বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সব পণ্য বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় চীনের বাজারে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজার হতে পারে চীন বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারক, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন সংশিষ্টরা।
তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা থেকে সরে এসে অন্যান্য খাতের দিকে নজর দিয়েছে। এরই মধ্যে দেশটিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সব আইটেম বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। গত ৭ আগস্ট চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ থেকে আরো ১ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে যা কার্যকর হবে।
এর আগে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির দেওয়া আগের শুল্কমুক্ত সুবিধার তালিকায় তৈরি পোশাক খাতের নিট ও ওভেনের প্রায় সব আইটেম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবে তখন বাংলাদেশের প্রধান এ রপ্তানি পণ্যের কিছু আইটেমে চীন পুরো শুল্ক তুলে দেয়নি। নতুন ১ শতাংশের আওতায় এবার তৈরি পোশাকের সব আইটেম বিনা শুল্কের সুবিধা পাবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক। বিশ্বে পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারকও বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রপ্তানিতে ৮২ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক; যা টাকার অঙ্কে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
চীনের আগের দেওয়া ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েও চীনের বাজারে রপ্তানি বাড়েনি বাংলাদেশের। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটিতে ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
করোনা মহামারির পর শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা কার্যকরের পাশাপাশি নতুন করে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি শুরুর পরও চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তেমন বাড়েনি, বরং পাঁচ বছর আগের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ১ বিলিয়ন (৯৫ কোটি) ডলারের অঙ্ক স্পর্শ করেছিল। এর পর থেকে দেশটিতে রপ্তানি কমছেই।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরও হতাশাজনক চিত্র নিয়েই শুরু হয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে চীনে ৪ কোটি ৮১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। গত বছরের জুলাই করেছিলেন ৪ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার। তার আগের বছরে একই মাসে এই অঙ্ক ছিল ৬ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
সে কারণে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ২০ শতাংশ আসে চীন থেকে, যার বেশিরভাগই তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য শিল্প খাতের কাঁচামাল।
গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে দাপট দেখিয়ে চলেছে চীন। কিন্তু সেদিন আর নেই; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে সেই দাপট হারাতে বসেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিতে ২০১৫ সালে চীনের অংশ ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি গত কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামেরও বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়ানোর পর থেকেই একটু একটু করে চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমছিল। তবে চীনের উহানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সেটি ব্যাপকভাবে কমে যায়।
বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, করোনার আগের বছর ২০১৯ সালে একক দেশ হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ৪৮৮ কোটি (২৪.৮৮ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করে চীন। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমেছিল ৯ শতাংশ। ২০২০ সালে সেই রপ্তানি কমে ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থার ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে চীন সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। তার আগের বছরের চেয়ে দেশটির পোশাক রপ্তানি ৭ শতাংশ কমেছে। তারপরও চীন বিশ্বের মোট পোশাক রপ্তানি ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ দখলে রেখেছিল। ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। আর বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। অথচ তার আগের বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তখন ভিয়েতনামের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২২ প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। ওই প্রতিবেদন পাওয়া গেলে ২০২১ সালের তথ্য জানা যাবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, চীন সরকার নতুন করে ১ শতাংশসহ মোট ৯৮ শতাংশ পণ্যে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, তাতে সব ধরনের পোশাক পণ্য রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে চীনে আমাদের পোশাক রপ্তানি অনেক বাড়ানো সম্ভব। দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে চীন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একটা বড় বাজার হতে পারে।
তিনি বলেন, চীন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য খাতে সরিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের রপ্তানি কমে যাওয়ায় চীন এখন পোশাক খাতের দিকে নজর কম দিচ্ছে। নতুন করে তারা এ খাতে বিনিয়োগ করছে না। এই সুযোগটিই বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে পোশাক খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। বিশ্ব পরিমন্ডলে আমাদের পোশাকের ভাবমূর্তি বেড়েছে। আমরা এখন কম দামি পোশাকের পাশপাশি দামি পোশাকও উৎপাদন করছি। চীন পোশাক উৎপাদন কমিয়ে দিলে দেড়শ কোটি মানুষের দেশে পোশাকের ব্যাপক চাহিদা দেখা দেবে। আমাদের সেই সুযোগটিই নিতে হবে।
দেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের কর্ণধার আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে চীন বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়েছিল, সেই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি মূলত করোনা মহামারির কারণে। চীনের জিরো কোভিড নীতির কারণে মহামারি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীনে ভ্রমণ করতে পারে না। নানা বাধাবিপত্তির কারণে এই এক বছরের বেশি সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা চীনে পণ্য রপ্তানির দিকে খুব বেশি নজর দিতে পারেনি। সে কারণেই গত অর্থবছরে সব দেশে আমাদের রপ্তানি অনেক বাড়লেও চীনে বাড়েনি। এখন আরো ১ শতাংশসহ মোট ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্পমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় আমাদের সব ধরনের পোশাক চীনের বাজারে বিনা শুল্কে ঢুকতে পারবে। আমার বিশ্বাস এখন চীনে আমাদের রপ্তানি বাড়বে। আগামী দিনগুলোতেও সেটা অব্যাহত থাকবে।
কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চীন দক্ষ জনবলের অভাব এবং উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় পোশাক খাত থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য শিল্প খাতে উৎপাদন বাড়াচ্ছে। বিশ্বে চীন পোশাক রপ্তানিতে প্রথম এবং রপ্তানি বাজারের ৪০ ভাগ তাদের দখলে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় হলেও মোট বাজারের মাত্র পাঁচ ভাগের কিছু বেশি বাংলাদেশের দখলে। বাংলাদেশ যদি চীনের বাজারের ২০ ভাগও নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের বছরে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় দ্বিগুণেরও বেশি হবে। আর নতুন প্রায় ৫৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, জিরো কোভিড নীতির কারণে চীন বিদেশিদের ভিসা দিচ্ছিল না। একইসময় বিদেশ থেকে ফিরে চীনা ব্যবসায়ীদের ২১ দিন দীর্ঘ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীরা দেশটিতে যেতে পারেনি। সার্বিকভাবে চীনের আমদানিও কমেছে। তাই দেশটিতে আমাদের ৯৭ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও রপ্তানি বাড়েনি। এরসঙ্গে আরও ১ শতাংশ পণ্য যোগ হয়েছে। কোভিড পিরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, চীন সরকার সবকিছু খুলে দিলে ভারতের মতো চীনেও আমাদের রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশের নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভারতের বাজারে আমাদের রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, চীনের বাজারেও আমরা যদি সেভাবে প্রবেশ করতে পারি, তাহলে আর আমাদের পেছনের দিকে তাকাতে হবে না। ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সব পণ্য বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় চীনের বাজারে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজার হতে পারে চীন বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারক, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন সংশিষ্টরা।
তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা থেকে সরে এসে অন্যান্য খাতের দিকে নজর দিয়েছে। এরই মধ্যে দেশটিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সব আইটেম বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। গত ৭ আগস্ট চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ থেকে আরো ১ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে যা কার্যকর হবে।
এর আগে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির দেওয়া আগের শুল্কমুক্ত সুবিধার তালিকায় তৈরি পোশাক খাতের নিট ও ওভেনের প্রায় সব আইটেম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবে তখন বাংলাদেশের প্রধান এ রপ্তানি পণ্যের কিছু আইটেমে চীন পুরো শুল্ক তুলে দেয়নি। নতুন ১ শতাংশের আওতায় এবার তৈরি পোশাকের সব আইটেম বিনা শুল্কের সুবিধা পাবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক। বিশ্বে পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারকও বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রপ্তানিতে ৮২ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক; যা টাকার অঙ্কে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
চীনের আগের দেওয়া ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েও চীনের বাজারে রপ্তানি বাড়েনি বাংলাদেশের। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটিতে ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
করোনা মহামারির পর শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা কার্যকরের পাশাপাশি নতুন করে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি শুরুর পরও চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তেমন বাড়েনি, বরং পাঁচ বছর আগের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ১ বিলিয়ন (৯৫ কোটি) ডলারের অঙ্ক স্পর্শ করেছিল। এর পর থেকে দেশটিতে রপ্তানি কমছেই।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরও হতাশাজনক চিত্র নিয়েই শুরু হয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে চীনে ৪ কোটি ৮১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। গত বছরের জুলাই করেছিলেন ৪ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার। তার আগের বছরে একই মাসে এই অঙ্ক ছিল ৬ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
সে কারণে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ২০ শতাংশ আসে চীন থেকে, যার বেশিরভাগই তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য শিল্প খাতের কাঁচামাল।
গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে দাপট দেখিয়ে চলেছে চীন। কিন্তু সেদিন আর নেই; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে সেই দাপট হারাতে বসেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিতে ২০১৫ সালে চীনের অংশ ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি গত কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামেরও বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়ানোর পর থেকেই একটু একটু করে চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমছিল। তবে চীনের উহানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সেটি ব্যাপকভাবে কমে যায়।
বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, করোনার আগের বছর ২০১৯ সালে একক দেশ হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ৪৮৮ কোটি (২৪.৮৮ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করে চীন। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমেছিল ৯ শতাংশ। ২০২০ সালে সেই রপ্তানি কমে ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থার ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে চীন সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। তার আগের বছরের চেয়ে দেশটির পোশাক রপ্তানি ৭ শতাংশ কমেছে। তারপরও চীন বিশ্বের মোট পোশাক রপ্তানি ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ দখলে রেখেছিল। ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। আর বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। অথচ তার আগের বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তখন ভিয়েতনামের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২২ প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। ওই প্রতিবেদন পাওয়া গেলে ২০২১ সালের তথ্য জানা যাবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, চীন সরকার নতুন করে ১ শতাংশসহ মোট ৯৮ শতাংশ পণ্যে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, তাতে সব ধরনের পোশাক পণ্য রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে চীনে আমাদের পোশাক রপ্তানি অনেক বাড়ানো সম্ভব। দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে চীন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একটা বড় বাজার হতে পারে।
তিনি বলেন, চীন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য খাতে সরিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের রপ্তানি কমে যাওয়ায় চীন এখন পোশাক খাতের দিকে নজর কম দিচ্ছে। নতুন করে তারা এ খাতে বিনিয়োগ করছে না। এই সুযোগটিই বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে পোশাক খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। বিশ্ব পরিমন্ডলে আমাদের পোশাকের ভাবমূর্তি বেড়েছে। আমরা এখন কম দামি পোশাকের পাশপাশি দামি পোশাকও উৎপাদন করছি। চীন পোশাক উৎপাদন কমিয়ে দিলে দেড়শ কোটি মানুষের দেশে পোশাকের ব্যাপক চাহিদা দেখা দেবে। আমাদের সেই সুযোগটিই নিতে হবে।
দেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের কর্ণধার আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে চীন বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়েছিল, সেই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি মূলত করোনা মহামারির কারণে। চীনের জিরো কোভিড নীতির কারণে মহামারি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীনে ভ্রমণ করতে পারে না। নানা বাধাবিপত্তির কারণে এই এক বছরের বেশি সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা চীনে পণ্য রপ্তানির দিকে খুব বেশি নজর দিতে পারেনি। সে কারণেই গত অর্থবছরে সব দেশে আমাদের রপ্তানি অনেক বাড়লেও চীনে বাড়েনি। এখন আরো ১ শতাংশসহ মোট ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্পমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় আমাদের সব ধরনের পোশাক চীনের বাজারে বিনা শুল্কে ঢুকতে পারবে। আমার বিশ্বাস এখন চীনে আমাদের রপ্তানি বাড়বে। আগামী দিনগুলোতেও সেটা অব্যাহত থাকবে।
কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চীন দক্ষ জনবলের অভাব এবং উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় পোশাক খাত থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য শিল্প খাতে উৎপাদন বাড়াচ্ছে। বিশ্বে চীন পোশাক রপ্তানিতে প্রথম এবং রপ্তানি বাজারের ৪০ ভাগ তাদের দখলে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় হলেও মোট বাজারের মাত্র পাঁচ ভাগের কিছু বেশি বাংলাদেশের দখলে। বাংলাদেশ যদি চীনের বাজারের ২০ ভাগও নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের বছরে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় দ্বিগুণেরও বেশি হবে। আর নতুন প্রায় ৫৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, জিরো কোভিড নীতির কারণে চীন বিদেশিদের ভিসা দিচ্ছিল না। একইসময় বিদেশ থেকে ফিরে চীনা ব্যবসায়ীদের ২১ দিন দীর্ঘ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীরা দেশটিতে যেতে পারেনি। সার্বিকভাবে চীনের আমদানিও কমেছে। তাই দেশটিতে আমাদের ৯৭ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও রপ্তানি বাড়েনি। এরসঙ্গে আরও ১ শতাংশ পণ্য যোগ হয়েছে। কোভিড পিরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, চীন সরকার সবকিছু খুলে দিলে ভারতের মতো চীনেও আমাদের রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশের নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভারতের বাজারে আমাদের রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, চীনের বাজারেও আমরা যদি সেভাবে প্রবেশ করতে পারি, তাহলে আর আমাদের পেছনের দিকে তাকাতে হবে না। ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।