ঝিনাইদহের শ্রীপুরের কৃষক আবদুর রাজ্জাক। পেটে ব্যথার কারণে সম্প্রতি প্রতিবেশীর পরামর্শে অ্যাম্বুলেসে আসেন রাজধানীর কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। সেখানে ইসিজি, ইকো, এক্স-রে, ইটিটি পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় না করতে পারায় পাঠানো হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দ্বিতীয়বার আগের পরীক্ষাগুলোই করানো হয়। কিছু পরীক্ষা বেসরকারি হাসপাতালেও করতে হয়। তবে এখানেও বড় কোনো সমস্যা ধরা পড়ে না। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসক জানান, গাস্ট্রিকের কারণে পেটে ব্যথা হয়েছিল। এর চিকিৎসা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেই নিতে পারতেন। শুধু শুধু রাজধানীতে এসেছেন। তবে এর মধ্যেই রাজ্জাকের চিকিৎসায় খরচ হয় ৪০ হাজার টাকার ওপরে।
আবদুর রাজ্জাক জানান, তাঁর স্বল্প আয়ে চলে পাঁচ সদস্যের সংসার। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে স্বজনের কাছে হাত পাততে হয়েছে। অথচ সঠিক পরামর্শ পেলে অন্তত ১০ গুণ কম খরচে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেই এর চিকিৎসা নিতে পারতেন। ভোগান্তি থেকেও রক্ষা পেতেন।
চিকিৎসা করাতে গিয়ে এভাবে প্রতিদিন দেশের হাজার হাজার রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। প্রাথমিক পরামর্শের জন্য রোগী কোথায় যাবেন, কোন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেবেন, কতটুকু অসুস্থ হলে কোন পর্যায়ের হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন- স্বাস্থ্য বিভাগের এ-সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইনই নেই দেশে। এ অবস্থায় রোগী নিজের সিদ্ধান্তে প্রখ্যাত হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল করে অন্য রোগের বিশেষজ্ঞের কাছে যান।
এমন পরিস্থিতি উত্তরণে বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসায় স্ট্রাকচারাল রেফারেল পদ্ধতি চালুতে। চিকিৎসা ব্যয় কমানো ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১২ সালে রেফারেল পদ্ধতির একটি কাঠামোও তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০১৬ সালে উদ্যোগ নেওয়া হয় ডিজিটালাইজেশনের। তবে অজ্ঞাত কারণে ১০ বছর পরও রেফারেল পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তারা জানান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চান না এটি বাস্তবায়ন হোক। সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদেরও এ বিষয়ে অনীহা রয়েছে। এ ছাড়া বড় বাধা জনবল ও অবকাঠামো সংকট।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশ রেফারেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালনা করে। এশিয়ার বেশকিছু দেশে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে দেশীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা না থাকায় এটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দু-একটি জেলায় রেফারেল পদ্ধতি চালু হলেও ডিজিটালাইজেশন সম্ভব হয়নি। দক্ষ জনবল, অবকাঠামো সংকটসহ নানাবিধ কারণে সরকারের এ উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
রেফারেল পদ্ধতি কী : সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সবার জন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থাকবে। জরুরি ছাড়া সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সেই কেন্দ্র থেকে নিতে হবে। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক অন্য হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। রোগীর পছন্দে হাসপাতাল বা চিকিৎসক থাকবেন না। নির্ধারিত হাসপাতালে রোগীদের সব তথ্য অনলাইনে সংরক্ষণ করা হবে। এক ক্লিকে রোগীর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
বর্তমানে দেশে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু রয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার জন্য সরাসরি ঢাকায় চলে আসছেন। অথচ প্রথমে তাঁর কমিউনিটি ক্লিনিক অথবা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার কথা। সেখানকার নির্দেশনা অনুযায়ী যাওয়ার কথা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা, বিভাগ এবং সবশেষে টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসার কথা।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ূয়া বলেন, বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত সম্ভব নয়। কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে কোথায় গেলে সঠিক চিকিৎসা পাবেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। রেফারেল পদ্ধতি চালু না হওয়ায় রোগ শনাক্তে দেরি হচ্ছে, মিলছে না সঠিক চিকিৎসা।
দেশে রেফারেল পদ্ধতি চালু না থাকায় সামান্য রোগ নিয়েই টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ছুটছেন অনেকে। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী, কিডনি, চক্ষুবিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সরকারি টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ভিড় করছেন তাঁরা। শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী আসায় সুচিকিৎসাও পাচ্ছেন না তাঁরা। এ ছাড়া নামিদামি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগীর উপচেপড়া ভিড় থাকছে। এসব চিকিৎসক ব্যক্তিগত চেম্বারে দিনে মাত্র তিন-চার ঘণ্টায় গড়ে ২০০-৩০০ রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন।
রেফারেল পদ্ধতি কাঠামো প্রস্তুতের উদ্যোগ নেওয়ার সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার লাইন ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম। বর্তমানে অধিদপ্তরের পরিচালক-প্রশাসনে দায়িত্বরত এ কর্মকর্তা বলেন, ওই সময় রংপুর ও নীলফামারীতে পাইলট প্রকল্প চালু করা। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনার পরিকল্পনা হয়েছিল। ওই দুই জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্নিষ্ট সবার সঙ্গেই তখন আলোচনা হয়েছিল। সেবা নিশ্চিতে কী কী উন্নতি করতে হবে, তা নিয়ে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গেও আলোচনা হয়। এরপর সরকারি চাকরির সুবাদে অন্য দায়িত্বে চলে যান। এখন কী অবস্থা বলতে পারবেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, আমাদের দেশে রোগীরা নিজ সিদ্ধান্তে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। এতে অর্থের অপচয় ও ভোগান্তি হয়। আবার যে চিকিৎসকের কাছে রোগী যান, তাঁরও সময়ের অপচয় হয়। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, যাদের চেম্বারে প্রতিদিন ২০০-৩০০ রোগী দেখতে হয়। এতে তিনি রোগীকে সময় নিয়ে দেখতে পারেন না। রেফারেল পদ্ধতি চালু হলে রোগী সরাসরি টারশিয়ারি হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে পারবেন না। এতে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, সরকারের যথাযথ উদ্যোগ না থাকা। গ্রামীণ পর্যায়ে হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও উপকরণ না থাকায় রেফারেল সিস্টেম চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সাধারণ জ্বর-সর্দি নিয়েও ধনীরা বড় বড় বিশেষজ্ঞের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার লাইন ডিরেক্টর শাখার রেফারেল পদ্ধতি চালুর দায়িত্বরত কর্মকর্তা বর্ষা সোরেন বলেন, দীর্ঘদিন এ শাখায় জনবল সংকট ছিল। অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জনবল সংকট নিরসন ছাড়া এই সেবা চালু করা সম্ভব নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যেসব যন্ত্র প্রয়োজন, গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সব হাসপাতালে তা নেই। আবার সামান্য সমস্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে দৌড়ানোর সংস্কৃতিও এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের অন্যতম বাধা।