জ্বালানি সংকট নিরসনে রাশিয়া থেকে তেল কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আজ। এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক পর্যালোচনা বৈঠক আয়োজন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কেবিনেট কক্ষেই বৈঠকটি হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সূত্রমতে, দুপুরের সেই বৈঠকেই অন্যান্য বিষয়ে সঙ্গে রাশিয়া থেকে তেল কেনার অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে অর্থাৎ মুড অব ট্রান্সফার কী হবে তা ঠিক হবে। উল্লেখ্য, রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনার বিষয়ে বরাবরই ইতিবাচক অবস্থানে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এ নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। তবে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে কয়েকটি বাধা আছে। যার অন্যতম হচ্ছে পরিশোধন প্রক্রিয়া ও বিনিময় পদ্ধতি।রাশিয়ার ক্রুড তেল ভারী হওয়ায় সেটি পরিশোধনে তৃতীয় দেশের সহায়তা নিতে হবে বাংলাদেশকে। আর মস্কো থেকে লেনদেন অর্থাৎ তেল কিনতে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলেই পেমেন্ট করার শর্ত রয়েছে। এর বড় কারণ রাশিয়ার জ্বালানি তেলের মজুত এবং তা বিক্রিতে দেশটির নিজস্ব মুদ্রা রুবলে কেনার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে দেশটি। সেই শর্ত পূরণ সহজ নয় বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ এবং রপ্তানি আয় ঘরে তোলা দুই ক্ষেত্রেই লেনদেন হয় প্রধানত ডলারে। এর বাইরে পাউন্ড, ইউরো, চীনা ইউয়ান এবং জাপানি ইয়েনেও লেনদেন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে রুবলের কোনো রিজার্ভ নেই। কারণ বৈদেশিক লেনদেনে এখনো রুবল ব্যবহার করা হয় না। দুই দেশের মধ্যে হওয়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ একদিকে কম, অন্যদিকে সেটা ডলার কিংবা ইউরোতে শোধ করা হয়েছে এতদিন। এর বাইরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য দুই দেশের মধ্যে আর্থিক লেনদেনও রুবলে হয় না। এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় এলসি খোলা হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বিবিসিকে জানিয়েছেন, সেই ঋণপত্রও খোলা হয়েছে ডলার এবং ইউরোতে। এছাড়া রুবল এখনো কনভার্টেবল বা বিনিময়যোগ্য মুদ্রা হিসেবে জনপ্রিয় না হওয়ায় সেটি বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করে এমন ব্যাংকগুলো এখনো রাখে না।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারের দর অনুযায়ী প্রতি রুবলে এক টাকা ৫৭ পয়সা পাওয়া যাবে। যদি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে রুবলে জ্বালানি কেনার ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে মূল্য পরিশোধের জন্য তাকে কিছুটা ঝামেলায় পড়তে হবে। অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের মতে, রুবল যেহেতু কনভার্টেবল না, সে কারণে তৃতীয় কোনো মুদ্রায় কনভার্ট করে তারপর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে চীনের ইউয়ান একটি বিকল্প হতে পারে। আরেকটি বিকল্প হতে পারে, রাশিয়ার সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি অংশ দ্বিপক্ষীয় বিনিময়ের মাধ্যমে পরিশোধ করা। তবে, এ সবই সম্ভাব্য ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর করতে হলে বাংলাদেশকে আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তার একটি উপায় হতে পারে মূল্য পরিশোধে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা মানে দ্বিপক্ষয়ি মুদ্রা বিনিময় চুক্তি করা। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করেছে বলে জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মি. ইসলাম। তবে তিনি জানিয়েছেন, এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার জ্বালানি তেল রপ্তানি কমেছে। ফলে তেল বিক্রিতে এশিয়া ও আফ্রিকায় নতুন বাজার খুঁজছে দেশটি।
এরইমধ্যে রাশিয়া থেকে রুবলে ‘খুব সস্তায়’ তেল কিনছে ভারত। রাশিয়া পূর্বে বাংলাদেশকেও বেশ কয়েকবার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ। কারণ ক্রুড অয়েল রিফাইনের ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে এখন বাংলাদেশ তৃতীয় দেশের মাধ্যমে কিংবা তৃতীয় দেশের সহায়তায় ঢাকায় রিফাইনারি করে হলেও রাশিয়ার তেল কিনতে আগ্রহী হয়েছে। সবশেষ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি পর্যালোচনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার প্রধানের নির্দেশের পর কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা যায়, রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান রসনেফট চট্টগ্রাম সমুদবন্দর পর্যন্ত প্রতি ব্যারেল ডিজেল ৫৯ ডলারে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে ইচ্ছুক। এছাড়া তুরস্কভিত্তিক তাতারস্তান ট্রেড হাউস জিটুজি ভিত্তিতে ক্রুড অয়েল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। সূত্র মতে, বিপিসি এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ক যাবতীয় প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে। বিপিসি সূত্র জানায়, রসনেফট, তাতারস্তান, ফ্লিট এনার্জিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। রাশিয়ার তেলের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, তাদের ক্রুড অয়েল অনেক বেশি ভারী।
সেটা পরিশোধনে সক্ষম রিফাইনারি এখনো বাংলাদেশের নেই। রাশিয়া যদিও আরেকটি ক্রুড অয়েলের স্যাম্পল পাঠিয়েছে। সেটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর আগে মে মাসে বাংলাদেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল রশিয়া। তবে সে তেল বাংলাদেশের রিফাইনারিতে ‘পরিশোধনযোগ্য নয়’- জানিয়ে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বিনিময় পদ্ধতির বিষয়ে বিপিসি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এটি নিয়ে একটু জটিলতা রয়েছে। রাশিয়া চাচ্ছে রুবলে লেনদেন করতে। সুইফটে নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারে দাম পরিশোধে কিছুটা ঝামেলা রয়েছে। আমাদের দেশেও যথেষ্ট রুবল নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কাজ করছে। সার্বিক সমস্যার সমাধানের জন্য শিগগির বৈঠক হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া আগে প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করতো, যার অর্ধেকের বেশি যেত ইউরোপে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে গেলেও এখন তা কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু তেল আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি কমাতে আর ডলার বাঁচাতে সরকার আগস্টের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যার প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে অনেকটা।
গম কেনার ক্ষেত্রেও সমান পদ্ধতির ব্যবহার হবে: রাশিয়া থেকে তিন লাখ টন গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টেটস্কি গত সপ্তাহে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে দেখা করে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। খাদ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন তারা তিন লাখ মেট্রিক টন গম রপ্তানির জন্য প্রস্তুত। আমরাও গম আমদানি করতে চাই। গমের দাম ঠিক করা, মূল্য পরিশোধ প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে শিগগির সিদ্ধান্ত হবে। সরকারি সূত্র মতে, আজকের বৈঠকে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। রাশিয়া থেকে গম কেনার ব্যাপারে ‘কোনো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা নেই,’ জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এর পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমার থেকেও গম আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল কেনার বিষয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জ্বালানি সংকটজনিত দুর্ভোগ এড়াতে রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কেনার সম্ভাব্যতা যাচাই করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।