মিয়ানমারের নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এবং এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে থাকা রোহিঙ্গাদের যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন (রিসেটেলমেন্ট) করা হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো মিয়নমারের গণহত্যার ৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
অ্যান্থনি ব্লিংকেন বলেন, ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা সমর্থন অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা নিজ ভূমিকে নিরাপদে ফেরত যেতে পারবে না। রাখাইনের সহিংসতা থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের অন্য স্থানসহ মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে ১৭০ কোটি ডলার মানবিক সহযোগিতা দিয়েছে। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের অন্য দেশ যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে সেই দেশগুলোর সরকারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিস্তৃত মানবিক সাড়াদানের জরুরি অংশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশে থাকা এবং এ অঞ্চলের অন্য স্থানে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসন উল্লেখজনক সংখ্যায় বাড়াতে কাজ করছি, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের জীবন পুনর্গঠন করতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে দুই দৃষ্টিভঙ্গিতে অবস্থান করছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের মতে, রোহিঙ্গা সংকটের শুরু মিয়ানমারে। এর সমাধানও মিয়ানমারকে করতে হবে। সংস্থাটি সংকটের সমাধান দেখছে সহায়ক পরিবেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের মধ্য দিয়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতে, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই। তারা বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছে।
তবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারের মধ্যেই দেখছে। মিয়ানমারে সহায়ক পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে নিজ ভূমিতে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের মধ্যেই সংকটের সমাধান বলে মনে করে ঢাকা।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মধ্যেই এ সংকটের সমাধান দেখছেন বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত নোলিন হাইজার। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর নেতৃত্বের কাছে আমি আহ্বান জানিয়ে যাব। সেই সঙ্গে শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য মিয়ানমার যাতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে, তার চাপ সৃষ্টি করতেও দেশগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়ে যাব।
মার্কিন এ বিবৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এটিকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। আরও দেশ যদি একইভাবে এগিয়ে আসে, তা বাংলাদেশের জন্য ভালো। যখন প্রথমদিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা এসেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশ বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে নিয়ে পুনর্বাসন করেছে বলে জানিয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন চলছে। সে উদ্যোগই বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মার্কিন বিবৃতিতে। যুক্তরাষ্ট্র যে ‘উল্লেখজনক সংখ্যায়’ রোহিঙ্গা নিতে চায়, সেই সংখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না। প্রতিবছর রোহিঙ্গা শিশুর জন্মের মধ্য দিয়ে যে সংখ্যক রোহিঙ্গা বাড়ছে, তার এক বছরের সমসংখ্যকও মার্কিন উদ্যোগে থাকবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫০০ থেকে ৬০০ রোহিঙ্গা পরিবারিক পুনর্মিলনের নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ২০১৭ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বিশেষ দূত বব রে বাংলাদেশের কাছে তাঁর দেশে রোহিঙ্গা নিয়ে যেতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কতজন রোহিঙ্গাকে নিতে চান? জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন ১৬ জনের কথা। বাংলাদেশের কাছে মূলত যে অনুরোধগুলো আসছে, সেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের পরিবারিক পুনর্মিলন।
বিষয়টিকে বাংলাদেশ খুবই সংবেদনশীলভাবে দেখে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা এমন কিছু উদাহরণ পেয়েছি; অনেক বাংলাদেশি বিদেশে গিয়ে নিজেদের রোহিঙ্গা বলে দাবি করে বাংলাদেশ থেকে পরিবার নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ফলে প্রতিটি আবেদন পর্যবেক্ষণ করে এগুলোর অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে।
কূটনীতিকদের মতে, রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের কথা বাংলাদেশ একাধিকবার বলেছে। তবে যে দেশ নিতে চায়, সেই সংখ্যাটি আসলে কত হবে, তা বিবেচনার বিষয়। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে যদি ২ লাখ রোহিঙ্গা পুরো বিশ্ব বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায়, তবে আরও ১০ লাখের বোঝা বাংলাদেশের ওপরেই থেকে যাচ্ছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ও তাদের বন্ধুরা যদি সব রোহিঙ্গা নিয়ে যায়, তাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে মিয়ানমার। এর পর লাভ হবে বাংলাদেশের। শুধু রোহিঙ্গা নিয়েই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্কে টানাপোড়েন রয়েছে। এ সংকটের যদি সমাধান হয়ে যায়, তবে সম্পর্ক উন্নয়নে আর কোনো বাধা থাকবে না।
তাঁদের মতে, যদি কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা নেয়, তবে এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে ধীরে চলার নীতি নিতে পারে। তারা অপেক্ষা করবে আর কোন দেশ কত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করে। যে হারে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাংলাদেশে বাড়ছে; আগামী ১০ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকবে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। মিয়ানমারে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে নানা ধরনের উদ্যোগের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ যে কোনো দেশের পুনর্বাসনের প্রস্তাবকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ আফগানিস্তান সংকটে নিরীহ আফগানবাসীর ছেড়ে কীভাবে পালিয়ে এসেছে পশ্চিমারা, তা পুরো বিশ্ব দেখেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগকে গঠনমূলক হিসেবে দেখলেও সংকটের সমাধান মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মধ্যেই রয়েছে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, সংকট নিরসনে অনেক পন্থার মধ্যে তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনও একটি। এটা হয়তো ১২ লাখের মধ্যে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা নেওয়ার কথা বলছে। এ সংকটের সমাধান মিয়ানমারের ভেতরেই হতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার মধ্য দিয়েই সংকটের সমাধান দেখছেন সাবেক এ কূটনীতিক।
এদিকে মিয়ানমারের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নতুন এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। আর ঢাকায় থাকা ১৪টি দূতাবাস ও হাইকমিশন রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকা এবং সংকট ও এর কারণগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে চেষ্টা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।