চলতি বছরের আগস্ট মাসের শুরুর দিকের ঘটনা। হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া যুবক টি সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার জেরা চলছিল ভারতের কর্নাটকের মান্ডিয়া থানায়। পুলিশের কাছে তিন জনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে সে। পুলিশকে সে জানিয়েছিল, তিন জনকে খুন করলেও সাত জনকে খুন করার উদ্দেশ্য ছিল তার কিন্তু তিন জনকে হত্যার পরই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। জিজ্ঞাসাবাদের শেষ দিনে এসে বয়ান বদল করে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা ঠান্ডা গলায় বলে, সাত জন নয়, আসলে আট জনকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। শেষ খুন কাকে করতে চেয়েছিল সে? পুলিশ তা জানতে চাইলে ততোধিক ঠান্ডা গলায় সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা উত্তর দেয়, প্রেমিকা চিত্রকলাকে হত্যা করতে চেয়েছিল সে। এই কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় পুলিশ। কারণ, চিত্রকলার জন্যই সাত জন মানুষকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল সে। কিন্তু কেন প্রেমিকাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা?
ঘটনার সূত্রপাত, চলতি বছরের ৮ জুন। মহীশূরের কাছে একটি ছোট্ট গ্রাম মান্ডিয়া। সেই দিনই এই গ্রামের নদীর ধার থেকে উদ্ধার হয় এক নারীর মরদদেহ। নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক গ্রামবাসী মৃতদেহ দেখতে পান। মৃতদেহের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে চিৎকার করে ওঠেন তিনি। কারণ, মৃতদেহের কোমর পর্যন্ত কাটা ছিল। কোমর থেকে নীচের অংশ দেখতে পাওয়া গেলেও উধাও ছিল মৃতদেহের মুখ-সহ শরীরের উপরের অংশ। কাটা মৃতদেহ দেখে পালিয়ে যান ওই ব্যক্তি। পুরো বিষয়টি শুনে পুলিশ এসে উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে। পুলিশ এসে কাটা মৃতদেহ উদ্ধার করে। মৃতদেহের বাকি অংশ উদ্ধার করতে ওই এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর ২৫ কিলোমিটার দূরে খোঁজ পাওয়া যায় মৃতদেহ। কাকতালীয়ভাবে ওই মৃতদেহেরও অর্ধেক অংশ গায়েব ছিল। খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রথম মৃতদেহের অর্ধেক অংশ খুঁজে পাওয়া গেছে ভেবে পুলিশ সেখানে পৌঁছায়। কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ হতভম্ব হয়ে যায়। কারণ, এই মৃতদেহেরও শরীরের কোমর থেকে উপরের অংশ গায়েব ছিল। পড়ে ছিল কোমর থেকে নীচের অংশ।
কর্নাটকের এই ছোট্ট গ্রামের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে দুই নারীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। দু’টি মৃতদেহেরই কোমর থেকে উপরের অংশ গায়েব ছিল। ফলে মৃতদেহ দু’টি কার, এ নিয়ে ধন্ধে পড়ে পুলিশ। পরিচয় না পাওয়া গেলেও প্রাথমিক তদন্তের পর এবং মৃতদেহ দু’টি অর্ধেক করার ধরন দেখে পুলিশের ধারণা হয়, এই দুই কাণ্ডের পিছনে এক জনেরই হাত আছে। পুলিশ সবার প্রথম মৃতদের পরিচয় জানতে কর্নাটক এবং আশেপাশের রাজ্যগুলোতে নিখোঁজ নারীদের খোঁজে নামে। পাশাপাশি মহীশূর এবং কাছের এলাকাগুলোতে প্রায় ১০ হাজার প্রচার পুস্তিকাও বিতরণ করে। ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা জানান, মৃত দুই নারীরই বয়স ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে ছিল। মৃতদেহ শনাক্ত করার কাজে নামে পুলিশের ন’টি আলাদা দল। প্রতিটি দলে পাঁচ জন করে মোট ৪৫ জন পুলিশকর্মী এই ঘটনার তদন্তে নামেন। তদন্তে নামার পর পুলিশ জানতে পারে ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে বয়স, এমন এক হাজার ১১৬ জন কর্নাটক থেকে নিখোঁজ। মৃত্যুর দিন ক্ষণ মিলিয়ে সেই তালিকা থেকে অনেক নিখোঁজ নারীকেই বাদ দেওয়া হয়। বয়স না মেলার কারণেও তালিকা থেকে বাদ যান বহু নারী।
এরই মধ্যে ঘটনার দু’মাস পেরিয়ে যায়। দুই নারীর খোঁজে পুলিশের তদন্তকারী একটি দল বেঙ্গালুরুর কাছে একটি বাড়িতে পৌঁছায়। এই বাড়ি থেকে এক জন নারী জুন মাসের গোড়ার দিকে নিখোঁজ হয়ে যান। মিলে যায় তার বয়সও। এর পর মৃতদেহ দু’টির গায়ে থাকা কাপড়ের ছবি ওই বাড়ির লোকেদের দেখানোয় তা চিহ্নিত করেন তারা। পুলিশ আরও নিশ্চিত হতে ওই পরিবারের নিখোঁজ নারীর ফোন নম্বর নিয়ে ফোনের শেষ লোকেশন ট্র্যাক করার কাজে নামে। পুলিশ দেখে ওই নারীর ফোন খুনের ঘটনার কাছে মৃতদেহ উদ্ধারের এক দিন আগেও সক্রিয় ছিল। ওই নারী ফোনে কার কার সঙ্গে কথা বলেছেন তা বের করে তিন জনকে সন্দেহের তালিকায় ফেলে পুলিশ। সন্দেহের তালিকায় থাকা তিন জনের মধ্যে এক জন ছিল সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। পুলিশ দেখে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার ফোনের লোকেশনও মৃতদেহ উদ্ধারের এক দিন আগে ওই জায়গাতেই ছিল। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার মোবাইল নম্বর থেকে তার ঠিকানা খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি পুলিশকে। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পাকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জেরার মুখে প্রথমে খুনের কথা অস্বীকার করলেও পরে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা জানায় এই খুন সে-ই করেছে। এমনকি, ২৫ কিলোমিটার দূরে অন্য যে নারীর অর্ধেক মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, তাকেও সে খুন করেছে বলে জানায়। এ ছাড়া বেঙ্গালুরুতে আরেক জন নারীকে খুন করার কথা স্বীকার করে সে। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা বেঙ্গালুরুর একটি কাপড়ের কারখানায় কাজ করত। বেঙ্গালুরুতে থাকাকালীন সেখানকার এক যৌনপল্লিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। সেখানেই তার দেখা হয় চিত্রকলা নামে এক যৌনকর্মীর সঙ্গে। কিছু দিন নিয়মিত ভাবে চিত্রকলার সঙ্গে মেলামেশা করার পর তার প্রেমে পড়ে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। প্রেমে সাড়া দেন চিত্রকলাও।
চিত্রকলার আচার-ব্যবহার, চলন-বলন দেখে তাকে এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছিল না সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। কীভাবে চিত্রকলা এখানে এলেন, তা জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠন সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। চিত্রকলা তাকে জানান, বছর দু’য়েক আগে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়। এর পরই চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। চাকরির খোঁজে বিভিন্ন মানুষের দ্বারস্থ হয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। এর পরেই পরিচিত কিছু নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা চাকরি দেওয়ার নাম করে চিত্রকলাকে যৌনপল্লিতে এনে বিক্রি করে দেন। চিত্রকলা জানান, তাদের এই কাজে সাহায্য করেন চার জন পুরুষও।
চিত্রকলার জীবন বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। চিত্রকলার এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে এই যুগল। ঠিক করে প্রথমে তিন নারীকে শেষ করবে এবং পরে খুন করবে ওই চার পুরুষকে। চিত্রকলাকে এই পেশায় নামানোর জন্য দায়ী নারীরা নিজেরাও যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে এক নারীর বাড়ি ছিল বেঙ্গালুরুর কাছে। চিত্রকলার থেকে ওই নারীর নম্বর নিয়ে তাকে ফোন করে ডেকে পাঠায় সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। ওই নারীকে খুন করে তার দেহ টুকরো টুকরো করে আলাদা আলাদা জায়গায় ছড়িয়ে দেয়।
প্রথম জনকে হত্যার পর বাকিদের হত্যার উদ্দেশ্যে চিত্রকলা এবং সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা মান্ডিয়াতে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। বাকি দুই নারীকে একই ভাবে ফোন করে ডেকে পর পর দু’দিন দু’জনকে হত্যা করে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। এবার আর টুকরো টুকরো করে নয়, খুনের পর এই দুই নারীর মৃতদেহ দু’টুকরো করে তা ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে আলাদা আলাদা জায়গায় রেখে আসে। সেই দুই মৃতদেহেরই কোমর থেকে নীচের অংশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ।
পুলিশ তদন্ত করতে নেমেছে শুনে বাকিদের খুন করার পরিকল্পনা কিছু দিনের জন্য স্থগিত রাখে তারা। খুনের প্রায় দু’মাস হতে যাওয়ায় সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা মনে করে তাকে পুলিশ আর ধরতে পারবে না। কিন্তু জুলাইয়ের শেষে এসে পুলিশের জালে ধরা পড়ে সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা। কিছু দিন ধরে পুলিশকে ধীরে ধীরে পুরো ঘটনা শোনানোর পর জিজ্ঞাসাবাদের শেষ দিনে সে পুলিশ কর্মকর্তাদের জানায়, আসলে আট জনকে খুন করার ইচ্ছা ছিল তার। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার ‘হিটলিস্ট’-এর শেষ নাম নাকি ছিল খোদ চিত্রকলার। এ কথা শুনে পুলিশ তাকে এ রকম চিন্তার কারণ জানতে চাইলে তার উত্তর শুনে থ হয়ে যান পুলিশ কর্মকর্তারা। যাকে ভালোবেসে এতগুলো খুন করার এই সিদ্ধান্ত অবশেষে সেই চিত্রকলাকেই না কি খুন করতে চেয়েছিলেন সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা! সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা আরো জানায়, প্রথম এবং দ্বিতীয় খুন করার পর ভয় লাগলেও তৃতীয় খুনের পর সে নিজেকে ‘অপরাজেয় সিরিয়াল কিলার’ বলে মনে করতে শুরু করে।
সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা পুলিশকে জানায়, সে জানত পুলিশ যদি কোনো দিন তার খোঁজ পায় তা হলে তা পেতে পারে চিত্রকলার কাছ থেকেই। তখন আর তার ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ সিরিয়াল কিলার হওয়া হবে না। তাই ঠিক করে নেয় ‘নিখুঁত’ সিরিয়াল কিলার হতে হলে ভালোবাসাকে জীবন থেকে সরাতে হবে। সিদ্ধলিঙ্গাপ্পা জানায়, যেদিন সে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়, তার পর দিনই চিত্রকলাকে খুন করার ছক কষেছিল সে। কিন্তু অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচে চিত্রকলা।প্রাণে বাঁচলেও সিদ্ধলিঙ্গাপ্পার সঙ্গে জেলেই ঠাঁই হয়েছে চিত্রকলার। সিদ্ধলিঙ্গাপার সঙ্গে মিলে এত গুলো খুনের ছক কষার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে মান্ডিয়া থানার পুলিশ।