে আলোচনার পর এখন আইএমএফের দ্বিতীয় প্রতিনিধিদল ঢাকা আসবে।
ইতোমধ্যে আইএমএফের শর্তগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে যা বলা হচ্ছে- সেগুলো নতুন কিছু নয় এ অর্থে যে, এগুলো নিয়ে দেশের ভেতরে গত কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছিল। যারা বলছিলেন তাদের কথা সরকার শোনেনি।
সরকার সমর্থকরা এ বক্তব্যগুলো ‘দেশবিরোধী’, ‘উন্নয়নবিরোধী’, এমনকি ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলেও অভিহিত করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে, যাদের এ প্রশ্নগুলো করা দরকার ছিল সেই অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেছেন।
আইএমএফের প্রাথমিক শর্তগুলোর মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে দুর্নীতি, বেহিসেবী ব্যয় এবং অবাধ লুণ্ঠনের যে মহোৎসব চলেছে তা বন্ধ করতে হবে। আইএমএফের হিসাব চাওয়ার ধরন আলাদা। ফলে আইএমএফের নিজস্ব ভাষায় এখন হিসাব চাওয়া হয়েছে, জ্বালানি খাতে দেয়া ভর্তুকি কোথায় কিভাবে ব্যয় হয়েছে, কোভিড মোকাবেলায় প্রণোদনার নামে যে টাকা দেয়া হয়েছে তার হিসাব কোথায়, আর মেগা প্রকল্পে ‘অতি-মূল্যায়ন’ সহজ ভাষায় অতিরিক্ত ব্যয় কেন হয়েছে। এগুলোতে স্বচ্ছতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এসব শর্ত আলোচনার প্রথম ধাপে এসেছে, সামনে আরো কী কী তাতে যুক্ত হবে এখনো তা জানা যায়নি। আইএমএফের এ শর্তগুলোর যৌক্তিকতা আছে কি না সেটি বিবেচনা করার সাথে সাথে আইএমএফ’র কাছে অর্থ নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে কেন সেটি গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার।
আপামর জনগণের আবার এটাও মনে রাখা দরকার, দেশের জনগণকে উন্নয়নের ডামাডোলের গোলকধাঁধায় রেখে সরকার কেবল যে আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংকের কাছে টাকা ঋণ চাচ্ছে তা নয়, ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদারদের কাছেও দেশের বর্তমান সরকার অর্থ ঋণ চেয়েছে। তার পরিমাণ তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে আরো ৪২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ চায়। প্রথম কিস্তিতে ১৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। গত বছরগুলোতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এ ধরনের আর্থিক ঋণ নিয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং আর্থিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিদেশী ঋণ ২০১৫ সালে ছিল হাজার ৯১০ কোটি টাকা, যা প্রতি বছরের ঋণসহ বেড়ে ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকায়। অপর দিকে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে আড়াই থেকে তিন বছরের মাথায় সে ঋণের বোঝা দ্বিগুণের বেশি হয়ে দাঁড়াবে, যার দায়ভার পুরোপুরি জনগণের ঘাড়ে এসে পড়বে। যেমন একটি হিসাবে দেখা যায়, গত ছয়-সাত মাস আগেও এক ডলার সমান ছিল আশি টাকার একটু উপরে। এ ক’মাসের ব্যবধানে ডলারের মূল্য সরকারিভাবে ১০০ টাকার কিছুটা বেশি হলেও খোলাবাজারে মূল্য বেড়ে প্রায় ১২০ টাকায় গিয়ে ছোঁয়। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের হার ৫০ শতাংশ। অন্য দিকে, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির হার ২০ শতাংশের মতো হলেও সরকারি নীতিনির্ধারকরা অবলীলায় ভুল তথ্য দিয়ে সাড়ে ছয় থেকে ৭ শতাংশ বলে যাচ্ছেন। অথচ দেশের প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি জনগণের মাথাপিছু প্রায় ২৫ হাজার টাকা ঋণ রেখে বলা হয়েছে উন্নয়নের রেলগাড়ি বুলেটের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
দেশের একাধিক অর্থনীতিবিদের মতে, একটি অস্বচ্ছ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশর এসব ঋণ নেয়া হচ্ছে। এর জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। এমনকি এক তরফা সংসদেও এ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা পর্যন্ত হচ্ছে না। এসব হচ্ছে এমন একসময় যখন আমরা জানি যে ইতোমধ্যে যে ঋণ আছে, সেগুলোর হিসাবে আগামী তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। এসব অর্থ ফেরত দেয়ার দায় জনগণের। আগামীতে প্রতিটি পয়সা গুনে গুনে হিসাব করে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু এ নিয়ে তাদের জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। সুতরাং সঙ্কটের মাত্রাটা বোঝা দরকার এবং সামনে আরো কী ধরনের পরিস্থিতির সূচনা হতে পারে সেই বিষয়ে ভাবা অত্যন্ত জরুরি।