আধাবেলা হরতাল ডেকেছিল বাম গণতান্ত্রিক জোট। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হরতাল অপসৃত হওয়ার পথে। মহানগর ঢাকার মানুষেরা প্রায় ভুলতেই বসেছিল হরতালের নাম। বহু দিন পর বামপন্থী রাজনৈতিক জোট গণতান্ত্রিক রাজনীতির ওই মাধ্যমটি ব্যবহার করল। অতীতে আমরা দেখেছি হরতাল, লাগাতার হরতাল করার রাজনৈতিক প্র্যাকটিস ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। সামান্য কিছু ছিল জাতীয় পার্টিরও দখলে। অন্য দলগুলোতে হরতাল সংস্কৃতি থাকলেও তারা হালে তেমন পানি পায়নি। তারা মূলত আওয়ামী জোট ও বিএনপি জোটের শরিক হিসেবে হরতাল করেছে। একা একা হরতাল দিয়ে তা সফল করতে পারে কেবল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। হরতালের আগে মশাল মিছিল, মিছিল, আর ভাঙচুর করা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক। গাড়ি পোড়ানো, টায়ারে আগুন দিয়ে জানান দেয়াও ছিল, এখনো আছে, তবে তা কম। সাধারণ মানুষ হরতাল পছন্দ করে বলে মনে হয় না বিশেষ করে দিনমুজুরি যারা করেন, যাদের রাস্তায় না বেরুলে হাঁড়ি উঠবে না চুলায়, তারা জীবন হাতে নিয়ে হরতালে রাস্তায় নামে। এরা হরতালের পক্ষেই বেশি, বিপক্ষে তেমনটা নয়। হরতাল কেন তারা পছন্দ করে?
হরতাল ডাকার কারণ হচ্ছে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়া। সেই সাথে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ায় মহানগরবাসীর নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় আজ। কাঁচাবাজারের পণ্য আসে দেশের প্রান্তিক এলাকা থেকে। ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষদের যে কি হীনতর অবস্থা তা আমরা অনুধাবণ করতে পারি, কিন্তু যারা জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে ঘাটতি সামলাবার চেষ্টা করছে সেই সরকার ৪৫ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত প্রতি লিটারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতেই ক্ষুব্ধ গরিব মানুষ। তারা তেলের ক্রেতা ভোক্তা নয়, কিন্তু তাদের পিঠের ওপর দিয়েই মূলত স্টিম রোলারটি যায়।
আর ওই গণমানুষের পক্ষেই হরতালের ডাক এসেছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলগুলোও জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ দেশজুড়ে নানান রকম প্রতিবাদী সমাবেশ করছে। তারা বলছে, সরকার ভর্তুকি না দিয়ে জনগণের পকেট কাটার জন্যই ওইসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা দুটো উদাহরণ দিয়েছে। একটি ডিম, অন্যটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে উৎপাদন ছাড়াই গত ১৪ বছরে মাত্র ৮৬ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে। যাকে বৈধ বলা যাবে না। অবৈধ।
বলা হয়েছে, ডিমের বড় ব্যবসায়ীরা মাত্র দুই মাসে ৫২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিয়েছে। ভোক্তরা প্রতি হালির জন্য সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন। সর্বনিম্ন কত ছিল প্রতি হালি ডিমের দাম তা কি আমাদের মনে আছে? না, মনে নেই। কারণ, ডিমের দাম জ্যামিতিক হারে বাড়ানো হয়েছে। যদি এমনটা হতো যে ডিমের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম, তাহলে বলা যেত, চাহিদামতো জোগান না থাকায় দাম বেড়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়। ডিমের উৎপাদন চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। তাহলে কেন এবং কারা এই দাম বাড়ানোর হোতা?
বলা হচ্ছে, সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই ডিমের দাম বেড়েছে। ডিমের যারা হোলসেলার বা আড়তদার, তারাই এটা করেছে। সরকার প্রশাসন সবাই তাদের চেনে। তারা সরকারের রাজনৈতিক সহযোগীও। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এটাই সরকারগুলোর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চরিত্র। এই চরিত্র নিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতি করা যায় না।
২.
বাম জোটের আধাবেলা হরতাল সফল হয়নি, এটা সরকারি ভাষ্য। আর বামজোটের ভাষ্য রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় হরতাল পালিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ হরতালের রাজনৈতিক অ্যাকশন কিছুটা দেখেছে বটে, তবে তাদের পিটিয়ে সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। বিএনপির দেশব্যাপী কর্মসূচিগুলো ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে পালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছে, সেসব খবর পত্রিকায় এসেছে আসছে। দেশের হেন কোনো এলাকা নেই যে যেখানে সরকারপক্ষ হামলা চালায়নি। অথচ প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, এখন আর তাদের মিটিং মিছিলে পুলিশি বাধা হবে না। তিনি অবশ্য ছাত্রলীগ, যুবলীগের কথা বা আওয়ামী লীগের কথা বলেননি। মনে হয়, সে কারণেই ওই তিনটি সংগঠন তাদের রাজনৈতিক কীর্তি অনুসরণ করে প্রতিপক্ষের প্রতিবাদ মিছিলে হামলা করছে। বিএনপি সরকারদলীয় সংগঠনগুলোর হামলার কথা মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারকে দেশবাসীকে জানাচ্ছে।
প্রতিদিনই বিএনপি মহাসচিব তার বক্তৃতায়, কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা সরকারের সমালোচনা করছেন। কিন্তু এখন আর সেই অর্থে কাউকে ধরছে না। তবে হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দিচ্ছে। সেই মামলার কারণে কর্মীরা নিজের বাড়িতে থাকতে পারছেন না।
রাজনীতির এটি একটি পুরনো খেলা। আমরা বহুবারই এমনটা দেখেছি, সব সরকারের আমলেই এটা ঘটেছে কম আর বেশি। এটা যে সংবিধানের বরখেলাপ, রাজনৈতিক সরকার তা মনে করে না। সংবিধানকে কেয়ার না করার এই প্রবণতা আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটের মূলে।
৩.
বহুদিন পর হলেও, হরতাল সফল হোক না হোক, দেশের গরিব-গুরবো মানুষের দুঃখ লাঘবের লক্ষ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। জনগণের কথা ভাবলে সরকার এভাবে দাম বাড়াতে পারত না। আর সরকারি দলের লোকেরা বলছেন, ধাপে ধাপে না বাড়িয়ে ক্রেতাদের অর্থনৈতিক নার্ভের ওপর একবারেই চাপ দেয়া হয়েছে, তারা এটা মানিয়ে নিতে পারবে, পারছে। কিন্তু সেটা কতটা সত্য তা পরখ করে দেখা দরকার। প্রতিবাদ মিছিলে জনগণ নামছে না বলেই যে গরিবের কেনার শক্তি আছে, এমন বেআক্কেলি ভাবনার মিথ্যা বয়ানকে আমরা ভয় পাই। জনগণের রাস্তায় নামার সময় যখন আসবে, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব দ্রুতই পাল্টে যাবে। ক্ষুধার্ত মানুষের কিন্তু হুঁশ কমে যায়। সরকারি তরফ অবশ্য যুক্তি দেবেন যে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য আছে, আমদানি বন্ধ নেই খাদ্যশস্যের। সবার মুখে খাদ্য দেয়ার জন্য সরকার ওএমএস চালু করেছে প্রায় গ্রামের স্তর পর্যন্ত। কিন্তু ওই মানুষের যে কিনে নেয়ার টাকা নেই, তাদের আয় যে প্রায় অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে, সরকার তা স্বীকার করে না। কিন্তু গুদামে যথেষ্ট খাদ্যমজুদ থাকলেই যে গরিবের হাঁড়িতে চাল পৌঁছাবে, এরকম ফাঁকাবুলির আওয়াজে আর চিড়ে ভিজবে না। যাদের কিনে খাওয়ার সামর্থ্যই নেই, তাদের নাকের কাছে খাদ্যের মুলো ধরে রাখলে কী ফল হবে? খাদ্যের বিতরণ ব্যবস্থা যে ভাঙা সেটা ওএমএস চালু রাখাই প্রমাণ করে। এই খাদ্যশস্য বিতরণের ফাঁকফোকর বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি দেশের তথাকথিত মধ্যবিত্ত, আসলে যারা ওই শ্রেণীর মানেই জানে না, তারাও আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে আজ ব্যাপকভাবে। ধনীরা আরো ধনী হয়েছে- হচ্ছে, গরিবরা আরো গরিব।
৪.
আসল সঙ্কট সরকারি ব্যবস্থাপনার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্কট। সরকার ম্যানেজার হিসেবে সব ক্ষেত্রে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। সরকার এক দিকে বলছে কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে। আবার সেই সরকারই বিশাল বিশাল অঙ্কের প্রজেক্ট নিচ্ছে বাস্তবায়নের জন্য। সেগুলোতে লাগবে বৈদেশিক মুদ্রা। দেশে ডলার সঙ্কট ভয়াবহ। ডলারের রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসায় অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করেছে সরকার। বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিয়ে কিছুটা সাশ্রয় করতে পারছে কিন্তু বিদ্যুতের সিস্টেম লসের নামে চুরি ও চোরাই লাইনের চুরি, ঘুষ নিয়ে বিল কমিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা, বিল কারচুপি বন্ধ করছে না বা করতে পারছে না। এই যে পরস্পরবিরোধী কর্মকাণ্ড, এরপর কি আমরা বলতে পারব সরকার সত্যিই কৃচ্ছ্রতা পালন করছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য সরকার ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। সেপ্টেম্বরের যেকোনো দিন ভারতীয় বিদ্যুৎ এলেই লোডশেডিং আর করতে হবে না, জানানো হয়েছে। ডলার খরচা করে ভারতীয় বিদ্যুৎ আনা হলে কি রিজার্ভে টান পড়বে না? আমদানি কি এর সমাধান? নাকি বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পুরোমাত্রায় ব্যবহার করা উচিত। ২৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও কেন শুধু জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়াকে এর কারণ বলছেন? উচ্চমূল্যে জ্বালানি তেল কিনলে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে, আমদানি করলে যে তার শতগুণ বেশি হবে, সেই অঙ্কটি কি করে দেখেননি?
দ্বিতীয়ত জ্বালানির বিকল্প নিয়ে কি ভেবেছেন গত ১৩-১৪ বছর ধরে? নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা মুখে বললে তো হবে না, কাজে লাগাতে হবে। ধানের ভুসি ও খড় থেকে তেল উৎপাদন করা যায়, গম ও ভুট্টা থেকেও তা পারি আমরা। বায়ুচালিত টারবাইন সুপ্রাচীন পদ্ধতি হলেও আমাদের উপক‚লবর্তী এলাকা উৎস হতে পারে। জলবিদ্যুতের কথা নাইবা বললাম। সোলার প্যানে করেও মোকাবেলা করা যায় জ্বালানি সঙ্কট।
আসল কথা হলো, এ নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? দেশের প্রতিটি ছোটো বড় কারখানাকে সোলার প্যানেলের আওতায় আনলে যে গ্যাস ও তেলের বিদ্যুতের ওপর চাপ কমত, সেটাও তারা ভাবেননি। ভেবেছেন কি করে আমদানি করব আর কমিশন খাবো। সেসব পরামর্শ দিয়ে সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছে। তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ আর নয়। দয়া করে জনগণের ওপর ওই অপচয় বন্ধ করা গেলে বামপন্থী দলগুলোকে হরতালের ডাক দিতে হয় না। আমাদের ধারণা, শিগগিরই আসছে বিএনপির হরতাল মহাওয়েভ, তখন দেশের অবস্থা কি হবে? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সাধারণ মানুষ পুলিশের গুলির ভয়ে ঘরে বসে থাকবে না।