ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন-শোষণ থেকে উপমহাদেশের মানুষের মুক্তির আন্দোলনে, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের কবিতা ও গান ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।
শনিবার (২৭ আগস্ট) ছিলো তার ৪৬তম মহাপ্রয়াণ দিবস।
৭৭ বছরের জীবনকালের বর্ণময় সাহিত্যের জীবন ছিল মাত্র ২৩ বছর। আর এই সময় নজরুল যা সৃষ্টি করেছেন তা পাল্টে দিয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভান্ডার।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় যে কবির আবির্ভাব ঘটেছিল ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’ হয়ে, সে ঝড় চিরতরে থেমে গিয়েছিল ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালের কেবিনে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্রে।
স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন কবিকে। বিদ্রোহী কবি বাংলাদেশে অভিষেক হয় ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে। তার ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’ গানের বাণীর আকাঙ্ক্ষা ভোলেনি বাংলাদেশ— সে আকাঙ্ক্ষাই পূরণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করে।
জাতি যথাযোগ্য মর্যাদায় গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করেছে জাতীয় কবিকে।
সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলার সাহিত্যাকাশে কবিরূপে নজরুলের অভ্যুদয় কেবল ধূমকেতুর সঙ্গেই তুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
নজরুলের সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। একদিকে ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, অন্যদিকে শ্যামা সঙ্গীত লিখে তিনি বাঙালি মানসের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরও সুগভীর করেন। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। ধ্যানে-জ্ঞানে, নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, চিন্তাচেতনায় ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের আর্তি বিশেষভাবে প্রকাশ পায় তার রচনায়।
কবি, সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ নজরুলের মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন, নজরুলের কথা আজ যখনই মনে পড়ে আমাদের, মনে পড়ে মিলনগত এই অসম্পূর্ণতার কথা। আর তখন মনে হয়, বাক শক্তিহারা তার অচেতন জীবনযাপন যেন আমাদের এই স্তম্ভিত ইতিহাসের এক নিবিড় প্রতীকচিহ্ন। যে সময়ে থেমে গেলো তার গান, তার কথা, তার অল্পকিছু আগেই তিনি গেয়েছিলেন, ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়োনা জাগায়োনা।’
রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে তার এই কথাগুলো নজরুলকেই ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘তার কথাগুলো আমরা যেন ফিরিয়ে দিতে পারি তাকেই, ‘যেন আমরাই ওগুলি বলছি নজরুলকে লক্ষ্য করে।
‘নজরুল ইতিহাস ও সময় সচেতন মানুষ ছিলেন, যার প্রভাব তার লেখায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে নজরুল তাঁর সাহিত্যে বিপুলভাবে ধারণ করেছেন। সেই সময়ে ধর্মান্ধ মুসলমানদের তিনি পুনর্জাগরণের ডাক দিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল একজন বলিষ্ঠ নেতার মতো।’
কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন।
প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্দিপ্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।
তিনি ছিলেন চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তার বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন।