বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় ও বৈশ্বিক আলোচনাও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পাঁচ বছর পূর্তি হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে বাস্তুহারা রোহিঙ্গা ঢল নামে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। সেই সময় আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। এর পরের চার বছরে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে। এই হিসাবে ৪ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও নানা জটিলতায় তা সম্ভব হচ্ছে না। সবমিলিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই মনে করছেন, তারা বাংলাদেশের ওপর চিরস্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছেন। ওখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।
এরকম পরিস্থিতিতে কাল ২৫ আগস্ট পালিত হবে ‘রোহিঙ্গা নির্যাতন দিবস’। রোহিঙ্গারা দিনটিকে এ নামেই পালন করে আসছেন। গতকাল সোমবার চার দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত নোয়েলিন হেইজার। এদিন দুপুরে একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অণু বিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সফরকালে নোয়েলিন হেইজার রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরজমিন দেখতে ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। সফরকালে নোয়েলিন হেইজার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আজ মঙ্গলবার বিশেষ দূত কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন। সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন। একই দিন তিনি রিফিউজি, রিলিফ এন্ড রিপাট্রিয়েশন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করবেন। রাতে পররাষ্ট্র সচিবের আমন্ত্রণে নৈশভোজে অংশ নেবেন তিনি। বৃহস্পতিবার অর্থাৎ সফরের শেষ দিন বিশেষ দূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এরপর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রোহিঙ্গা সংকটের ৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করবেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহল যেভাবে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে, সেভাবে মিয়ানমারকে তাদের দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে দেশটির ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারছে না। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনায় রাজি করাতে পারেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দুই দেশের মধ্যে কমিটি গঠন এবং কয়েক দফা বৈঠক হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া একেবারেই থেমে আছে। এর জন্য আমাদের চীন, ভারত এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সহসা জট খুলবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে সরকার ও সরকারপ্রধান গত চার বছর ধরে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার কোনোভাবেই আন্তরিক নয়।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, চীন-মিয়ানমার সম্পর্কের ঐতিহাসিক রসায়ন ঢাকার নীতিনির্ধারকদের জানা। সেই হিসাব থেকেই হয়তো তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আবারো বেইজিংয়ের সহযোগিতা চেয়েছেন। গত ৭ আগস্ট
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের পুরনো ওই প্রত্যাশার কথা আবারো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা কোনো ফল দিচ্ছে না। বরং কক্সবাজার থেকে ভাসানচর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেশে ফেরার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসে মোটাদাগে চিড় ধরেছে। তাদের মনোবল ফেরানোর মতো কোনো রোডম্যাপ ঢাকার হাতে আছে কিনা, সে বিষয়েও গভীর সন্দেহ আছে দেশে-বিদেশে।
জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট গত ১৬ আগস্ট রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে বিবৃতিতে বলেছেন, মিয়ানমারে তাদের গ্রামে ও বাড়িতে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে পারবে। তবে পরিস্থিতি অনুকূল হলেই তা সম্ভব হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সীমান্তের বিদ্যমান অবস্থা প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয়। প্রত্যাবাসন সর্বদাই স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণভাবে সম্পাদিত হতে হবে এবং মিয়ানমারে নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলেই কেবল তা সম্ভব।
সাবেক কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জোট, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনেকটা আড়ালে রেখেই প্রত্যাবাসনের চেষ্টা হয়েছে। আবার চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।